করোনার কারণে এবার বই উৎসব হচ্ছে না। তবে সরকার চাচ্ছে যেকোনো উপায়ে প্রতি বছরের মতো বছরের শুরুতে শিক্ষার্থীদের হাতে নতুন বই তুলে দিতে। কিন্তু হঠাৎ রহস্যজনকভাবে কাগজের দাম বৃদ্ধি, নি¤œমানের কাগজ দিয়ে ছাড়পত্র নেয়ার চেষ্টা এবং ইন্সপেকশন এজেন্সিকে সহযোগিতা না করার কারণে এবার বই ছাপার কাজের গতি শ্লথ হয়ে গেছে। এ অবস্থায় বই ছাপা নিয়ে গভীর সঙ্কটে পড়েছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। ফলে গত ১০ বছরের ধারাবাহিকতায় ১ জানুয়ারি শিক্ষার্থীদের হাতে যে বিনামূল্যের বই তুলে দেয়া হতো তার ছন্দপতনের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ২০১০ সাল থেকে সরকার বছরের প্রথম দিন তথা ১ জানুয়ারি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের (প্রথম-দশম) শিক্ষার্থীদের হাতে বিনামূল্যের বই তুলে দিয়ে আসছে। এ দিনটিকে সরকার পাঠ্যপুস্তক উৎসব বা বই উৎসব হিসেবেই উদযাপন করে আসছে। করোনার কারণে এবার বই উৎসব হচ্ছে না। তবে ভিন্ন উপায়ে শিক্ষার্থীদের হাতে এই বই তুলে দিয়ে গত ১০ বছরের ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে চায় সরকার। কিন্তু নানামুখী সঙ্কটে এনসিটিবির সময়মতো বই ছাপা নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হওয়ায় গত ১০ বছরের রেকর্ড ভঙ্গ হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে বইয়ের কভারের ভেতরের অংশে জাতীয় ব্যক্তিত্বদের ছবি সংযুক্ত ও মানসম্মত বই দেয়ার জন্য সরকারের সর্বোচ্চ মহলের নির্দেশনা রয়েছে। সে জন্য বইয়ের মান ঠিক রাখতে চলতি বছর ‘বাস্টিং ফ্যাক্টর’ (বইয়ের স্থায়িত্ব) ১৪ থেকে ১৬ করা হয়েছে। এতে বছরের মাঝামাঝি সময় বইয়ে ভাঁজ কিংবা ছিঁড়ে যাবে না। জিএসএম মাধ্যমিকে ৬০ শতাংশ এবং প্রাথমিক ৮০ ঠিক রাখতে তদারকি পদ্ধতিসহ বেশ কিছু নীতিতে পরিবর্তন আনা হয়েছে। এর মধ্যে অন্যান্য বছর পরিদর্শন প্রতিষ্ঠান কাগজ ও ছাপা হওয়া বই দৈবচয়ন পদ্ধতিতে যাচাই করে কিন্তু এবার পরিদর্শন টিম কাগজের প্রতিটি রোল থেকে স্যাম্পল বই সংগ্রহ করবে। এ ছাড়া প্রতিটি প্রেসে একজন করে লোক নিয়োগ দেয়া, ভ্রাম্যমাণ প্রতিনিধি রাখা, কাগজের জিএসএমের ক্ষেত্রে ২ শতাংশ প্লাস মাইনাস যত সম্ভব এড়িয়ে নির্ধারিত মান ঠিক রাখা ইত্যাদি। এটা করতে পারলে চলতি বছর নিম্নমানের কোনো কাগজে বই ছাপার সুযোগ নেই বলে মনে করেন কর্মকর্তারা। এটা নিশ্চিত করতে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে দু’টি পরিদর্শন প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। কিন্তু দু-একটি মুদ্রণকারী শুরু থেকেই নি¤œমানের কাগজ দিয়ে বই ছাপানোর চেষ্টা করছে। এনসিটিবি ও এজেন্সি কঠোর মনিটরিংয়ে তারা ক্ষিপ্ত হয়ে এজেন্সিকে নানা ধরনের হুমকি ধমকি দিচ্ছে। এতে সার্বিক বইয়ের মান রক্ষায় এনসিটিবির পক্ষে কঠিন হয়ে পড়েছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্টরা।
জানা গেছে, গত ২৬ নভেম্বর অগ্রণী প্রিন্টিং প্রেসের ১২০ টন কাগজ বাতিল করে মাধ্যমিকের পরিদর্শন এজেন্সি ইনডিপেনডেন্ট। প্রতিষ্ঠানটি ৬০ জিএসএমের জায়গায় ৫৫, বাস্টিং ফ্যাক্টর ১৬ জায়গায় ১৪ দশমিক ৮৮ পাওয়ার পর তা বাতিল করে। নিয়ম অনুযায়ী ওই প্রতিষ্ঠান নি¤œমানের এসব কাগজ প্রেস থেকে সরিয়ে ফেলার কথা কিন্তু তারা তা না সরিয়ে সেই ১১০ টন কাগজ ২ ডিসেম্বর আবার মান যাচাইয়ের জন্য চিঠি দেয়। ইন্সপেকশন এজেন্সি বিভিন্ন রোল থেকে কাগজ সংগ্রহ করার পর ওই প্রতিষ্ঠানের লোকজন নিজেদের মেশিনে পরীক্ষা করে দেখেন এগুলো জিএসএম ৫৫। এরপর এসব কাগজ নেয়া যাবে না এবং তাদের দেয়া কাগজ পরীক্ষা করে রিপোর্ট দেয়ার জন্য চাপাচাপি করে। কিন্তু ওই এজেন্সির লোকজন তা না নিয়ে চলে আসে। এরপর ওই প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী নানা জায়গা থেকে হুমকি ধমকি দিতে থাকে। ভয়ে এজেন্সি এনসিটিবির কাছে লিখিত অভিযোগ করে বলেছে, আমাদের নিরাপত্তা না দিলে এ প্রতিষ্ঠানের কাজ কাগজের মান যাচাই করা সম্ভব না। এ দিকে এ প্রতিষ্ঠানটি অনুমতি না নিয়েই নি¤œমানের কাগজে প্রাথমিক স্তরের ৬০ হাজার বই ছাপানোর পর তা উপজেলা পর্যায়ে পৌঁছানোর অনুমতি মিলেনি। বইগুলো কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত হলেও এনসিটিবির নীরবতায় তা কাটা হচ্ছে না।
এ ব্যাপারে এনসিটিবির চেয়ারম্যান প্রফেসর নারায়ণ চন্দ্র সাহা বলেন, মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান যত শক্তিশালী হোক না কেন, কাউকে কোনো ছাড় না দেয়ার জন্য মনিটরিং টিম ও এজেন্সিকে বলা হয়েছে। ইনডিপেনডেন্ট এজেন্সির প্রসঙ্গে তিনি বলেন, অভিযোগটি ফাইলে উঠানো হয়েছে। এ ব্যাপারে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।
হঠাৎই কাগজের দাম বৃদ্ধি : এনসিটিবি ও মুদ্রণ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চলতি বছরের প্রাক্কলিত দরের চেয়ে গড়ে ৩০ থেকে ৪৭ শতাংশ কম দামে কাজ নিয়েছে মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলো। করোনার কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে কাগজের দাম কমে যাওয়ার পর তারা এ সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু বিনামূল্যের বই ছাপার কাজ শুরু হওয়ার পরই দাম বাড়তে থাকে। সেপ্টেম্বর মাসে ৬০ ডিএসএম কাগজের দাম ছিল ৪২ থেকে ৪৪ হাজার। সেটি ৬ ডিসেম্বর রোববার বাজারদর ৫৯ হাজার ৫০০ টাকা। শুধু তাই নয়, এ দামেও কাগজ পাচ্ছেন না মুদ্রণকারীরা। ওই সময় মুদ্রণকারীরা যেসব মিলের সাথে চুুক্তি করেছিলেন তারা এখন কাগজ দিচ্ছে না। বর্তমানে আম্বার, মেঘনা, বেইজ, রশিদ ও আল নূর পেপার মিল কাগজ সরবরাহ করলেও বেশির ভাগ পেপার মিলের কাগজ বাতিল হচ্ছে। এর অন্যতম কারণ ‘বাস্টিং ফ্যাক্টর’ ১৪ থেকে ১৬ করা। ফলে গত বছর যে মানের কাগজ অনুমোদন পেত এবার সেই মানের কাগজ বাতিল হচ্ছে। এর মধ্যে আল নূরের কাগজ সবচেয়ে বেশি বাতিল হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে পাল্পের (মণ্ড) দাম বেড়ে যাওয়ায় কাগজ উৎপাদনের সবচেয়ে বেশি সক্ষম বসুন্ধরা এবং টি কে পেপার মিল উৎপাদন বন্ধ রেখেছে। এতে বাজারে কাগজের এক ধরনের কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি হয়েছে।
কাগজের এমন সঙ্কটের কারণে গত বুধবার জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবু হেনা মো: রহমাতুল মুনিমের সাথে মুদ্রণ শিল্প সমিতির নেতার সাক্ষাৎ করে সঙ্কটের চিত্র তুলে ধরেন এবং আপৎকালীন এ খাতের কাগজ আমদানিতে শুল্কমুক্তের অনুমতি চান। এনবিআর চেয়ারম্যান একজন সদস্যকে গার্মেন্টস শিল্পের বন্ড আমদানির মতো যাতে কিছু না হয় সেদিকে লক্ষ্য রেখে একটি প্রতিবেদন দিতে বলেন। সে মোতাবেক একটি সিদ্ধান্ত এনবিআর দিবে।
মুদ্রণ ব্যবসায়ীরা বলছেন, কোনো কারণ ছাড়াই পেপার মিলগুলো দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী তারা কাগজ দিচ্ছে না। কোমলমতি শিক্ষার্থীদের হাতে সময়মতো বই তুলে দিতে এ বিষয়ে সরকারের সর্বোচ্চ মহলের হস্তক্ষেপ দরকার।
মুদ্রণ শিল্প সমিতির সাবেক সভাপতি ও বিপণন সমিতির সভাপতি তোফায়েল খান বলেন, এ সঙ্কটের পিছনে দায়ী পেপার মিলগুলো। তারা চুুক্তি অনুযায়ী কাগজ দিচ্ছে না। এ ছাড়া বড় পেপার মিলগুলো কাগজ উৎপাদন বন্ধ রেখেছে। সঙ্কট নিরসনে এনবিআর চেয়ারম্যান আশ্বাস দিয়েছেন, শিগগিরই এনসিটিবির সাথে বৈঠক করব। সরকারের হস্তক্ষেপ ছাড়া এ সঙ্কট কাটানো সম্ভব না। এ ব্যাপারে এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র সাহা বলেন, কাগজ নিয়ে আমাদের তেমন কিছু করা না থাকার পরও কাগজের সঙ্কট কাটাতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি।
বই ছাপায় শ্লথ গতি : আগামী (২০২১ সাল) শিক্ষাবর্ষের জন্য মোট সাড়ে ৩৪ কোটি বই ছাপানো হবে। এর মধ্যে মাধ্যমিকের বই ২৪ কোটি ৩৩ লাখ ৮৪ হাজার প্রাথমিক স্তরে ১০ কোটি ৫৪ লাখ, যার মধ্যে গতকাল পর্যন্ত মাধ্যমিক স্তরের বই ছাপানো হয়েছে প্রায় ৯ কোটি। যার মধ্যে পিডিআই (প্রি ইন্সপেকশন অব ডেলিভারি) পেয়েছে ৩ কোটি ৪৫ লাখ ৭৩ হাজার কপি। এ স্তরে সর্বমোট কাগজ লাগবে ৪০ হাজার মেট্রিন টন। এর মধ্যে গতকাল পর্যন্ত ছাড়পত্র পেয়েছে ১৭ হাজার মেট্রিক টন। নি¤œমানের কাগজ হওয়ায় বাতিল হয়েছে প্রায় তিন শ’ মেট্রিক টন। অন্য দিকে প্রাথমিক স্তরে বই ছাপা হয়েছে প্রায় ৬ কোটি যার মধ্যে মাত্র অর্ধেক উপজেলায় পাঠানো হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এখনই এ কাজের গতি না বাড়াতে পারলে ১ জানুয়ারি অর্ধেকের বেশি শিক্ষার্থীর হাতে বই তুলে দেয়া সম্ভব হবে না। কারণ নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরু হতে আর মাত্র ২৩ দিন বাকি। অন্যান্য বছর এ সময় প্রায় ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশ বই ছাপার কাজ শেষ হয়ে যায়।