হাতে বিয়ারের ক্যান, মুখে সিগারেট। বাতাসে ভেসে আসছে বিদেশি মদের গন্ধ। চারদিকে লেজার লাইটের ঝলকানি। বিটের তালে তালে কাঁপছে বলরুমের চার দেয়াল। হিন্দি, ইংরেজি গানের সঙ্গে স্বল্পবসনা ডিজে গার্লরা নাচছে। তাদের সঙ্গ দিচ্ছে মাতাল তরুণরা। প্রেমিক যুগলরা একে অপরকে জড়িয়ে চুমু খাচ্ছে। আর মধ্যবয়সী নারী-পুরুষরা বিভিন্ন ব্র্যান্ডের মদের বোতল নিয়ে বেসামাল।
এটি ছিল ঢাকার বিমানবন্দরের কাছাকাছি একটি অভিজাত হোটেলের দৃশ্য। এভাবেই তারা ২০২১ সালকে বরণ করে নিয়েছেন। এমন দৃশ্য শুধু ওই হোটেলেই ছিল না। ঢাকার অভিজাত সবক’টি হোটেলে থার্টি ফার্স্ট নাইটকে ঘিরে ছিল নানা আয়োজন। তবে কিছু কিছু হোটেলে ডিজে পার্টি ও মদের ছড়াছড়িতে ছিল ভিন্নতা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী, মডেল, অভিনেতা-অভিনেত্রী, শিল্পী, সংবাদকর্মী ডিজে পার্টিতে উপস্থিত ছিলেন।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকেই ঢাকার অলিগলিতে ছিল উৎসবমুখর পরিবেশ। দু’টি প্রবেশপথ ছাড়া বন্ধ করে দেয়া হয় অভিজাত এলাকা গুলশান-বনানীর সব প্রবেশ পথ। এছাড়াও হাতিরঝিলসহ আরো কয়েকটি এলাকার গুরুত্বপূর্ণ সড়কও বন্ধ ছিল। রাত ১২টা পর্যন্ত ঢাকার প্রধান প্রধান সড়কে যানবাহনের চাপ ছিল অনেক। আধাঘণ্টার যাত্রাপথে সময় ঘণ্টা দুয়েক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাতেও বহিরাগত প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা ছিল। থার্টি ফার্স্ট উদযাপনকে কেন্দ্র করে হোটেলগুলো আগে থেকেই সাঁজানো হয়েছিল। বিভিন্ন ধরনের আয়োজন নিয়ে প্রতিষ্ঠানগুলোর ফেসবুক পেজে প্রচার-প্রচারণাও ছিল লক্ষণীয়। বিভিন্ন ধরনের প্যাকেজের ব্যবস্থা করে আগে থেকে বুকিং ও টিকিটের ব্যবস্থা ছিল।
হোটেলগুলোর তরফ থেকে আগে থেকেই বুকিং দেয়া ছিল দেশসেরা ডিজে গার্ল ও বার সিঙ্গারদের।
রাত ৯টার পরে বিমানবন্দরের খুব কাছাকাছি একটি হোটেলে গিয়ে দেখা যায় হোটেলের নিচে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিপুল পরিমাণ সদস্যের আনাগোনা। বিভিন্ন স্থান থেকে আগত নারী-পুরুষ গাড়ি থেকে নেমে হোটেলে প্রবেশের দু’টি গেটে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। হোটেল কর্তৃপক্ষ চেকিং শেষে তাদেরকে ভেতরে প্রবেশ করাচ্ছিলেন। হোটেলের ১৬ তলায় আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল থার্টি ফার্স্ট উদযাপনের সব আয়োজন। সেখানে গিয়ে দেখা সুইমিং পুলের কাছেই ছোট একটি স্টেজ। তার পাশেই বিক্রি হচ্ছিল বিভিন্ন ব্র্যান্ডের বিদেশি মদ, বিয়ার, কোমল পানীয় ও খাবার। সেখানে টাকা দিয়ে টোকন সংগ্রহ করে খাবার নিতে হয়। ঘড়ির কাঁটায় রাত ১২টা বাজার কয়েক মিনিট আগেই স্টেজে আমন্ত্রণ জানানো হয় রক সিঙ্গার আনিকাকে। আনিকার হ্যাপি নিউ ইয়ার গানের তালে তালে আগত হাজারখানেক মানুষ বরণ করে নেন নতুন বছর। তারপর আনিকার ‘ইটস মাই লাইফ’ ‘সাকি সাকি রুম্বা’ ‘ওয়াকা ওয়াকা’ গানের তালে তালে তরুণ-তরুণীরা ডিজে নাচে মেতেছিল। আনিকার গানের পর্ব শেষে সবাই ভিড় জমায় বলরুমে। সেখানে প্রস্তুত ছিলেন ডিজে তরুণীরা। তাদের একের পর এক গানের সঙ্গে উন্মাতাল তরুণ-তরুণীরা। ডিজে গার্লরা স্টেজ থেকে উড়িয়ে দিচ্ছিলেন উড়ন্ত চুমু। সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত প্রেমিক যুগলরাও একে ওপরকে জড়িয়ে ধরে চুমু দিচ্ছিলেন। যারা একেবারে সঙ্গীছাড়া তাদের টাকার বিনিময়ে সঙ্গ দিয়েছেন ডিজে গার্লরা। এভাবেই রাতভর ডিজে মিথিলা, ডিজে তিশা, ডিজে তৌহিদ ও ঢাকা ড্যান্স ক্লাবের ডিজে তরুণীরা উপস্থিত সবাইকে মাতিয়ে রাখেন। সমাজের নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের উপস্থিতি ছিল সেখানে।
উত্তরা থেকে আগত ব্যবসায়ী সাইমান শাওন বলেন, প্রতি বছরই আমি থার্টি ফার্স্ট নাইটের আয়োজনে এই হোটেলে আসি। করোনাকালে এমন আয়োজন হবে সেটি ভাবিনি। পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি আয়োজন হবে। আমি আমার এক সঙ্গীকে নিয়ে এখানে এসেছি। রাতভর অনেক মজা করেই নতুন বছরকে বরণ করেছি। আশাকরি পুরো বছর ভালো কাটবে। বনানীর মেয়ে সারিকা তাবাসসুম বলেন, আমি আমার বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে এসেছি। এর আগে এরকম আয়োজনে আসা হয়নি। এখানে আসার পর অনেক বন্ধুর দেখা পেয়েছি। সবাই মিলে দারুণ এনজয় করেছি। ধানমণ্ডির একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাকের দেওয়ান বলেন, বন্ধুরা মিলে এসেছি। রাতভর বিয়ার, বিদেশি মদ খেয়ে নতুন বছরের আনন্দ ভাগাভাগি করেছি। ডিজে নাতাশা বলেন, আমি নিজেকে তৈরি করেছি ডিজে গার্ল হিসেবে। বিশেষ বিশেষ আয়োজনে আমি ডিজে ড্যান্স করে থাকি। থার্টি ফার্স্টের নাইটে নিঃসঙ্গ তরুণদের সঙ্গ দেই। রাতভর সঙ্গ দিয়ে ৩০/৪০ হাজার টাকা আয় করি। ডিজে ফারহানা বলেন, আগে থেকেই প্ল্যান করে রাখতে হয়। কোন্ হোটেলে যাবো সেটা সিলেক্ট করে রাখি। থার্টি ফার্স্টের পার্টিতে অনেক যুবক-তরুণ একা আসেন। তাই পার্টিতে তাদের সঙ্গে নাচতে হয়। বিনিময়ে টাকা পাই।
ওই হোটেলটি থেকে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে আরেক তারকা হোটেলেও ছিল ডিজে পার্টি। এই হোটেলের পৃথক তিন স্থানে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। বার, সেলিব্রেশন ও রুফটপে ফায়ারবক্স, মিউজিক্যাল নাইট ও ডিজে। টিকিটের মূল্য ৩ হাজার থেকে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত। একটি টিকিট দিয়ে তিনটি আউটলেটেই প্রবেশ করছিল গেস্টরা। এখানেও রাত ১২টার আগে থেকেই অতিথিরা প্রবেশ করেছে। বিভিন্ন স্থান থেকে আগত ডিজে গার্লদের নাচের সঙ্গে সঙ্গে বেসামাল তরুণ-তরুণীরা নাচ-গানে মেতে বরণ করে নেন ২০২১ সালকে। রাতভর তারা কাটিয়েছে অন্তরঙ্গ মুহূর্ত। ঢাকার অন্যান্য অভিজাত হোটেল ঢাকা ওয়েস্টিন, হোটেল প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও, রেডিসন ব্লু, ওয়েস্টিনসহ আরো বেশকিছু হোটেলে থার্টি ফার্স্টকে ঘিরে ছিল নানা আয়োজন। হোটেল ওয়েস্টিনে ২৩ নম্বর কক্ষে একটি আয়োজন ছিল। যেখানে বাইরের অতিথিরাই অংশ নেয়। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত অনুষ্ঠান ছিল। প্যাকেজ অনুযায়ী হোটেলে ১৬ হাজার টাকার মধ্যে একটি রুম এবং ককটেল পার্টিতে অংশগ্রহণের সুযোগ ছিল। এখানে লাইট ফুড এবং লাইভ বিনোদনের ব্যবস্থা ছিল। হোটেল প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁওয়ে থার্টি ফার্স্ট উপলক্ষে পুল ক্যাফে, ক্যাফে বাজার এবং বারে ছিল বিশেষ আয়োজন। পুল ক্যাফেতে ছিল বারবিকিউ উইথ ডিনার। বুকিং ফি ছিল ৪ হাজার টাকা। সন্ধ্যা ৬টা থেকে মাঝরাত পর্যন্ত ছিল এই আয়োজন। ক্যাফে বাজারে স্পেশাল ডিনার বুকিং ফি ছিল ৪ হাজার ৫শ’ টাকা। রেডিসন ব্লুতে থার্টি ফার্স্টে আপগ্রেড বুফে স্পেশাল ডিনারের আয়োজন করা হয়েছিল। বুকিং ফি ছিল ৬ হাজার ২০০ টাকা। এছাড়া লবিতে বুকিং ফি ২ হাজার ৫০০ টাকা। লবিতে ক্যান্ডি, বেলুন ড্রপ, লাইভ কনসার্টের আয়োজন ছিল।
হোটেলপাড়া ছাড়াও ঢাকার বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দারাও নতুন বছরকে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে বরণ করে নিয়েছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের পক্ষ থেকে থার্টি ফার্স্টকে ঘিরে আগে থেকেই বেশকিছু নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল। অথচ সেই নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করেই নগরবাসী থার্টি ফার্স্ট উদযাপন করেছে। সন্ধ্যা থেকেই পটকা, আতশবাজি, ফানুস উড়ানোর মধ্যে দিয়ে বরণ করা হয়েছে নতুন বছর। বারবিকিউ পার্টি, গান-বাজনা, মদ-বিয়ারের ছড়াছড়ি ছিল ঘরে ঘরে।