ড. মাহফুজ পারভেজ
মুষ্টিমেয় সরকারি হাসপাতালের বাইরে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা ও চিকিৎসা খাত দখল করে রেখেছে বেসরকারি সেক্টর। ১৫ হাজারেরও বেশি বেসরকারি ক্লিনিক, হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের উপস্থিতি রয়েছে সারা দেশে, যাদের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশই চলছে বৈধ লাইসেন্স ছাড়া।
‘শুধু চলছে’ বললে কম বলা হয়। বুক উঁচিয়ে, পিটিয়ে মানুষ মেরে, জাল সনদ দিয়ে, ভেজাল ঔষধ গছিয়ে বীরদর্পে চলছে তারা। রোগি তাদের কাছে মানুষই নয়, মক্কেল। তাকে যা খুশি করা যাবে। চিকিৎসার নামে মেরে ফেলা যাবে। জিম্মি করে রক্ত চুষে নেওয়া যাবে।
টাকা-পয়সা হাতিয়ে সর্বস্ব লুটে নেওয়াও যাবে।
সরকারের বিভিন্ন সংস্থার দেওয়া ভাষ্যানুযায়ী, লাইসেন্সবিহীন ক্লিনিক-হাসপাতাল সম্পর্কিত তথ্য বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত হয়েছে। এমনও জানা গেছে যে, ২০১৮ সাল থেকে বৈধ লাইসেন্স না থাকলেও, তেমন কোনো ঝামেলা পোহাতে হয়নি অবৈধভাবে কার্যক্রম পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে।
আশ্চর্যজনক বিষয় হলো, এসব ক্লিনিক, হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোকে নোটিশ ও পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেয়া ছাড়া এগুলোর বিরুদ্ধে আর কোনো উল্লেখযোগ্য ব্যবস্থা নেয়নি স্বাস্থ্য অধিদফতর। ফলে নির্বিঘ্নে ও অবৈধভাবে বহাল থাকতে পেরেছে এসব লাইসেন্সবিহীন প্রতিষ্ঠানগুলো।
২০১৮ সাল থেকে অবৈধ প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রে সরকারি নজরদারির শৈথিল্য কেন চলছে, তার কারণও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর কাজের ধীর গতির মধ্যে নিহিত। কারণ, ২০১৮ সাল থেকে লাইসেন্স নবায়নের প্রক্রিয়াটি ডিজিটালাইজড করার কার্যক্রম শুরু করেছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। যে কারণে তখন থেকেই লাইসেন্স নবায়ন ধীর গতিতে হচ্ছে। এর ফলে প্রায় ১৫ হাজার বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মধ্যে পাঁচ হাজারের যথাযথ লাইসেন্স রয়েছে। বাকিরা লাইসেন্স নবায়ন করতে আসেনি। সংস্থাও তাদের আসতে ও লাইসেন্স নিয়ে যথাযথভাবে কাজ করতে বাধ্য করেনি।
সরকারি নিয়মে, প্রতি বছর ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর লাইসেন্স নবায়নের জন্য পরিবেশগত ছাড়পত্র, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিস্তারিত বিবরণ, সিটি করপোরেশনের ছাড়পত্র, কর সার্টিফিকেট এবং অন্যান্য নথি প্রয়োজন। কিন্তু বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো এসব প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দিতে ও লাইসেন্স নবায়ন করতে আসে না। তাদেরকে আইনের আওতায় আনাও হয় না। ফলে লাইসেন্সবিহীন প্রতিষ্ঠানের দৌরাত্ম্য দিনে দিনে বৃদ্ধি পেয়েছে।
এসব অবৈধ বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার কথা থাকলেও স্বাস্থ্য অধিদফতরের উল্লেখযোগ্য কোনো কার্যকর ভূমিকা নিতে দেখা যায়নি। মিডিয়ায় প্রকাশিত তথ্য মতে, ২০১৪ ও ২০১৫ সালের দিকে স্বাস্থ্য অধিদফতরের তৎকালীন পরিচালক প্রফেসর সামিউল ইসলাম সাদী লাইসেন্সবিহীন প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে সাড়াশি অভিযান চালালে একটি মহলের চাপে পরবর্তীতে তাকে সরে যেতে হয় পদ থেকে। এরপর আর অবৈধ বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর বিরুদ্ধে তেমন কোন কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়নি।
বাংলাদেশে দ্য মেডিকেল প্র্যাকটিস অ্যান্ড প্রাইভেট ক্লিনিক অ্যান্ড ল্যাবরেটরিস (রেগুলেশন) অর্ডিন্যান্স-১৯৮২’র অধীনে বেসরকারি ক্লিনিক, হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো পরিচালিত হয়। এই আইন অনুযায়ী, এসব বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোকে অবৈধ ঘোষণা করা ছাড়া আর কিছু করার ক্ষমতাও সংস্থার নেই। নিয়মিত তাদের নোটিশ দেওয়া এবং পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ সংস্থার ক্ষমতা।
সংস্থার জনবলের ঘাটতিও একটি বড় কারণ বলে জানা গেছে। ঢাকার প্রায় পাঁচ হাজার ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের লাইসেন্সের বিষয়টি দেখার জন্য মাত্র তিন জন কর্মকর্তা রয়েছেন। ফলে ২০১৪ সালে রিজেন্ট হাসপাতালের লাইসেন্সের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটি জানার ফলেও স্বাস্থ্য অধিদফতরের হাসপাতালটির সঙ্গে চুক্তি করা হয়। এতে মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের কর্মমকর্তাদের যোগসাজসের অভিযোগ রয়েছে।
পরবর্তীতে শ্যামলীর একটি লাইসেন্সবিহীন ক্লিনিকে চিকিৎসার নামে পিটিয়ে একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলার মতো চাঞ্চল্যকর ঘটনাও ঘটে। দেশে এমন হাজার হাজার লাইসেন্সবিহীন অবৈধ ক্লিনিক-হাসপাতালে চলছে চিকিৎসার নামে ভয়ঙ্কর অনিয়ম, দুর্নীতি ও অব্যবস্থা। সরকারের নানা কর্তাব্যক্তি ও সংস্থা এসব বন্ধ করা হবে বলে বার বার মৌখিক ঘোষণা দিলেও কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। এজন্য কঠোরভাবে আইনের প্রযোগ ও শক্তিশালী প্রশাসনিক পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়টি এখনো দৃশ্যমান হয়নি। ফলে লাইসেন্সবিহীন অবৈধ ক্লিনিক-হাসপাতালের দৌরাত্ম্যের অবসান ঘটছে না।