জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে আবহমান বাংলার ঐতিহ্যবাহী ও দৃষ্টিনন্দন দুটি গয়না নৌকা ভাসানো হয়েছে জাতীয় সংসদ লেকে। বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদ লেকে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের তৈরি করা নৌকা দুটি ভাসিয়ে দেয়া হয়। ২৭ ফুট লম্বা এবং ৫ ফুট চওড়া নৌকা দুটি তৈরিতে ৪০ লাখ টাকা খরচ হয়েছে বলে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশন থেকে জানানো হয়েছে। এই নৌকায় একসঙ্গে ২০ জন মানুষ উঠতে পারবেন। ৪০ লাখ টাকা ব্যয়ের খবর প্রকাশের পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শুরু হয় নানা আলোচনা-সমালোচনা। দুটো নৌকা তেরিতে এই পরিমাণ টাকা খরচ ‘অস্বাভাবিক’ মন্তব্য করে ফেইসবুকে পোস্ট দেন অনেকে। তাদের সন্দেহ, এত টাকা দিয়ে নৌকা বানানোতে ‘অনিয়ম’ হয়েছে। কেউ কেউ তামাশা করে এই খরচ নিয়ে লিখেছেন, ‘এত কম’! সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, নৌকা দুটি তৈরির এই ৪০ লাখ টাকার মধ্যে প্রায় ১০ লাখ টাকা বিভিন্ন কর হিসেবে গেছে সরকারের খাতায়।
বাকি টাকা লেগেছে চারুকলার শিল্পীদের দিয়ে নৌকা তৈরিতে। কেউ কেউ বলছেন, সাধারণ এক মৌসুমে ব্যবহারের জন্য রেইনট্রি বা সারি গাছের একটি ডিঙি নৌকা বানাতে খরচ পড়ে ৪-৫ হাজার টাকা। আর সেটা যদি ৩-৪ মৌসুম ব্যবহারের জন্য করা হয় ১৫ হাজার টাকার বেশি লাগে। আর ছোট একটা গয়না নৌকা বানাতে কমপক্ষে ৭০ হাজার টাকা লাগে। যেটা খুব সাধারণ। আর যদি খুব ভালো কাঠ দিয়ে বানানো হয় তবে ৫ লাখ টাকা লাগবেই। বড় হলে আরো বেশি খরচ পড়বে। সংসদ লেকে ভাসানো নৌকা দুটির নকশা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের প্রিন্ট মেকিং বিভাগের অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। তার তত্ত্বাবধানেই ৩০ জন মিস্ত্রি এই দুটো নৌকা বানাতে কাজ করেছেন।
প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী হাশেম খানও নকশাতে কিছু সংযোজন-বিয়োজন করেছেন বলে পর্যটন করপোরেশনের চেয়ারম্যান জানিয়েছেন। বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের চেয়ারম্যান রাম চন্দ্র দাস বলেন, আমরা যখন এই কাজের পরিকল্পনা করলাম তখন অনেকেই এর চেয়ে বেশি খরচ দেখিয়ে এস্টিমেট দিয়েছিল। আমরা সবচেয়ে কম খরচের এস্টিমেট যিনি দিয়েছেন তারটাই নিয়েছি। এটাই নিয়ম। তিনি বলেন, সবচেয়ে বড় বিষয় এটা একটা আর্ট। বাণিজ্যিক কোনো কাজ নয়। তিনি বলেন, নৌকা এবং নদীর সঙ্গে রয়েছে আমাদের সভ্যতা সৃষ্টির আত্মিক সম্পর্ক। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলাদেশে নৌ-পর্যটন উন্নয়নে বাপক এর উদ্যোগে ট্যুরিস্ট ভেসেল সংগ্রহের কাজ চলছে। এ ছাড়া নৌকা এবং নদীকেন্দ্রীক সভ্যতাকে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছে তুলে দরার জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। ভবিষ্যতে আরো উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। নকশাকার আনিসুজ্জামান বলেন, ছাউনিতে আমরা যে ম্যাটেরিয়াল ব্যবহার করেছি তা সাধারণত ইন্টেরিয়র ডিজাইনাররা ব্যবহার করে থাকেন। স্টেইনলেস ম্যাটেরিয়াল সাধারণত চায়না থেকে আসে। তিনি বলেন, প্রায় ৩০ জন মিস্ত্রি এই কাজ করেছে। এ রকম একটি ডেকোরেটিভ নৌকা করতে দেড়-দুই মাস সময় লাগে। আমরা খুব অল্প সময় পেয়েছিলাম। ২০ দিন সময় পেয়েছিলাম। পরে করোনার জন্য কাজ কিছু দিন কাজ বন্ধ ছিল। এরপর এক সপ্তাহ সময়ের মধ্যে নৌকা দুটি পানিতে নামানো হয়েছে। এখানে শুধু আমি নই, আরো কয়েকজন শিল্পী কাজ করেছেন। আর এটা কোনো বাণিজ্যিক কাজ নয়। আর্ট ফর্ম। এখানে জামানতের টাকা আছে এবং ১৫ শতাংশ ভ্যাট-ট্যাক্স আছে। এর বিল এসেছে ৩০ লাখের নিচে। এটা পানিতে ভাসাতেই ১ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। ভাসানোর আগে আবার রঙ করতে হয়েছে। ভাসানোর জন্য লেগেছে ২০ জন। নৌকা ভাসানো কর্মসূচির উদ্বোধন করেন প্রধান অতিথি জাতীয় সংসদের চীফ হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরী। তিনি বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন আপাদমস্তকে একজন বাঙালি। তিনি বাঙালি জাতিস্বত্তা এবং সংস্কৃতিকে লালন করতেন এবং বাঙালির সংস্কৃতির মুক্তি এবং তা বিশ্বদরবারে তুলতে এদেশের স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন। তাই তার দলীয় প্রতীকও নৌকা। তাই বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা এবং আবহমান বাংলার ঐতিহ্যবাহী নৌকা এবং এদেশের সংস্কৃতিকে সংরক্ষণ করতে হবে, প্রচারের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছে তুলে ধরতে হবে। এজন্য যথাযথ কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। জানা গেছে, মুজিববর্ষ চলাকালীন অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের তত্ত্বাবধানে নৌকা দুটি পরিচালিত হবে। পরবর্তীতে সংসদ সচিবালয় ও পর্যটন করপোরেশন আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবে। সংসদ ভবনের লেকে ভাসমান নৌকায় সাধারণ মানুষের ওঠার সুযোগ থাকছে না। ভিআইপি ও বিদেশি পর্যটকরা এ নৌকায় সংসদের লেক ভ্রমণ করতে পারবেন। ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সঙ্গে কৃষ্টি-কালচার ও ইতিহাস-ঐতিহ্য তুলে ধরতে এই নৌকার ব্যবস্থা করা হয়েছে।