গাজীপুর: রাস্তায় কোন দূর্ঘটনা ঘটলে কতিপয় সহকর্মী পাওয়া যায় আপোষের জন্য। থানায় কেউ কাঁদতে বা হাসতে গেলেও সাংবাদিকের দেখা মেলে।
ইতিহাস বলে, কখনো পুলিশ পরিচয়েও সাংবাদিকতা হয়, ভুয়া ভ্রাম্যমান আদালত সেজেও খবর খোঁজেন কেউ কেউ। হাতকড়া লাগিয়ে কিছুদূর নিয়েও যায় বিপথগামী কতিপয় সাংবাদিক নামধারী প্রাণীরা। এখন পান থেকে চুন খসলেই সাংবাদিক হাজির হয়। কিন্তু আগুনে পুঁড়ে একই সাথে যখন ডজনখানেক ক্ষুধার্থ মানুষের কংকাল তৈরী হয়, তখন সত্য বলতে আনমনা থাকি অনেকে!
ধর্ষণের শিকার কোন মা বা বোনের আর্তনাদ যখন কালার গ্লাসের গাড়িতে উচ্চস্বরে বাজানো গানের তালে মিলিয়ে যায়, নারীর সম্ভ্রম মৃত্যুর বীভৎস আর্তচিৎসার ধর্ষকদের নগ্নআনন্দকে উল্লাসে বানিয়ে ফানুস উড়ায় তখন কতিপয় আমরা অন্যমনস্ক থাকি। সন্তান হারা মায়ের আর্তচিৎকার যখন আমার মাকে আক্রান্ত করে না, তখনও সন্তান কোন সাংবাদিক সন্তান বা জাতির বিবেক সন্তান, দাবী আমার।
ঘরে দেখা স্ত্রী মা বা সন্তানের ভালোবাসার ভরা চোখ-মুখ যখন মনে থাকে না আমাদের। কতিপয় আমরা যখন মানুষের রক্ত বা সম্ভ্রম বিক্রির টাকায় কাফনের কাপড় কিনতে চাই, দামী গাড়ির গ্লাস পরিস্কারের ঝাড়ু কিনতে চাই, তখনও সন্তান থাকি আমরা। মানুষ নয় এমন কোন নরপশু যখন মানুষ পরিচয়ে লাশকাটা ঘরে একের পর এক মৃতদহকে ধর্ষণ করে, তখনও মানুষ দাবী করতে ঘৃনা হয় না আমাদের। কারণ আমরা মানুষ হয়েই থাকব জোর করে হলেও।
সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কিছু ঘটনা ভূমিকম্পের ধ্বংসস্তুপে হ্রদয়কে খুঁজতে তাড়া করে। বিয়ে বাড়ির পাশে কোন গরীব মানুষ খুন হলে কতিপয় আমরা বিয়ে বাড়ির আনন্দে ভেসে থাকি, লাশের খবর নিতে মন চায় না। বড় লোকের বাড়ির স্বাচ্ছন্দকে ফুল-ঢালা দিয়ে ভরে দিতে, বড় বাড়ির রাস্তা পরিস্কার করতে গিয়ে কুঁড়েঘরে ঘুমিয়ে থাকা পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী পরিবারকে রাতের আঁধারে ভিটেমাটি ছাড়া করার খবর আমরা অনেকেই দেখতে পাই না।
নিজের আয়নায় দেখতে সময় পাচ্ছি না, আমি কি ছিলাম, কি আছি। কফিন দেখেও মনে করছি না, কি হতে হবে। তাই মানুষকে মানুষ মনে করছি না আমরা। কেমন জানি অন্য রকম হয়ে যাচ্ছে সব। সৃষ্টিকর্তার দেয়া দেখভাল করার দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়েছি, পাঁয়ে হেটে যাওয়ার সময় প্রাইভেট গাড়ির দিকে না তাকানো আমি এখন প্রাইভেট গাড়িতে চলছি, কিন্তু মনেই করতে চাই না, আমিও পথচারী ছিলাম। ছিঃ ঘৃনা করতে চাই, আমি আমাকে।
গাজীপুর জেলার তথ্য বলছে, গাজীপুরে কোচিং সেন্টারে একজন ছাত্রী ধর্ষণের শিকার হলেন কোচিং সেন্টারের মালিক দ্বারা। খবরটি আলোর মুখ দেখেনি। কাপাসিয়ায় থানার একটি নারী নির্যাতন মামলার ইতিহাস বলছে, কয়েক মাস আগে নবম শ্রেনীর এক ছাত্রী অপহরণের প্রায় একমাস পর উদ্ধার হয়েছে। কোন আসামী গ্রেফতার হয়নি আজো কিন্তু আসামীরা ভিকটিমের বাড়ির চারপাশে ঘুরা ফেরা করছেন। নিরাপত্তা আতঙ্কে মেয়েটির বাবা বিভিন্ন স্থানে ঘুরছেন বাঁচার জন্য। এই খবরটিও আলো মুখ দেখেনি।
শ্রীপুরে পোষাককর্মী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। থানায় মামলা হয়েছে। কিন্তু ১৬ দিনে এক দিনও আসামী ধরতে যায়নি পুলিশ। বরং শুনা যাচ্ছে, কোন আসামী রীতিমত অফিসও করছেন। আসামী পক্ষ এতই প্রভাবশালী যে, ভিকটিমকে ভাড়া বাসা থেকে চুলের মুঠোয় ধরে বের করে দিয়েছেন। ছোট ছোট চুল রাখা কিছু মানুষ প্রায়ই ধর্ষণের শিকার মেয়েটির বাসার সামনে মাইক্রোবাস নিয়ে জোরে হরণ বাজিয়ে মেয়েকে বাইরে এনে মামলা প্রত্যাহার করতে বলে। কলেক শিক্ষক ধর্ষণের শিকার মেয়েকে ফোনে ও কলেজে ডেকে নিয়ে আপোষের জন্য চাপ দেয়। বাধ্য হয়ে ভিকটিম থানায় জিডি করতে গেলে পুলিশ জিডিও গ্রহন করতে অমত অমত ভাব করেন। আসামী পক্ষকে আশ্রয় দেয়ার প্রধান কোন ব্যক্তি পুলিশের উপর মহলে দায়িত্ব পালন করছেন বলে কথাও বাজারে আছে। ফলে পুলিশ নীরব দর্শকের চিরায়ত ভুমিকায় চলে যেতে চায়। এই ঘটনায় কতিপয় সাংবাদিক ভিকটিমের বাড়িতে গিয়ে বা রাস্তা ঘাটে বা ফোনে মামলাটি আপোষের জন্য চাপ দেয়। কিন্তু খবরটি পত্রিকায় দেয় না।
গতকাল বুধবার গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনারের নির্দেশে সদর থানার ওসির মাধ্যমে উদ্ধার হল, ২৮ বছর বয়সের সেলিম নামের একজন ব্যক্তি। ৪১ মাস এমপি নেতা ও সাংবাদিকদের দ্বারে দ্বারে ঘুরেও কোন সহায়তা পাননি গরীব সেলিমের অসহায় মা। সুস্থ থাকলেও ৪১ মাস একটি রিহ্যাব সেন্টারে আটকে থাকার পর প্রায় পাগল হয়ে যাওয়া ওই সন্তানকে তার মায়ের কোলে ফিরয়ে দিলেন ওসি। বাড়ি যাওয়া ভাড়া না থাকায় আমরা দিলাম ৫শ টাকা। মানবিক কাজের এই খবরটিও আলোর কাছে নেই। রিহ্যাব সেন্টার পিটিয়ে খুন করা এএসপি আনিসের পরিণতি হলেও হয়ত সেলিমের ঘটনা আলোর মুখ নাও দেখতে পারত, কারণ সেলিম তো আর এ এস পি আনিস বা আনিসের মত কেউ না।
চমৎকার সাংবাদিকতা। কোন ভিক্ষুক যখন সরকারী জায়গায় কলাপাতার ঘরের পাশে তালপাতার বাথরুম তৈরী করে, তখনও আমার প্রিয় কয়েকজন সহকর্মী খবর নিতে যায়। কয়েক বছর বন্ধ থাকা নষ্ট স’মিলের খবরও আমরা দিতে বার বার যাতায়াত করি। কারো পস্রাব হলুদ হলেও খবর দিতে চেষ্টা করি কিন্তু গরীব লাশের খবর দিতে মন চায় না, আমার মত অনেকের।
মানুষ এখনো আশা করে মনে রাখেন. সাংবাদিকেরা জাতির বিবেক। এই আশাকে বাঁচিয়ে রাখতে কাজ করতেই হবে। নিরাশ জাতি ধ্বংসের সংকেত পায়। তাই আমরা আশাবাদী, সাংবাদিকেরা জাতির বিবেকের মর্যাদা রক্ষা করবেই।