পরমাণু বিস্তার রোধকরণ এবং পারমাণবিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বলতে পারি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি বিশ্বাসযোগ্য কণ্ঠস্বর হতে পারবে না, যদি সে তার চলমান নেগোসিয়েশনকে পরিত্যক্ত করে। ইরান থেকে উত্তর কোরিয়া, রাশিয়া থেকে সৌদি আরব, ট্রাম্প এমন সব কাণ্ড করেছেন যা পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতার পথ আরো প্রশস্ত করেছে। একটি নতুন পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। এমনকি
পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের সম্ভাবনা আগের থেকে বেড়ে গেছে। প্রেসিডেন্ট হিসেবে একটি নতুন যুগের জন্য পরমাণু অস্ত্র নিয়ন্ত্রণে আমাদের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করবো। ওবামা প্রশাসন ঐতিহাসিক ইরান পারমাণবিক চুক্তির মধ্য দিয়ে এমন একটা সমঝোতায় পৌঁছেছিল, যা ইরানকে একটি পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা থেকে নিবৃত্ত করেছিল। ইরানকে ব্লক করে দিয়েছিল। কিন্তু ট্রাম্প তাড়াহুড়া করে সেই সমঝোতাকে বাইরে ঠেলে দেন। এবং ইরানকে তার পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে নতুন করে এগিয়ে যেতে উৎসাহিত করেন।
এমনকি তাকে উস্কানি দেন, ফলে ওই অঞ্চলে আরেকটি ধ্বংসাত্মক যুদ্ধের ঝুঁকির সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেন। ইরানীয় শাসন সম্পর্কে আমার মধ্যে কোনো মায়াজাল নেই। কারণ ইরানি শাসন ও তার শাসকদের অস্থিতিশীল আচরণ গোটা মধ্যপ্রাচ্যকে অস্থির করে রেখেছে। তারা তাদের দেশের অভ্যন্তরে প্রতিবাদকারীদের ওপর নিষ্ঠুর দমন-পীড়ন চালিয়ে যাচ্ছে এবং অন্যায়ভাবে মার্কিনিদের বন্দি করে রেখেছে। কিন্তু আমাদের স্বার্থের প্রতি ইরান যে হুমকি তৈরি করেছে, তা মোকাবিলা করার জন্য একটি চৌকস পথ রয়েছে। আরেকটি রয়েছে আত্মঘাতী পন্থা। কিন্তু ট্রাম্প শেষেরটাই বেছে নেন।
কাশেম সুলাইমানি ইরানের কুদস ফোর্সের অধিনায়ক। তার সাম্প্রতিক হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে এক ভয়ঙ্কর কুশীলবকে দৃশ্যপট থেকে সরিয়ে দেয়া সম্ভব হয়েছে। কিন্তু তা একইসঙ্গে ওই অঞ্চলে একটা সহিংস চক্রকে দীর্ঘস্থায়ী হতেও সাহায্য করেছে। এবং এটা তেহরানকে পারমাণবিক চুক্তির আওতা থেকে সরে পারমাণবিক সীমা অতিক্রমে উৎসাহী করেছে। কিন্তু তেহরানকে অবশ্যই কঠোরভাবে সমঝোতা চুক্তিতে ফিরে যেতে হবে। যদি তারা তাতে রাজি হয়, আমি আগের চুক্তিতে পুনরায় যোগ দেবো। এবং কূটনীতির ওপরে নতুন করে জোর দিবো। যাতে আমরা আমাদের মিত্রদের সঙ্গে নিয়ে বিষয়টিকে শক্তিশালী এবং সম্প্রসারিত করতে পারি। কিন্তু তার লক্ষ্য হবে আরো অধিকতর কার্যকরতার সঙ্গে ইরানকে অন্যান্য অস্থিতিশীলতা বিষয়ক কার্যক্রম থেকে নিবৃত্ত করতে বাধ্য করা।
উত্তর কোরিয়ার ক্ষেত্রে বলবো, আমি আমাদের নেগোশিয়েটর দলকে আরো বেশি সক্ষম করে গড়ে তুলবো। এবং ঝাঁপিয়ে পড়ে একটি টেকসই সমন্বিত ক্যাম্পেইন শুরু করবো। আমাদের মিত্র এবং অন্যদের সঙ্গে নিয়ে এমনকি তাদের সঙ্গে নেবো, যাদের লক্ষ্য হবে একটি অপারমাণবিক উত্তর কোরিয়ার অবস্থানকে নিশ্চিত করা। আমি একই সঙ্গে একটি নতুন স্টার্ট ট্রিটি সম্প্রসারণে সচেষ্ট হবো। কারণ একটি নয়া চুক্তি হবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়ার মধ্যকার স্ট্র্যাটেজিক স্থিতিশীলতার রক্ষাকবচ। আর সেটাই হবে নয়া অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার আসল ভিত্তি। একইসঙ্গে আমি অন্যান্য আনুষঙ্গিক পদক্ষেপ নিবো, যাতে করে পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণে আমাদের অঙ্গীকার স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ২০১৭ সালে আমি যেমনটা বলেছি, আমি বিশ্বাস করি যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাতে যত পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে, তার একমাত্র উদ্দেশ্য হবে, কারো কবল থেকে নিজেকে রক্ষা করা এবং যদি প্রয়োজন হয়, তাহলে একটি পারমাণবিক হামলার বিরুদ্ধে পাল্টা ব্যবস্থা নেয়া। প্রেসিডেন্ট হিসেবে সেই বিশ্বাসকে কার্যে পরিণত করার ক্ষেত্রে আমি পদক্ষেপ নিবো এবং সেটা করতে গিয়ে আমি অবশ্যই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনী এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদের পরামর্শ নেবো।
আর যখন ভবিষ্যতের প্রযুক্তি নিয়ে কথা উঠবে, যেমন ফাইভ-জি এবং আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, তখন আমরা দেখি অন্যান্য রাষ্ট্র তাদের জাতীয় সম্পদসমূহ এই খাতে ব্যবহার করছে। যাতে তারা এসব খাতে ক্রেতাদের ওপর প্রাধান্য বিস্তার করতে পারে এবং এগুলো কীভাবে ব্যবহৃত হবে তা তারা নির্ধারণ করতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উচিত হবে এর থেকেও বেশি কিছু নিশ্চিত করা। প্রথমে নিশ্চিত করতে হবে এসব প্রযুক্তিসমূহ গণতন্ত্রের বৃহত্তর বিকাশে ও সমৃদ্ধির কাজে ব্যবহার করতে হবে। প্রযুক্তি এবং তার সুবিধাসমূহকে কোনোভাবেই ব্যক্তি বা বাকস্বাধীনতাকে দেশে এবং বিদেশে নিয়ন্ত্রণ করার কাজে লাগানো যাবে না। উদাহরণ হিসেবে, বাইডেন প্রশাসন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক মিত্রদের সঙ্গে যৌথভাবে যুক্ত হবে যাতে তারা বেসরকারি খাতের নেতৃত্বাধীন ফাইভ-জি নেটওয়ার্ককে এমনভাবে নিরাপদ করে গড়ে তোলা নিশ্চিত করে, যাতে এমন নেটওয়ার্কের আওতায় থেকে কোন সম্প্রদায়, তা গ্রামীণ কিংবা স্বল্প আয়ের মানুষ হোক, তারা যাতে বাদ না পড়ে। যেহেতু নতুন প্রযুক্তিসমূহ আমাদের অর্থনীতি এবং সমাজকে নতুন করে গঠন করবে, তখন অবশ্যই আমাদের নিশ্চিত করতে হবে যে, এই অগ্রগতির চালিকাশক্তিসমূহ আইন এবং এথিক্স দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে। যেমনটা আমরা এর আগের ইতিহাসে প্রযুক্তিগত টার্নিং পয়েন্টে ব্যবহার করেছি। এবং উপর থেকে নিচ পর্যন্ত একটা প্রতিযোগিতা এড়িয়ে গিয়েছি। অথচ আজ ডিজিটাল যুগের নিয়ম কানুন লিখে চলেছে চীন এবং রাশিয়া। সুতরাং এটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সময়, যখন একটি প্রযুক্তিগত ভবিষ্যৎকে এমনভাবে বিনির্মাণ করা, যা গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থাকে উন্নত করতে সক্ষম করে তুলবে এবং সমৃদ্ধিকে ভাগাভাগি করে নেবে। এবং অবশ্যই তা ব্যাপক অর্থে।
এসবই উচ্চাকাঙ্ক্ষী লক্ষ্যমাত্রা এবং এর কোনোটাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার সহযোগী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর সমন্বয়ে নেতৃত্ব দেয়া ছাড়া অর্জন করা সম্ভব নয়, এটা সম্ভবপর হতে পারে না। আমরা অভ্যন্তরীণভাবে এবং বহিস্থভাবে নানা ধরনের প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়ে চলছি। অনেকেই আশা করছেন, তারা আমাদের সমাজের বিভাজন, গণতন্ত্রকে খাটো করা থেকে ফায়দা তুলবেন। তারা দেখছেন আমরা আমাদের মিত্র জোটগুলো ভেঙে দিচ্ছি এবং এইসব করে আমরা এমন একটি আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা গড়ছি, যেখানে গায়ের জোরটাই অধিকার নির্দিষ্ট করে দিচ্ছে। এইসব হুমকির উত্তর হলো, অধিকতর উন্মুক্ততা, কোনোভাবেই কম করে নয়। চাই অধিকতর বন্ধুত্ব। অধিকতর বেশি সহযোগিতা ও জোটবদ্ধতা। আর অধিকতর গণতন্ত্র।
নেতৃত্বের জন্য প্রস্তুত: পুতিন নিজেকেই বলতে চাইছেন এবং অন্যদের বিশ্বাস করাতে চাইছেন যে, উদারনৈতিক ধারণা ‘সেকেলে’ হয়ে পড়েছে। কিন্তু তিনি এটা করছেন, কারণ তিনি ভীত হয়ে পড়েছেন উদারনৈতিকতার শক্তির কাছে। বিশ্বে এমন কোনো সামরিক শক্তি নেই, যারা ব্যক্তি স্বাধীনতাকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো বিস্তার করতে দিতে পারে। যেমনটা অবাধে সম্ভব শুধু ব্যক্তি থেকে ব্যক্তি, সীমান্ত থেকে সীমান্তে, এক ভাষা থেকে অন্য ভিনদেশি ভাষায়, সংস্কৃতি থেকে সংস্কৃতির মেলবন্ধনে এবং কমিউনিটি থেকে সাধারণ জনগণের মধ্যে, কর্মীদের মধ্যে, সংগঠকদের মধ্যে, নিজেদের মধ্যে ছড়াতে। এমনটা কোনো সামরিক শক্তি পারে না।
আমাদেরকে অবশ্যই পুনর্বার সেই জনগণের ক্ষমতায় বিশ্বাসী হতে হবে। একটি মুক্ত বিশ্বকে নেতৃত্ব দিতে হবে। আজকের বিশ্ব যেসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে, তাকে মোকাবিলায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকেই নেতৃত্ব দিতে হবে। অন্য কোনো দেশের সেই সামর্থ্য নেই। কারণ বিশ্বের অন্য কোনো রাষ্ট্র জনগণের সেই শক্তির ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়নি। আমাদের অবশ্যই স্বাধীনতা এবং গণতন্ত্রের চ্যাম্পিয়ন হতে হবে। আমাদের বিশ্বাসযোগ্যতা ফিরিয়ে আনতে হবে। প্রচণ্ড আশাবাদী হতে হবে। আমাদের ভবিষ্যৎ বাধাহীন আশাবাদ এবং দৃঢ় সংকল্প দিয়ে তৈরি করতে হবে।
ফরেন পলিসি (মার্চ-এপ্রিল ২০২০ সংখ্যা) থেকে নেয়া।