বাংলাদেশে করোনাভাইরাস মনিটরিং করেন এমন একটি গবেষক দল পূর্বাভাস দিয়েছিলেন জানুয়ারির শেষ অথবা ফেব্রুয়ারির শুরুতে দেশে করোনা সংক্রমণ সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছতে পারে। জুন মাস পর্যন্ত করোনায় দেশে ১৭ হাজার মানুষের প্রাণহানি হতে পারে। ওই সময়ে ৪৭.৮ শতাংশ মানুষ সংক্রমিত হতে পারেন। নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপ না নিলে সংক্রমণ বেড়ে ৫০.৮ শতাংশও হতে পারে। ওই সময় গড়ে দিনে ১৪ হাজার মানুষ আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সংক্রমণ বাড়লে চিকিৎসার জন্য বাড়তি ৮ হাজার শয্যা লাগতে পারে হাসপাতালে। আর জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে ৪৭.৮ শতাংশ মানুষ সংক্রমিত হতে পারেন। ওই সময় প্রতিদিন আক্রান্ত হতে পারেন ৮ হাজারের মতো মানুষ।
কিন্তু তাদের দেয়া পূর্বাভাসের সঙ্গে বাস্তবে কোনো মিল পাওয়া যাচ্ছে না বলে অনেকে মনে করছেন। সরকারি তথ্যমতে প্রতিদিন সংক্রমিত হচ্ছে ১ হাজারের কম মানুষ। সরকারি হিসাবে শনাক্তের হার ৫-এর ঘরে নেমে এসেছে।
যুক্তরাজ্যর অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে নেতৃত্বে বিশ্বের ৪২টি দেশ করোনা ভাইরাস মডেল তৈরিতে কাজ করে। ওই দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের একটি টিম কাজ করছে। মূলত তারাই এই পূর্বাভাস দিয়েছেন। গত মে মাস থেকে তারা নিয়মিতই করোনা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগকে অবহিত করে আসছেন। সর্বশেষ ১৪ই ডিসেম্বর তারা গবেষণা তথ্য সরকারকে অবহিত করেন। গবেষক দলটি জানিয়েছে, সংক্রমণ কম দেখেই বলা যাবে না কেউ করোনা আক্রান্ত হচ্ছে না। পরীক্ষা কম হওয়ার কারণে শনাক্তের সঠিক হিসাব পাওয়া যাচ্ছে না। পরীক্ষা বাড়ালে মূল হিসাব ও বর্তমান পরিস্থিতি বোঝা যাবে।
পূর্বাভাস নিয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশের করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতির পূর্বাভাস বিষয়ক বিশেষজ্ঞ দলের প্রতিনিধি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের শিক্ষক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ মানবজমিনকে বলেছেন, ধারণা যেটা করা হয়েছিল সেটা বিগত দিনের ডাটা নিয়েই করা হয়েছিল। আমরা যখন করেছিলাম তখন সংক্রমণ বেড়ে যাচ্ছিল। নভেম্বরের শুরু থেকে ১৩ই ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়তি ছিল। কিন্তু পরে দেখা গেল সংক্রমণ কমেছে। তবে বাস্তবে সংক্রমণ কমে গেছে, সেটা বলা যাবে না, পরীক্ষা কমে গেছে। পরীক্ষা কমলে সংক্রমণও কমে যায়। নানা কারণে মানুষ পরীক্ষা করাতে যাচ্ছে না। মানুষের আগ্রহ ও ভয় কমে গেছে। আমরা নিজেদেরও উপসর্গ থাকলেও পরীক্ষা করাতে যাচ্ছি না। তার মানে কি আমাদের করোনা হচ্ছে না? এ ছাড়া করোনায় মৃত্যু কমে নাই। আগে যেমন ছিল এখনো তেমন আছে। তিনি বলেন, পরীক্ষা কমে গেছে তাই সংক্রমণ বাড়ছে না আর সরকারি হিসাব অনুযায়ী আমাদের ধারণাও বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু মানুষের করোনা হচ্ছে। করোনা নিয়েই মানুষ ঘুরছে। আর যখন ধারণা করা হয় কিছু অবস্থার ওপর ভিত্তি করে। সংক্রমণটা সরকারি পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু আমরা বিশ্বাস করি কেইস আছে, তবে মানুষ পরীক্ষা করাচ্ছে না তাই বোঝা যাচ্ছে না। আমরা যে পরিমাণ সংক্রমণ দেখছি বাস্তবে তার চেয়ে অনেক বেশি। তিনি বলেন, আমরা মৃত্যুর রেটটা নিয়েই মডেলটা তৈরি করেছি, সংক্রমণ নিয়ে নয়। মৃত্যু রেটটা এখন আগের মতোই আছে। আগস্টের পর থেকেই আইসিইউ বেড ফাঁকা ছিল। অনেক হাসপাতাল থেকে কোভিড ইউনিট বন্ধ করার পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু নভেম্বর থেকে আবার যখন বাড়তে শুরু করলো তখন আবার আইসিইউ পূর্ণ হয়ে গেল। এখন আবার কমে গেছে।
তিনি বলেন, ওই সময় আমাদের পূর্বাভাস নিয়ে আমাদের একটা টিম হেলথ সার্ভিস ডিভিশনকে প্রেজেন্টেশন করেছিল। তারা কতটুকু নিয়েছে সেটা তাদের বিষয়। তবে এ ধরনের একটি বিষয় যখন মিডিয়াতে যায় তখন সরকারের ক্লোজ মনিটরিংয়ে থাকে পরবর্তী করণীয় নিয়ে। তিনি বলেন, দেশের ভালোর জন্যই এসব মডেলিং করা হয়। এটি সায়েন্টিফিক মডেলিং। আমাদেরকে কেউ এখনো বলেনি আমরা এই মডেলটা কেন করেছি বা কেউ প্রতিবাদও করেনি।
তিনি আরো বলেন, দেশে একটা করোনা রোগী থাকুক সেটা আমরা চাই না। এও চাই না আমরা যে পেডিকশন দিয়েছি সেটা জোর করে বাড়িয়ে দেয়া হোক। এটা শুধু একটা বার্তা ও সতর্কতা। যদি বেড়ে যায় তবে বাড়তি প্রস্তুতি নিতে হবে।
প্রতিনিধি দলের আরেক সদস্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের শিক্ষক ড. শাফিউন শিমুল বলেন, এখনো সময় আছে। জানুয়ারি মাসটা শুরু হয়েছে মাত্র। যুক্তরাজ্যও একই অবস্থা হয়েছিল। সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার নামতে শুরু করেছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই বেড়ে গেছে। সংক্রমণ কমেনি। পরীক্ষা কম হওয়াতে সংক্রমণটা বোঝা যাচ্ছে না। এ ছাড়া আমরা মৃত্যু রেটটাকে সামনে রেখেই গবেষণা করেছিলাম। সংক্রমণ কমলেও এখনো মৃত্যু রেটটা আগের মতোই আছে। যেভাবে সংক্রমণ কম হচ্ছে সেই তুলনায় মৃত্যু রেটটা ১/২ এ নামার কথা ছিল। কিন্তু মৃত্যু রেটটা আগের মতোই আছে। তাই এটা দিয়েই বাস্তবতা বোঝা যাচ্ছে। আমরা মডেলটা করার সময় অক্সফোর্ডের প্রতিনিধিদল আমাদেরকে বলেছিলেন এ ধরনের মডেল তৈরিতে মৃত্যুর রেটটা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ সংক্রমণটা পরীক্ষার ওপর নির্ভর করে। পরীক্ষা যত বেশি হবে সংক্রমণ তত বেশি হবে। এখন মানুষের পরীক্ষার প্রতি আগ্রহ নাই। একেবারে খারাপ অবস্থা না হলে মানুষ পরীক্ষা করতে যায় না। তিনি বলেন, আমরাও চাই সংক্রমণ ও মৃত্যু দুটোই কমে যাক। দেশ থেকে একেবারে করোনা সংক্রমণ চলে যাক। আর আমরা মূলত কিছু ডাটা দিয়েই এই মডেলটা করেছি। সব ধরনের ডাটাও পাইনি। কারণ গবেষণার কাজে লাগে এমন সব ডাটা দেশে সংরক্ষণ করা হয়না। যেটুকু ডাটা পাওয়া গেছে সেটা দিয়ে এবং বিভিন্ন দেশের পরিস্থিতি বিবেচনা করেই মডেলটা তৈরি করা হয়েছে। অনেক সময় এক দেশের সঙ্গে অন্য দেশের পরিস্থিতির মিল হয় না। তাই মডেলে ঘাটতি হতে পারে। তবে অনেক দেশের চেয়ে আমাদের সংক্রমণ ও মৃত্যু কম। এ ছাড়া বাংলাদেশ কেনো, কোনো দেশ থেকেই ভাইরাসটা যাচ্ছে না। এ ছাড়া আমরা বিদেশগামী যাত্রীদের যে করোনা পরীক্ষা হচ্ছে সেই তথ্যটা পাচ্ছি না। সেখানে কম মানুষ পরীক্ষা করাচ্ছে আর কতো মানুষের পজেটিভ রেজাল্ট আসছে। আমরা জানার চেষ্টা করছি হিসাবের বাইরে কতো মানুষ আক্রান্ত ও মারা যাচ্ছে। সেটা হতে পারে রিপোর্টেড মৃত্যুর চেয়ে আন রিপোর্টেড মৃত্যু তিনগুণ। আর আন-রিপোর্টেড সংক্রমণ হতে ৪০/৫০ গুণ। এটা অসম্ভব কিছু না। তাই আরো তথ্য নেয়ার চেষ্টা করছি। সেই তথ্য পেলে আরো আপডেট কিছু বের করা যাবে।
গবেষণার তথ্য জানিয়ে সরকারকে পূর্বাভাস দেয়ার পর দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমার জানা মতে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। আর সরকার তো নিজেই এলার্মিং অবস্থায় আছে। কারণ প্রধানমন্ত্রী তো বলেছেন, দ্বিতীয় ঢেউ আসবে। এজন্য হয়তো আগে থেকেই পদক্ষেপ নেয়া আছে। আগের পূর্বাভাস নিয়ে অটল আছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, সেটাতো আছে। আর আমরা তো পুরাতন ডাটা নিয়ে গবেষণা করেছিলাম। এখন নতুন ডাটা নিয়ে আবার গবেষণা করবো।