জীবন কখনো কখনো খুব নিষ্ঠুর। সাংবাদিকতাও। চোখে পানি। তবুও কী-বোর্ডে আঙ্গুল চালাতে হয়। লিখতে হয় স্বজন হারানোর শোকগাথা। বেশ কিছুদিন হলো আপনি হাসপাতালে ভর্তি। মন খারাপের নানা সংবাদ পাচ্ছিলাম। তবুও কখনো মনে হয়নি খারাপ কিছু ঘটবে।
কতইবা বয়স হয়েছিল আপনার। ৫০-এর সামান্য বেশি। আজ (গতকাল) বিকালেও ফেসবুকে আপনাকে নিয়ে লিখেছি। কত মানুষের লেখা পড়েছি। প্রার্থনা করেছি আপনার জন্য। বিশ্বাস ছিল আপনি ফিরবেন।
সন্ধ্যার শুরুতে খবরটা পেলাম। আপনি নেই। সহকর্মী জীবন আহমেদ ফোন করে জানালেন। ফেসবুক মেসেঞ্জার চালু করতেই দেখলাম আরো বেশ কয়েকজন নিশ্চিত করেছেন। মিজানুর রহমান খানের মৃত্যু মানে তো কেবল একজন ব্যক্তি মানুষের মৃত্যু নয়। বাংলাদেশের সাংবাদিকতার একটি অধ্যায়েরও সমাপ্তি। বিশেষত এ দেশের ইতিহাসের সেরা আইন সাংবাদিকের বিদায়। সাংবাদিকতার সব ক্ষেত্রেই আপনি ছায়া রেখে গেছেন। এমনকি আপনার তোলা একটি ছবি বিপুল আলোচিত হয়েছিল। দুই বাসের মধ্যে রাজীবের আটকে পড়া হাতের ছবি আপনি তুলে এনেছিলেন। মোবাইল জার্নালিজমের মতো বিষয়ে সাফল্য দেখিয়েছেন বারবার। ইতিহাসের নানা অজানা অধ্যায় বের করে এনেছেন। কিন্তু এতসবের পরও মিজানুর রহমান খানের সবচেয়ে বড় সফলতা সম্ভবত আইন সাংবাদিক হিসেবেই।
বাসায় ফেরার সময় কথাটা মনে পড়লো। প্রয়াত সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত একবার আড্ডায় কিছু সাংবাদিককে কথাটা বলেছিলেন হাসির ছলে। আমি যা বলি তোমরা তো তা বুঝো না। তোমাদের বলে কি লাভ। আমার কথা মিজানুর রহমান খান বুঝে। একটি ইংরেজি পত্রিকার রিপোর্টারের নাম উল্লেখ করে বলেছিলেন ও বুঝার চেষ্টা করে। কাকতালীয় কি না জানি না। আজ মিজানুর রহমান খানের বিদায়ের দিনে বিষণ্ন মনে বাসায় ফিরছিলাম। গেটে হঠাৎ দুই বয়স্ক মানুষের কথায় দাঁড়িয়ে গেলাম। শুনলাম, তারা বলছেন বাংলাদেশের সেরা পার্লামেন্টেরিয়ান ছিলেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। আর তেমনি একজন সাংবাদিক ছিলেন মিজানুর রহমান খান। মিজান ভাই আজ বিদায় বেলাতেও আপনাকে ঈর্ষা করতে বড় মন চায়।
বছর ১৫-১৬ আগের কথা। আইন সাংবাদিকতা সবে শুরু করেছি। ছিলাম কিছুটা বেপরোয়া, উদ্ধত। সাংবাদিকতা ভালোবাসতাম জীবনের মতোই। ঠিক সেই সময়ে আপনাকে ভীষণ ঈর্ষা করতাম, ভয়ও পেতাম। নিউজ মিস করাকে ঘৃণা করতাম তখন। বড় কোনো নিউজ মিস হলে নির্ঘুম রাত কাটতো। সেই সময়ে আমাদের প্রায় সবক’টা নির্ঘুম রাতের কারণ ছিলেন আপনি। সকালে ভয়ে ভয়ে প্রথম আলো’তে চোখ রাখতাম। মিজান ভাই কী জানি লিখেছেন।
পরবর্তীতে সুপ্রিম কোর্টের বারান্দায়, মানবজমিন অফিসে কতবার দেখা হয়েছে। প্রায় প্রতিবারই বিস্মিত হতাম ভেবে একটা মানুষ এতো জানে কী করে। শুধু আমাকে নয়, এমন বহু মানুষ, বহু আইনবিদ, সাংবাদিককে আপনি বিস্মিত করেছেন। ভালো বেশকিছু সাংবাদিক দেখেছি। কিন্তু মিজানুর রহমান খান ছিলেন একজনই। বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক তখন হাইকোর্টের বিচারপতি (পরে প্রধান বিচারপতি)। বাংলায় বেশকিছু রায় দিয়েছেন। এখনো কানে বাজে উন্মুক্ত আদালতে বলছেন, এই শব্দটা মিজানুর রহমান খান যেন কী লিখেছেন।
একটি সত্য উল্লেখ করে রাখা ভালো, শেষ দিকে বিশেষত আইন বিষয়ে নানা পারিপার্শ্বিক কারণে আপনি ওতোটা হাত খুলে লিখতে পারেননি।
লেখক মিজানুর রহমান খান ঝড় তুলেছিলেন টকশোতেও। উচ্চস্বরে নিজের কথা বলে গেছেন। তার কোনো দল ছিল না, ক্লাব ছিল না। তিন দশকের সাংবাদিকতা ক্যারিয়ারে সত্য ছাড়া তার কোনো বন্ধু ছিল না। বাংলাবাজার পত্রিকা, যুগান্তর আর প্রথম আলোতে কেটেছে তার ক্যারিয়ারের উজ্জ্বল সময়।
কতজনের মৃত্যুতেই আমরা লিখি অপূরণীয় ক্ষতি। কিন্তু কিছু কিছু মৃত্যু আসলে এতো বড় শূন্যতা তৈরি করে দেয় যা কখনো পূরণ হওয়ার নয়। আরেকজন মিজানুর রহমান খান কখনো আসে কি না কে জানে। বাংলাদেশের সাংবাদিকতা আপনাকে মিস করবে, মিজান ভাই।