ব্যারিস্টার রফিক-উল হক তখনো জীবিত। যদিও শরীররটা তার সেসময়েও ভালো ছিল না। তখন সাবেক প্রধান বিচারপতি মো. ফজলুল করিম, সিনিয়র আইনজীবী রোকন উদ্দিন মাহমুদ ও আজমালুল হোসেন কিউসি মানবজমিনকে দেয়া প্রতিক্রিয়ায় কথা বলেছিলেন রফিক-উল হক প্রসঙ্গে।
সাবেক প্রধান বিচারপতি মো. ফজলুল করিম মানবজমিনকে বলেন, ‘ব্যারিস্টার রফিক-উল হকের সঙ্গে আমার পরিচয় আমার ওকালতি জীবনের শুরু থেকে। সেই ১৯৬৯ সালে। তবে, এর আগে থেকেই তিনি ওকালতি শুরু করছিলেন। আইনজীবী হিসেবে রফিক-উল হক সততা, নিষ্ঠা ও সমতার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি একাগ্র চিত্তের মানুষ। দায়িত্বশীলও।
কখনো তিনি জাতি, ধর্ম, বর্ণ, দল বিবেচনায় নেননি। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার পক্ষেও তিনি ওকালতি করেছেন। দুজনকেই তিনি সমভাবে ও সমদৃষ্টিতে দেখেছেন। আগ্রহ নিয়ে দুজনের মামলা পরিচালনা করেছেন। বিচারপতি ফজলুল করিম বলেন, আইনের ব্যাপারে তার যেমন অগাধ জ্ঞান, তেমনি আইনকে তিনি আইনের দৃষ্টিতে দেখেছেন সবসময়। কোন দল দেখেননি। বিনে পয়সায়ও তিনি অনেকের মামলা পরিচালনা করেছেন। আদালতে তাকে খুব সামনে থেকে দেখেছি ও শুনেছি। তার যুক্তিতর্ক খুবই স্পষ্ট ও সাবলীল। ব্যারিস্টার রফিক-উল হক যখন অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন তখনো তিনি কোনো পক্ষপাতিত্ব করেননি।’
রফিক-উল হক সম্পর্কে বলতে গিয়ে সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার রোকন উদ্দিন মাহমুদ বলেন, তিনি সমসাময়িককালের একজন অত্যন্ত উঁচুমানের আইনজীবী যাকে বিচারক, আইনজীবীসহ এই পেশার সর্বস্তরের ব্যক্তিগণ শ্রদ্ধা সম্মানের চোখে দেখেন। তিনি এই দেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ মামলা কোনো না কোনোভাবে পরিচালনা করেছেন। ওই সব মামলায় বিভিন্ন আইনের ইন্টারপ্রিটেশন (বিশদ ব্যাখ্যা) দেয়া হয়েছে এবং আইনের ভূমিকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এই দেশে ডেভেলপমেন্ট অব ল’তে আইনজীবী হিসেবে এক বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন তিনি। ব্যক্তি হিসেবেও তিনি অত্যন্ত সদয় ও স্নেহপরায়ণ। রোকন উদ্দিন মাহমুদ বলেন, তিনি জীবনে অনেক টাকা উপার্জন করেছেন। আবার সেই অর্থ অনেক জনহিতকর ও মানুষের কল্যাণে ব্যয় করেছেন। তার কিছু দাতব্য প্রতিষ্ঠান আছে। দাতব্য প্রতিষ্ঠানের ব্যাপারে তিনি যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তা অত্যন্ত বিরল।
রোকন উদ্দিন মাহমুদ বলেন, বিগত ওয়ান ইলেভেনের সময় ব্যারিস্টার রফিক-উল হক আইনজীবী হিসেবে অত্যন্ত বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছিলেন। ওয়ান ইলেভেন সরকারের বিভিন্ন আদেশ নির্দেশ চ্যালেঞ্জ করে বিভিন্ন মামলা পরিচালনা করেছিলেন। একজন স্পষ্টভাষী ও সাহসী মানুষ হিসেবেও তার সুনাম রয়েছে। তিনি অ্যাটর্নি জেনারেল থাকাকালে বেশকিছু বিরল দৃষ্টান্ত রেখেছিলেন। যে দৃষ্টান্তগুলো উনার আগে বা পরে কেউ দেখাতে পারেনি। উদাহরণ হিসেবে বলতে পারি- তখনকার সময়ে অনেককেই স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্টে ডিটেনশন দিয়ে কারাগারে আবদ্ধ করে রাখা হতো। এর বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে হেভিয়াস কর্পাস রিট দায়ের হতো।
সেসব ফাইল দেখে যদি তিনি বুঝতে পারতেন যে ডিটেনশন বৈধ হয়নি, রাষ্ট্রের অ্যাটর্নি জেনারেল হওয়া সত্ত্বেও স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে কার্যতালিকার ওইসব মামলাগুলোর বিষয়ে আদালতকে অপেক্ষায় না রেখে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির আটকাদেশ বৈধ হয়নি উল্লেখ করে তাদের ছেড়ে দেয়ার কথা বলতেন। এরকম স্বচ্ছতা অন্য কোনো অ্যাটর্নি জেনারেল দেখাতে পারেননি। শুধু তাই নয়, অন্যান্য রিট পিটিশনের ক্ষেত্রেও তিনি যদি দেখতেন যে সরকারি আদেশ বেআইনি সেখানেও তিনি আদালতে কোনোরূপ ভনিতা না করে তা
স্বীকার করে নিতেন। আমি শুনেছি অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে ব্যারিস্টার রফিক-উল হক তার যে প্রাপ্য বেতন ছিল, তাও গ্রহণ করেননি। এটিও বিরল দৃষ্টান্ত।
ব্যারিস্টার রফিক-উল হক সম্পর্কে সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী আজমালুল হোসেন কিউসি বলেন, ব্যারিস্টার রফিক-উল হককে আইনজীবী হিসেবে আমি প্রথম দেখি ১৯৬২ সালে। আমার বাবার (ব্যারিস্টার আসরালুল হোসেন) ফরাসগঞ্জের চেম্বারে। বাবার জুনিয়র আইনজীবী হিসেবে কাজ করেছিলেন তিনি। শুরু থেকেই তাকে একজন মেধাবী মানুষ মনে হয়েছে। আমার বাবা তাকে বেশ কিছু মামলা পরিচালনার দায়িত্ব দেন এবং তিনি তা যথেষ্ট দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা করেন। ১৯৬৬ সালে বাবা মামলার প্রয়োজনে লম্বা সময়ের জন্য জেনেভাতে যান।
ওই সময় চেম্বারের সব মামলার দায়িত্ব বর্তায় তার (ব্যারিস্টার রফিক-উল হক) ওপর। সেই থেকে তিনি একজন ভালো আইনজীবী হিসেবে সুনাম অর্জন শুরু করেন। তিনি বলেন, ব্যারিস্টার রফিক-উল হক ও আমি সুপ্রিম কোর্টের একই চেম্বারে দীর্ঘদিন বসেছি। তবে, এখন অসুস্থতা ও বার্ধক্যের জন্য তিনি আদালতে নিয়মিত আসতে পারেন না। তিনি একজন মেধাবী ও পরিশ্রমী আইনজীবী। মামলার প্রয়োজনে প্রচুর পড়াশোনা করেন। মক্কেলদের প্রচুর সময় দেন। মামলা পরিচালনাও করেন খুব নিখুঁতভাবে। আদালতে যখন মামলার শুনানিতে আসেন, পুরোদমে প্রস্তুতি নিয়েই আসেন এবং সময়মতো আসেন, যা এখনকার আইনজীবীদের অনেকের ক্ষেত্রেই খুব একটা দেখা যায় না।
আর কাজ এবং দায়িত্বের ব্যাপারে কখনোই তাকে অধৈর্য হতে দেখিনি। ব্যারিস্টার রফিক-উল হকের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। এ কারণে যে তার কাছ থেকে আমি অনেক কিছু শিখেছি। এখনো শিখছি। আজমালুল হোসেন কিউসি বলেন, এ পর্যন্ত প্রায় একশ গুরুত্বপূর্ণ মামলায় তিনি অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এ ছাড়া যখনই আদালতের বিচারকরা প্রয়োজন মনে করেছেন তখনই তাকে ডাকেন। এমনকি এ-ও দেখেছি যে আদালতে অন্য মামলার শুনানিকালে বিচারকরা তার কাছ থেকে নানা সময়ে সাংবিধানিক ও আইনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যাখ্যা শুনতে চেয়েছেন। তিনি বলেন, একজন সাহসী ও স্পষ্টভাষী মানুষ হিসেবেও তিনি অন্য সবার চেয়ে আলাদা। স্পষ্ট এবং সত্য কথা বলতে কখনো তিনি কাউকে পরোয়া করেননি।