মতিউর রহমান চৌধুরী: সবাইকে হতবাক করে দিয়ে মিজান চলে গেল। এখন সংসার তাকে ডাকবে না। ছেলেমেয়েরা জানাবে না কোনো আবদার। অফিস থেকে ফোন আসবে না। বলবে না, এই বিষয়ে লিখতে হবে। সতীর্থরা প্রশংসা করে বলবে না, ‘তুই আমাদের গর্ব’। বন্ধুরা বলবে না, চল মিজান ঘুরে আসি। আদালত পাড়ায় তার লেখা নিয়ে কাড়াকাড়ি হবে না।
সমালোচকরা বলবেন না, মিজান কাউকে ছাড়ে না। মুক্তিযুদ্ধের গবেষকরা কি বলবেন? আমাদের যে বড় ক্ষতি হয়ে গেল। মুক্ত চিন্তার মানুষেরা বলবেন, দুর্ভাগ্য! ওকে ধরে রাখা গেল না। টকশো আয়োজনকারীরা তাকে ক্রমাগত ফোন দেবেন না। বলবেন না, প্লিজ! আমাদের শোতে আসুন। মিজান আর বলবে না দুঃখিত, অনুমতি নেই। আমি কি বলবো? আমি যে কিছুই বলতে পারছি না। আমার তো অনেক বলার ছিল। ২৮টা বছর এক সঙ্গে থাকলাম। অন্য পত্রিকায় চলে গেলেও এক মুহূর্তের জন্য ভাবিনি মিজান আমার সঙ্গে নেই। একবারও কথা হয়নি এমন দিন খুবই কম ছিল। এমনকি বিদেশে থাকলেও। ২৮ বছর আগের এক সকাল। অফিসে ঢোকার পর একটা স্লিপ পেলাম। দেখা করতে চাই। আমি তখন বাংলাবাজার পত্রিকার সম্পাদক। গ্রীন রোডে আমাদের নিজেদের বাড়িতে অফিস। একজন অফিস সহকারীকে বললাম, আসতে বলো। শুরুতেই পরিচিত হওয়ার পর সরাসরি কাজ করার আগ্রহ ব্যক্ত করলেন এই যুবক। দশ মিনিট কথা বলে মনে হলো, ওকে দিয়ে রিপোর্টিং হতে পারে। বললাম, ঠিক আছে। তবে এখনই চটজলদি একটা রিপোর্ট লিখে দেবেন। শুরু থেকে আপনি। শেষদিন পর্যন্ত আমি কোনোদিন তাকে তুমি বলে ডাকতে পারিনি। রিপোর্ট হাতে পেয়ে আমার ধারণা পাল্টে গেল। বললাম, চমৎকার। কালই কাজে যোগ দিতে পারেন। এরপর থেকে তো মিজান অপরিহার্য। অনুবাদেও পাকা। এরও একটি ইতিহাস আছে। একদিন রয়টার্সের একটি রিপোর্ট ধরিয়ে দিয়ে বললাম, এটা অনুবাদ করা কি সম্ভব? দেখি চেষ্টা করে। কিছু সময় পরে বার্তা সম্পাদক এসে বললেন, ছেলেটা ভালোই অনুবাদ করেছে। তাই নাকি! তাহলে কি তাকে ডেস্কে দেব? কিন্তু আমার মনে হলো- ও রিপোর্টিংয়ে ভালো করবে। আখেরে দেখা গেল, সে দেশের একজন সেরা রিপোর্টার হিসেবে পরিচিতি পেয়ে গেল অল্পদিনের মধ্যেই। আসলে মিজান একজন সাচ্চা সাংবাদিক। ওর মধ্যে কোনো ভেজাল নেই। দলীয় তকমাবিহীন এই সাংবাদিককে নিয়ে হাজার পৃষ্ঠা লেখা যায়। ওর সম্পর্কে এমন কিছু নেই, যা আমি জানি না। বিশ্বাস করুন, ওকে নিয়ে কি লিখবো বুঝতেই পারছি না। মিজানুর রহমান খান বাংলাদেশের সাংবাদিকতা জগতের এক বিস্ময়। এত অল্প সময়ে বড় কোনো পদে না থেকেও মানুষের যে ভালোবাসা পেয়েছেন তা বোধকরি আর কেউ পাননি। একটাই কারণ, তার মতো সাহসী আর নিবেদিতপ্রাণ সাংবাদিকের সংখ্যা খুবই কম। সমকাল সম্পাদক সারওয়ার ভাই আজ বেঁচে নেই। প্রেস ক্লাবের এক আড্ডায় তিনি বলেছিলেন- মতি, আমাদের বরিশালের এই ছেলেটাকে কীভাবে আবিষ্কার করলেন? প্রয়াত মূসা ভাই বলতেন, মিজান যেকোনো সংবাদমাধ্যমের জন্য এক বড় সম্পদ। প্রথম আলো সম্পাদক মতি ভাইও তার লাশের সামনে দাঁড়িয়ে অশ্রুসজল চোখে বলেছেন, তার মৃত্যুতে পত্রিকার বড় ক্ষতি হলো। সত্যিই তাই। ঢাকায় একটা ছোট্ট অ্যাপার্টমেন্টও নেই তার। ভাবা যায়! তার মতো একজন সাংবাদিকের কোনো অ্যাপার্টমেন্ট নেই। সরকারি জমি বরাদ্দের তালিকায়ও তার নাম ওঠেনি কখনো। এটা কি দলভুক্ত না হওয়ার শাস্তি? এই মহামারির মধ্যে ছ’মাস আগে একটা পুরনো অ্যাপার্টমেন্ট অল্প দামে ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে কেনার ব্যাপারে আগ্রহী হয়েছিল মিজান। আমি নিজেই যুক্ত ছিলাম এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে। বেশ কিছুদূর এগিয়ে যাওয়ার পর এই প্রক্রিয়া মাঝপথে থেমে যায়। আরও অনেক কিছু লিখতে ইচ্ছে করছে। টাকার অভাবে ছেলেটা ইংল্যান্ডে বার এট ল’ করতেও যেতে পারেনি।
হাসপাতালের বেডে কাতরাচ্ছে মিজান। খবরটি আসার পর একটি লিখা লিখলাম। ওর এবং পীর হাবিবের সুস্থতা চেয়ে। খবরটি প্রকাশের পর ঢাকার একটি বড় শিল্পগোষ্ঠী প্রস্তাব পাঠালো, মিজানের চিকিৎসার সব খরচ বহন করতে চায় তারা। দেশে বড় কোনো হাসপাতালে কিংবা বিদেশে। পরিবারের সঙ্গে যেহেতু আমি কোনো না কোনোভাবে যুক্ত তখন খবরটা আমার কাছে এলো। আমি শুধু বলেছিলাম, এটা নির্ভর করছে প্রথম আলোর ওপর। এটা আর এগোয়নি। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের বেডে শুয়েও মিজান হোয়াটসঅ্যাপে বার্তা পাঠিয়েছিল- ভালো আছি, শরীর দুর্বল লাগছে। এরপর অন্য হাসপাতালে। নিয়মিত খবর পেতাম। ওর ছোট ভাই মশিউর খবর দিতো সকাল-বিকাল। মশিউরও আমার সহকর্মী ছিল। মানবজমিনে কাজ করেছে। এখন ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাধারণ সম্পাদক। সোমবার দুপুরে মিজানের স্ত্রী’র ফোন পেয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়লাম। একপ্রান্তে আমি কাঁদছি, অন্যপ্রান্তে মিজানের স্ত্রী। এক মিনিট কথা বলেই মেয়ের হাতে ফোন দিয়ে বললেন, এটা ওর কাছ থেকে শুনুন। একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া মেয়েটি সেও কথা বলতে পারলো না। সন্ধ্যায় যখন খবর এলো- মিজান আর নেই, তখন নিজেকে বড় অপরাধী মনে হচ্ছিলো। একদিনও হাসপাতালে যেতে পারলাম না। বাসায় তার পরিবারের সঙ্গেও দেখা হলো না। সর্বনাশা করোনা যে আমাকে ঘরবন্দি করে রেখেছে। নিউ ইয়র্কের ওয়েল কর্নেল হাসপাতালের পরামর্শ অনুযায়ী, ঘরে বন্দি আছি প্রায় দশ মাস। তাদের ভাষায়, আমি নাকি সেনসিটিভ রোগী। ওই হাসপাতালেই আমার ওপেন হার্ট হয়েছিল। অফিস সহকর্মীদের সঙ্গেও দেখা হয় না। বাড়িতে বসে ডিজিটাল পদ্ধতিতে কাগজ চালাই। কী দুর্ভাগ্য দেখেন, আমি যখন ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি তখন আমার দু’ব্যাগ রক্তের দরকার ছিল। অফিসের দু’জন সহকর্মী রক্ত দিলেন। মিজান হাসপাতালে পৌঁছেই আমার স্ত্রীকে বললো, আমিও রক্ত দিতে চাই। আমার শরীরের সব রক্ত। ভাগ্যের কী ফের দেখেন, মিজানই আগে চলে গেল। মিজান আমাকে ক্ষমা করবেন প্লিজ। মিজান একটি জাতীয় দৈনিকের সম্পাদক হওয়ার প্রস্তাব পেয়েছিল। একজন স্বনামখ্যাত ব্যবসায়ী প্রস্তাবটি দিয়েছিলেন। কিন্তু কোথায় যেন গোলমাল হয়ে গেল। সে প্রস্তাব আর বাস্তবায়িত হয়নি। কতো পরিকল্পনা ছিল ওর সঙ্গে। দু’জনে মিলে একটা বই লিখবো। বাংলাদেশের রাজনীতি ও সাংবিধানিক সংকট নিয়ে। আমি লিখবো রাজনীতি। আর সে লিখবে সাংবিধানিক সংকট। সেটারও মৃত্যু হয়ে গেল। এভাবেই থেমে যায়। অনেক ইচ্ছের মৃত্যু হয়। পারিবারিক আড্ডাও মিস করবো। ঈদে আমাদের বাসায় বড় একটা আড্ডা হয়। মিজান পরিবার নিয়ে আসে। সে আড্ডায় মিজান থাকবে না। থাকবে শুধু মিজানের স্মৃতি। মিজান কি ছিল? এক কথায় বলতে গেলে, মিজান ছিল সাংবাদিকতার জাদুকর। শুধু আইনি সাংবাদিকতার বাতিঘর নয়। আমি তাকে চিনেছি একজন অলরাউন্ডার হিসেবে।