নৌবাহিনী কর্মকর্তাকে মারধরের জেরে কারাগারে যান সংসদ সদস্য হাজী মোহাম্মদ সেলিমের ছেলে ইরফান সেলিম। এরপরই একের পর এক বেরিয়ে আসে নানা অপরাধের তথ্য। সংসদ সদস্য হাজী সেলিমের দখল অনিয়মের তথ্যও প্রকাশ্যে আসে। ইরফান সেলিমকে গ্রেপ্তারের সময় পুরান ঢাকার মৌলভীবাজারে অগ্রণী ব্যাংকের একটি জমি হাজী সেলিমের দখল থেকে উদ্ধার করেন ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। উদ্ধারের কিছুদিন যেতে না যেতেই সেই জমি আবার দখলে নিয়েছেন হাজী সেলিম। সেখানে স্ত্রীর নামে সাইনবোর্ড টানিয়েছেন তিনি। ওই জমিতে অগ্রণী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ভবন নির্মাণের জন্য নির্মাণ সামগ্রী নিয়ে রেখেছিল। পুনরায় দখল করে ওই সামগ্রীও সরিয়ে ফেলেছে হাজী সেলিমের লোকজন।
আবার দখল হলেও ওই জমি নিয়ে কথা বলতেও ভয় পাচ্ছেন ব্যাংক কর্মকর্তারা। তারা সরকারি এই সম্পত্তি উদ্ধারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহযোগিতা চাইলেও, কোনো ধরনের সহযোগিতা পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ করেছেন।
২০ শতকের এই জমিটি গত কয়েক মাস ধরে সংসদ সদস্য হাজী মোহাম্মদ সেলিম দখল করে রেখেছিলেন। যার বাজার মূল্য শত কোটি টাকা। জমিটি নতুন করে দখলে নেয়ার পর বসিয়েছেন পাহারা। পর্যায়ক্রমে হাজী সেলিমের লোকজন পাহারা দিচ্ছেন। ফলে ব্যাংকের কর্মকর্তা কর্মচারীরা ওই জমির আশেপাশে যেতে পারছেন না।
দখল হওয়া জায়গাটি অগ্রণী ব্যাংক সংশ্লিষ্টরা পুনরুদ্ধার করে নির্মাণ কাজ শুরু করেছিলেন। সেই কাজের মালামাল নেই ওখানে। জায়গাটি পুনরুদ্ধার হওয়ার পর নির্মাণ কাজ, নির্মাণ সামগ্রীর বেশ কয়েকটি ছবি রয়েছে এই প্রতিবেদকের হাতে। কিন্তু ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, এখন এর কিছুই নেই সেখানে। গত পনেরো দিন ধরে কাজও বন্ধ রয়েছে। ব্যাংকের নির্মাণ সামগ্রী সরিয়ে জমিতে স্ত্রীর মালিকানা দাবির সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দিয়েছেন ওই এমপি। স্থানীয় ব্যবসায়ী আরিফ হোসেন বলেন, জন্মের পর থেকেই অগ্রণী ব্যাংকের এই শাখা আমরা এখানে দেখে আসছি। কিন্তু কার জায়গা আমার জানা নেই। এখন আবার শুনছি এটা হাজী সাহেবের জায়গা। তারা নাকি দখল করেছে এটা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ব্যাংকের ওই শাখার এক কর্মকর্তা বলেন, ২০০৩ সালে স্ত্রী গুলশান আরা বেগমের নামে জমিটি দখলে নেয়ার চেষ্টা শুরু করেন হাজী সেলিম। সে সময় এর একটি দলিলও বানান তারা। আর জায়গা না ছাড়ায় ব্যাংক কর্মকর্তাদের হুমকিও দেয়া হয়। এরপর ব্যাংক কর্তৃপক্ষ আদালতে মামলা করেন। কিন্তু চলতি বছরে করোনার প্রভাবে যখন সবকিছু স্থবির হয়ে পড়ে ঠিক তখনই হাজী সেলিমের লোকজন জায়গাটি দখল করে নেন। বুলডোজার দিয়ে পুরনো ভবন গুঁড়িয়ে দিয়ে সীমানা প্রাচীর তুলে দেন। এই ঘটনার পর গত ২০শে মে চকবাজার থানায় লিখিত অভিযোগ করেন ওই শাখার দায়িত্বে থাকা সহকারী মহাব্যবস্থাপক বৈষ্ণব দাস মন্ডল। পরে ১৫ই জুন র্যাব-৩-এ একটি অভিযোগ দেন তিনি। ব্যাংকের ওই কর্মকর্তা দাবি করছেন, ভুয়া দলিল ও কাগজপত্র তৈরি করে তারা সেটা অনেক আগে থেকেই দখল করার পাঁয়তারা করছেন। থানায় অভিযোগ করলেও তারা কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছেন না।
সরকারের জমি দখল করে নেয়ার বিষয়ে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ সাধারণ ডায়েরি করার পরও ব্যবস্থা না নেয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে চকবাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মওদুত হাওলাদার বলেন, দেওয়ানি বিষয়ে আমাদের কোনো হস্তক্ষেপ করার নিয়ম নেই। আমি তাদেরকে বলেছি কোর্টে একটি মামলা করার জন্য। কোর্ট যখন আদেশ দেবে তখন আমরা ব্যবস্থা নেবো। এর আগে ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব না।
জানা গেছে, ৭০ বছর ধরে এই জমিটি ওই ব্যাংকের দখলে রয়েছে। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর থেকেই জমিটি সে সময়ের হাবিব ব্যাংকের ছিল। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর হাবিব ব্যাংক ও কমার্স ব্যাংক একীভূত করে গঠন করা হয় অগ্রণী ব্যাংক। আর সেখানেই করা হয় ব্যাংকটির শাখা। পরে ওই জমিতে জায়গা সংকুলান না হওয়ায় ব্যাংকটির আরেকটি শাখা পাশের একটি ভবনে সরিয়ে নেয়া হয়। আর এই জমিতে নতুন ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু গত এপ্রিলে জায়গাটি দখলে নেন হাজী সেলিমের লোকজন। এরপর নিজেদের উদ্যোগে জায়গাটি অগ্রণী ব্যাংক উদ্ধার করলেও বেশিদিন টিকিয়ে রাখতে পারেনি। গত ৪ঠা নভেম্বর রাতে গেটে একটি সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে। তাতে জমির মালিক হিসেবে হাজী সেলিমের স্ত্রী গুলশানারা বেগমের নাম লেখা রয়েছে।
তবে বিষয়টি নিয়ে ব্যাংক কর্মকর্তারা নাম প্রকাশ করে কেউ কোনো কথা বলতে চাননি। এক ব্যাংক কর্মকতা বলেন, এখানে আমাদের আরো একটি শাখা আছে। এমনিতেই আমরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি, কেউ ভয়ে কথা বলছে না। তাছাড়া আমরা এখন একা একা চলতেও ভয় পাচ্ছি। এ ঘটনার পর ৫ই নভেম্বর চকবাজার থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেছে অগ্রণী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। র্যাবকেও চিঠি দেয়া হয়েছে। এসব নিয়ে জানতে চাইলে মৌলভীবাজার শাখার ব্যবস্থাপক বৈষ্ণব দাস মন্ডল কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
অগ্রণী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, আমাদের মৌলভীবাজার শাখার কর্মকর্তা-কর্মচারীরা খুব শঙ্কায় আছেন। তাদের ওপর যেকোনো মুহূর্তে হামলা হওয়ার সম্ভবনা আছে। আবার আমাদের জমিটাও উদ্ধার প্রয়োজন। দীর্ঘদিন ধরে তো এভাবে চলতে পারে না। একজন এমপি কিভাবে সরকারি জমি দখল করতে পারেন? আমি যতোটুকু জানি আমাদের ব্যাংকের এমডি, পরিচালকরা এই বিষয়ে মন্ত্রণালয়ে একটি আবেদন করেছেন। তারা আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার জন্য কাজ করছেন।
এসব অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে হাজী মো. সেলিমের মোবাইল ফোনে কল করা হলে তার ব্যক্তিগত সহকারী মহিউদ্দিন আহাম্মেদ বেলাল ফোনটি রিসিভ করেন। তার কাছে বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এমপি মহোদয় কোনো কথা বলতে পারেন না। এই বিষয়ে আমি কোনো বক্তব্য দিতে পারবো না। বিষয়টি নিয়ে হাজী সেলিমের আইনজীবী সৈয়দ হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনিও কোনো বক্তব্য দিতে রাজি হননি।