চলে গেলেন বাংলা চলচিত্রের কিংবদন্তি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। চিকিৎসকদের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে রোববার দুপুরে কলকাতার বেলভিউ হাসপাতালে তিনি প্রয়াত হন। তার মৃত্যুতে দুই বাংলার সংস্কৃতি অঙ্গনে শোকের ছায়া নেমে আসে। শোক প্রকাশ করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্রমোদি, পশ্চিমবঙ্গের মূখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়সহ অনেকে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গুণী এই শিল্পির প্রয়ানে শোক প্রকাশ করেছেন।
মানুষের জীবনে অমোঘ, অনিবার্য মৃত্যু। অথচ সেই মৃত্যুকে জয় করতে চেয়েছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। বলেছিলেন, মৃত্যুর কথা ভাবা মানে তো জীবনের কাছে পরাজয় স্বীকার করা।
আমি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় হারতে তো শিখিনি। তিনটি দেড়ঘণ্টার টেলিভশন ইন্টারভিউ এর একটিতে এ প্রতিবেদকের প্রশ্ন ছিল, মৃত্যুকে কিভাবে দেখেন? জবাবে ওই কথাগুলো তিনি বলেছিলেন। অথচ সেই মৃত্যুর কাছেই হার মানতে হলো তাকে। ঈশ্বর বুঝিয়ে দিলেন, মৃত্যুকে হার মানাতে পারেনা কেউই। মৃত্যুই একমাত্র অপরাজেয়। তবে, জীবনের শেষ কাজের দিনটিতেও জীবনের জয়গান গেয়েছেন সৌমিত্র। এখানেই হয়তো তার জয়। ১৯৩৫ এর ১৯শে জানুয়ারি শিয়ালদহের কাছে মির্জাপুরে তার জন্ম। অল্পবয়সেই চলে যান কৃষ্ণনগরে। সেখান থেকে হাওড়া জিলা স্কুল, সিটি কলেজ হয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা নিয়ে স্নাতকোত্তর। আইনজীবী বাবা সরকারি কর্মী। শখের থিয়েটার এ অভিনয় করতেন। সৌমিত্রের রক্তেও অভিনয় ছিল। এম এ পড়ার সময় অহীন্দ্র চৌধুরীর কাছ থেকে তালিম নেন। শিশির ভাদুড়ির সঙ্গে অভিনয় করেন। কিন্তু অহীন্দ্র চৌধুরী ঘরানাই তার পছন্দ ছিল। আমাকে বলেছিলেন, আমি নিজেকে অহীন্দ্র চৌধুরীর ছাত্র বলে পরিচয় দিতে ভালোবাসি। অনেকেই জানেন না ১৯৫৬’তে সত্যজিৎ রায় সৌমিত্রকেই অপরাজিত এর জন্যে মনোনীত করেও পিছিয়ে যান সৌমিত্রের বয়স কুড়ি পেরিয়ে গেছে শুনে। ১৯৫৯-এ অপুর সংসারে সৌমিত্র প্রথম ব্রেক পেলেন। এরপর সত্যজিতের চৌদ্দটি ছবিতে তিনি নায়ক। অসাধারণ সব ছবি। সৌমিত্র আর সত্যজিতের যুগলবন্দি। সৌমিত্র আমৃত্যু কাজ করে গেছেন। অনেকে পচাশি বছর বয়সে তার কাজ করা নিয়ে কটাক্ষ করেছেন। কিন্তু, তারা জানেন না সংসার প্রতিপালন করার জন্য তাকে কাজ করে যেতে হয়েছে। দুর্ঘটনায় প্রায় পঙ্গু নাতির ওষুধের খরচ জোগাতেই হিমশিম খেয়েছেন। পাঁচ দশ হাজার টাকার বিনিময়ে তিনি প্রধান অতিথি হতেও রাজি হয়েছেন। ২০০৪-এ পদ্মভূষণ, ২০০৬-এ জাতীয় পুরস্কার, ২০১২-এ দাদাসাহেব ফালকে এবং ২০১৮-তে ফ্রান্সের সর্বোচ্চ সম্মান লিজিও ড. অনার এ ভূষিত অভিনেতার কি করুণ পরিণতি। সত্যজিৎ মৃনাল সেনের নায়ক টাকার জন্য থার্ড গ্রেড ছবিতেও অভিনয় করতে বাধ্য হলেন। কিন্তু, সেখানেও তিনি সিরিয়াস। এমনই ছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। বাঙালি বারবার সৌমিত্র-উত্তম কাল্পনিক যুদ্ধে উত্তেজিত হয়েছে, এ প্রতিবেদকের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে সেই মিথ ভেঙেছেন সৌমিত্র। বলেছেন, আমাদের সম্পর্ক ছিল দাদা ভাইয়ের, আমি ওর অভিনয়ের গুণগ্রাহী ছিলাম। কি স্টারডম, ভাবা যায় না। অনেকদিন টেলিফোন করে রাতে উনি আমাকে বলেছেন, পুলু, তৈরি থাকিস লং ড্রাইভে যাবো। ডায়মন্ড হারবার পর্যন্ত লং ড্রাইভ, তারপর পান ভোজন। সে এক অভিজ্ঞতা। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় একাধারে অভিনেতা, কবি, লেখক, সম্পাদক, চিত্রনাট্যকার, নট, অঙ্কনশিল্পী- একের মধ্যে কতগুণের সমাহার. নির্মাল্য আচার্যের সঙ্গে তার সম্পাদিত এক্ষণ পত্রিকার কথা কে ভুলে যাবে? এই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় পচাশি বছর বয়সে চলে গেলেন। সত্যিই যেনো যুগাবসান হলো।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের নশ্বর দেহ পঞ্চভূতে বিলীন: সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রয়াণে শুধু বাংলা নয়, ভারতীয় চলচ্চিত্রের এক গভীর ক্ষতি হলো। তিনি শেষদিন পর্যন্ত সক্রিয় ছিলেন। এই শূন্যস্থান পূর্ণ হওয়ার নয়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি প্রবাদপ্রতিম অভিনেতার মৃত্যুর খবরে এভাবেই শোক জানিয়েছেন। শোক জানিয়েছেন দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহও। তিনি বলেছেন, সংস্কৃতি জগতের এক ইন্দ্রের পতন ঘটলো। আরো বহু মানুষ শোক জানিয়েছেন এই কিংবদন্তি অভিনেতার প্রয়াণে। তাদের মধ্যে আছেন প্রাক্তন ভারত অধিনায়ক ও বিসিসিআই প্রেসিডেন্ট সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়, দাদাগিরির সেটে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের একটি ছবি দিয়ে সৌরভ লিখেছেন, আমাকে স্নেহ করতেন, এবার চলা শেষ হলো। শান্তিতে ঘুমান। সৌরভকে খুব পছন্দ করতেন সৌমিত্র। বলতেন, বাঙালির মুখ উজ্জ্বল করেছে সৌরভ। যদিও তার পছন্দের ক্রিকেটার ছিলেন গারফিল্ড সোবার্স। অভিন্ন হৃদয় বন্ধু পি কে ব্যানার্জির টানে ফুটবল মাঠে যেতেন। পি কে যে দলের কোচ হতেন সেই দলকে সমর্থন করতেন। রোববার অপরাহ্ণে রবীন্দ্র সদনে মানুষের ঢলের পর রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় কামানবাহী শকটে সৌমিত্রের দেহ যায় কেওড়াতলা মহাশ্মশানে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পুরো বিষয়টির তদারকি করেন। গোধূলি আলোয় একুশ তোপধ্বনির মাধ্যমে শেষ কুর্নিশ জানানো হয় সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদাকে।