ঢাকা: বাবা সংসদ সদস্য। এই প্রভাবে তিনি নিজেও হয়েছেন সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর। ক্ষমতা আর অর্থের দম্ভে মানুষকে মানুষ মনে করতেন না তিনি। নিজের স্বার্থে এলাকায় গড়ে তুলেছিলেন প্রাইভেট বাহিনী। তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে গড়েছিলেন ব্যক্তিগত যোগাযোগ ব্যবস্থা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ফাঁকি দিতে ব্যবহার করতেন আধুনিক যন্ত্র। এসব ব্যবহার হতো মানুষকে নির্যাতন, দখল আর ক্ষমতার দাপট দেখানোর কাজে। সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর হলেও নিজে চলাফেরা করতেন সংসদ সদস্যের স্টিকার লাগানো গাড়িতে।
সর্বশেষ যে গাড়িটি দিয়ে নৌবাহিনীর কর্মকর্তার মোটরবাইকে ধাক্কা দিয়েছিলেন সেই গাড়িটি ১০ বছর ধরে ব্যবহার করা হচ্ছে কোনো কাগজপত্র ছাড়াই। নিজের কার্যালয়ে গড়ে তুলেছিলেন টর্চার সেল। সেখানে মানুষকে ধরে নিয়ে নির্যাতনের প্রমাণ পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তিনি ঢাকা-৭ আসনের সংসদ সদস্য হাজী সেলিমের ছেলে ইরফান সেলিম। নৌবাহিনীর কর্মকর্তাকে মারধরের ঘটনার পর তাকে সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর পদ থেকে গতকাল বরখাস্ত করা হয়েছে। এই ঘটনায় সোমবার তাকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। পরে তার বাসায় অভিযানে অবৈধ মাদক ও যন্ত্রপাতি পাওয়ায় ভ্রাম্যমাণ আদালতে এক বছরের সাজা দেয়া হয়।
গ্রেপ্তারের পর বেরিয়ে আসছে ইরফানের নানা অপকর্মের তথ্য। বিশেষ করে তার বাবা হাজী সেলিমের পথ ধরেই তিনি পুরো এলাকায় নিজের সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন। সংসদ সদস্য হাজী সেলিম অসুস্থতার কারণে এখন রাজনৈতিক অবস্থান ধরে রাখতে পারছেন না। এমপি সেলিম পুরান ঢাকায় নিজের অবস্থান গড়ার সময়ও নিজস্ব বাহিনী নিয়ে চলাফেরা করতেন বলে অভিযোগ রয়েছে। মূলত কমিশনার হয়ে তার রাজনৈতিক উত্থান। একসময় করতেন বিএনপি। সুবিধা বুঝে যোগ দিয়েছেন আওয়ামী লীগে। ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন না পেলেও বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে এমপি হয়েছিলেন। সর্বশেষ ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগ থেকে এমপি হয়েছেন। এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পুরান ঢাকার একটি গোষ্ঠীর কাছে তিনি বেশ জনপ্রিয়। এই জনপ্রিয়তার বাইরে তিনি এক ধরনের পেশীশক্তি আর আধিপত্য দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করছেন পুরান ঢাকা ও তার আশপাশ। এর ধারাবাহিকতায় অন্যের জমি ও বাড়ি দখল তার নেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, শতাধিক বাড়ি ও মার্কেট দখলে নিয়েছেন এমপি হাজী সেলিম। দখল করা এসব সম্পত্তি এখন দেখাশোনা করেন ছেলে ইরফান। এগুলো রক্ষায় তার নেতৃত্বে রয়েছে প্রাইভেট বাহিনী।
অভিযোগ রয়েছে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের লালবাগ থানা এলাকায় ঢাকা সরকারি বধির হাইস্কুলের এক একর জমি দখ?ল করেছেন তিনি। ‘বাংলাদেশ জাতীয় বধির সংস্থা’র প্রধান প্রকল্পের অনুকূলে সরকার ওই জ?মি স্কুলকে দীর্ঘমেয়াদি বন্দোবস্ত করে অনুমোদন দেয়। এই জমি হাজী সেলিম জবরদখল ক?রে? রেখেছেন।
বাংলাদেশ জাতীয় বধির সংস্থার সভাপতি অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকার অভিযোগ করে বলেন, এই জায়গাটি আমরা সরকার থেকে একটি প্রতীকী মূল্য দিয়ে কিনেছি। এরপর হাজী সেলিম এই জায়গাটি দখল করে রেখেছে। আমরা ডিসিকে জমিটি উদ্ধার করে দিতে বলেছি। কিন্তু ডিসি যখন হাজী সেলিমের কথা শুনেন তখন তিনি আর ভয়ে এগোননি।
এদিকে প্রায় দুই যুগ ধরে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) তিব্বত হলের দখলদারিত্ব নিয়েছেন তিনি। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা হলের জন্য হাহাকার করছেন। শুধু তাই নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিষয়টি নিয়ে আন্দোলন করলেও এর কোনো সুরাহা হয়নি। সরজমিন গিয়ে দেখা যায়, বুড়িগঙ্গার তীরে পাটুয়াটুলী-ওয়াইজঘাট এলাকায় ৮ ও ৯ জিল পার্থ লেনে (কুমারটুলীতে) অবস্থিত তিব্বত হল। হলটি ৮.৮৯ কাঠা জায়গার ওপর নির্মিত। বর্তমানে পুরো অংশটি হাজী মোহাম্মদ সেলিম দখল করে রেখেছেন। তিনি ২০০১ সালে ওই জায়গায় গড়ে তুলেছেন নিজের স্ত্রীর নামে গুলশান আরা সিটি শপিং কমপ্লেক্স। বিশাল এই ভবনটিতে হাজারের উপর দোকান রয়েছে। জানা গেছে, শিক্ষার্থীরা নব্বইয়ের দশক ও ২০১৪ সালে হলটি ফেরত নিতে গেলে স্থানীয়দের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ হয়। হল দখল ও আন্দোলনের ব্যাপারে এই সংসদ সদস্য বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যদি তাদের সম্পদ হিসেবে প্রমাণ করতে পারেন তা হলে আমি নিজের জায়গা ছেড়ে তাদের দিয়ে দেব। তবে বিষয়টি নিয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ড. মিজানুর রহমান বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার আরো বিশ বছর আগে এই হলগুলো দখল হয়ে গেছে। যখন জগন্নাথ কলেজ ছিল তখন এই হলগুলোতে শিক্ষার্থী ছিল। এগুলো মূলত হিন্দুদের বাড়ি। যখন হিন্দুরা এখান থেকে চলে গেছেন, তখন কলেজের ছাত্ররা গিয়ে সেখানে থাকতো।
অন্যদিকে চলতি বছরের মে মাসে পুরান ঢাকার মৌলভীবাজার এলাকায় রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন অগ্রণী ব্যাংকের একটি জমি দখলে নেন হাজী সেলিম। গত সোমবার আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সহায়তা ছাড়াই হাজী সেলিমের দেয়া সীমানা প্রাচীর ভেঙে জমি বুঝে নিয়েছে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। ওই ব্যাংকের এক কর্মকর্তা জানান, মৌলভীবাজার এলাকায় ১৪ শতাংশ জমির উপর একটি দুই তলা ভবন ছিল। স্বাধীনতার পর নির্মিত ভবনটি অনেক পুরাতন হওয়ায় কিছু দিন আগে নতুন ভবনে শাখা স্থানান্তর করা হয়েছে। করোনাভাইরাসের কারণে সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর ব্যাংকের শাখাটিও বন্ধ ছিল। এখানে দায়িত্বরত নিরাপত্তা প্রহরী ভল্ট পাহারা দিতে ভেতরে অবস্থান করেন। সেই সুযোগে চলতি বছরের মে মাসে আমাদের পুরনো ভবনটি গুঁড়িয়ে দিয়ে দখলে নেন হাজী সেলিম। অগ্রণী ব্যাংকের জনসংযোগ কর্মকর্তা শরিফুল ইসলাম মানবজমিনকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
অভিযোগের শেষ নেই তার বিরুদ্ধে। বছর ছয়েক আগে একই এমপি’র বিরুদ্ধে ভবনসহ ভূমি দখল করার চেষ্টার অভিযোগ করেছেন পুরান ঢাকার একজন বাসিন্দা। সানিয়া ইসলাম নামের পুরান ঢাকার এক ব্যবসায়ী সেই সময়ে জাতীয় প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেন। সেখানে তিনি বলেন, তার পিতা মরহুম শামসুল হক ১৯৯৬ সালে নবাবপুরের ১০১, ১০২ ও ১০৩ নম্বর হোল্ডিংয়ের ৬ দশমিক ৫ কাঠা জমি কেনেন। তখন থেকেই তারা জমির দখলে আছেন। এই জমিটি জাল দলিলের মাধ্যমে হাজী সেলিম তার শাশুড়ি দেলোয়ারার বলে দাবি করছেন। সানিয়া ইসলাম তখন বলেন, তার পিতা ২০১৩ সালের ৩১শে অক্টোবর মারা যাওয়ার আগে ওই জমিতে বহুতল ভবন করার জন্য একটি নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করেন। সেই নির্মাণকাজ এখনো চলছে। কিন্তু হাজী সেলিম হঠাৎ করেই তার শাশুড়ি দেলোয়ারা বেগমের নামে জাল দলিল করে ওই জমি ও নির্মাণাধীন ভবন তার বলে দাবি করছেন। সানিয়া অভিযোগ করেন, ২০১৪ সালের ১৩ই জুন তিনি সেখানে সশরীরে গিয়ে ভবন নির্মাণ বন্ধ না করলে লাশ ফেলার হুমকি দেন। তবে সেই সময়ে পাল্টা সংবাদ সম্মেলন করেন এই এমপি।
পুরান ঢাকার আহসান উল্লাহ রোডের মদিনা ফ্রুটস লিমিটেড, মদিনা কোল্ড স্টোরেজসহ আরো একটি ভবন দখলের অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। নামপ্রকাশ না করার শর্তে একজন চাল দোকানি বলেন, দশ-পনেরো বছর ধরেই হাজী সেলিম এগুলো করেছেন। এলাকায় ভয়ে তাকে নিয়ে কেউ কথা বলতে চান না।
শুধু বাড়ি বা বিদ্যালয় দখল করে থেমে থাকেননি তিনি। বুড়িগঙ্গা নদী দখল করার অনেক অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এ নিয়ে তার তার প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলাও রয়েছে। চলতি বছরের ১৯শে মে হাজী সেলিমের নির্দেশে রাতে নদী দখলের চেষ্টার অভিযোগ দিয়েছিল বিআইডব্লিউটিএ। অভিযোগ ওঠে ওই দিন রাতে ওই এমপির লোকজন নানা কৌশলে নদী ভরাট করছিল। এই খবর পেয়ে রাত আড়াইটার দিকে কেরানীগঞ্জের ঝাউচরের বুড়িগঙ্গার সীমানা পিলারের অভ্যন্তরে সরাসরি নদীগর্ভে বিপুল পরিমাণ অংশ ডাম ট্রাকের মাধ্যমে রাবিশ দিয়ে ভরাটের সময় অভিযান চালিয়ে ৭ জনকে আটক করে বিআইডব্লিউটিএ।
ভরাটকারীদের গৃহীত নানা অপকৌশলের মধ্যে একটি হলো ডাম ট্রাকের সম্মুখে বিআইডব্লিউটিএ’র লোগো ও ড্রেজিং বিভাগের ‘জরুরি মাটি অপসারণের কাজে নিয়োজিত’ লেখা সংবলিত স্টিকার ছিল। এই ঘটনার এক বছর আগে একই জায়গায় একই প্রক্রিয়ায় গভীর রাতে অভিযান চালিয়ে ছয় জনকে আটক করে তাদের বিরুদ্ধে বিআইডব্লিউটিএ’র পক্ষ থেকে কেরানীগঞ্জ মডেল থানায় মামলা করা হয়েছিল।
এই মামলার বাদী বছিলা নৌ-পুলিশ ফাঁড়ির এএসআই অনিল বিহারী নাথ বলেন, আমরা তাদের হাতেনাতে ধরেছি। তারা হাজী সেলিম সাহেবের প্রজেক্টেই কাজ করছিল। তখন তারা এই ঘটনা স্বীকারও করেছে।
লালবাগে হাজী সেলিমের নিজস্ব বাহিনী রয়েছে। এই বাহিনী দিয়েই পুরো লালবাগ নিয়ন্ত্রণ করেন তিনি। লালবাগের এক বাসিন্দা বলেন, পুরান ঢাকায় হাজী সেলিমের বাইরে কেউ যেতে পারেন না। যে যান তাকে পড়তে হয় ওই এমপি’র রোষানলে। এখন তিনি কথা বলতে পারেন না। কিন্তু এই সব দেখাশোনা করে তার ছেলে কাউন্সিলর ইরফান।
হাজী সেলিমের আপন ভাগ্নে মো. হাসান পিল্লু এই প্রতিবেদককে বলেন, মামার আল্লাহ রহমতে ৫০-৬০ টি বাড়ি রয়েছে। মার্কেট তো অনেক আছে। আমার জানামতে কোনো বাড়ি মামা দখল করেননি। যদি দখল করতেন তাহলে তো ভুক্তভোগী থাকতো। সেটা তো আমরা দেখছি না।
মানুষ পেটানো ইরফানের অভ্যাস: হাজী সেলিমের তিন ছেলের মধ্যে মেজ ছেলে ইরফান সেলিম। তার বড় ভাই সোলায়মান সেলিম মদিনা গ্রুপের দেখাশোনা করেন। ছোট ভাই সালমান সেলিম অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী। হাজী সেলিমের রাজনীতির অঙ্গন এখন অনেকটাই ছেলে ইরফানের দখলে। কাউন্সিলর হলেও সংসদ সদস্যের স্টিকারযুক্ত গাড়িতে প্রায়সই ঘুরে বেড়ান ইরফান সেলিম। নৌবাহিনীর কর্মকর্তাকে মারধর করে কারাগারে যাওয়া ইরফানকে নিয়ে এখন এলাকায় নানা আলোচনা। মানুষ বলছে, এ ঘটনা নতুন নয়। মতের বিরুদ্ধে, আদেশ না মানলে তিনি প্রায়ই মানুষকে মারধর করতেন। তবে ভয়ে এতোদিন কেউ মুখ খুলেনি। সম্প্রতি তার আপন ফুফাতো ভাই এবং সাবেক ৩০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. হাসান পিল্লুর গায়ে হাত তোলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ২৬, দেবীদাস ঘাট লেনের একটি ভবনের সিকিউরিটি গার্ড বলেন, বড় লোকের বিরাট কারবার। তার (ইরফানের) কাছে মুরব্বি-ছোট জ্ঞান নেই। হয়তো আমার কথা তার মতের বিরুদ্ধে যাবে তখন এই ৮০ বছর বয়স্ক ব্যক্তির গায়ে হাত তুলতেও ভাববে না। এলাকার আরেক বাসিন্দা বলেন, গত ৪ থেকে ৫ মাস আগে চার ব্যক্তিকে মেরে হাসপাতালে পাঠিয়েছিলেন কাউন্সিলর ইরফান।
সন্ধ্যার পরে মদ্যপ অবস্থায় রাস্তায় বেরিয়ে তাদেরকে পিটিয়ে আহত করেন। ভয়ে কেউ প্রতিবাদ করেনি। ইরফানকে আটকের ঘটনায় কারো ভালো হয়েছে, কারো হয়েছে মন্দ। এ ঘটনায় এলাকার মানুষ অনেকেই খুশি। খুব খুশি। গত ৪ থেকে ৫ মাস আগে আমার মালিকের বাড়ির সামনে দিয়ে তাদের গাড়ি যেতে অসুবিধা হয় তাই বাসার সামনের তৃতীয় নম্বর সিঁড়ি ভাঙার কথা বলেন। এভাবে তাদের অন্যায় আবদারের শিকার হচ্ছেন এলাকার সাধারণ মানুষ।