অনেকে যুক্তি দাঁড় করাচ্ছে, অশ্লীল পোশাক পড়া নারীকে দেখে পুরুষরা সে নারী কে হাতের কাছে না পেয়ে কামউত্তেজনায় শিশু এবং পর্দা করা নারীদের ধর্ষণ করছে। এমন ঢেউটিন মার্কা যুক্তিতে সবাইকে ধর্ষণ করা জায়েজ করে দিচ্ছেন। কেমন বেকুবের মতো ধর্ষকে সমর্থন করছেন। এমন কথায় ধর্ষক আরো উজ্জীবিত উৎসাহিত হবে, ধর্ষক মনে করবে আমি ঠিক কাজ করছি, ধর্ষণ করে অশ্লীল পোশাক এর প্রতিবাদ করছি। যারা এমন যুক্তিকে ভুক্তভোগিরদের উপরে দায়ভার চাপিয়ে দিচ্ছে। তারাও কিন্তু ধর্ষকামী চিন্তাবিদ। মূলত বাঙালি মা-বোনরা অশ্লীল পোশাক পড়ে না, দ্বিতীয়ত ধর্ষক যদি মিয়া খলিফা সানি লিওনদের ভিডিও দেখে ধর্ষণ করা শিক্ষা পেয়ে থাকে এটার দায়ভার কার? মানুষের চিন্তা চেতনা করার জন্য মগজ আছে, সেটা সঠিক সুন্দর কাজে যদি না লাগান। খারাপ অন্যায় অনৈতিক কাজ যদি করেন সেটা শয়তানের উপরে দোষ দিয়ে পার পাবেন? সো পচা মানসিকতার ধর্ষকে প্রশ্রয় দেওয়াও তাকে সাপোর্ট করা।
এর প্রতিবাদ করতে গিয়ে অনেকে এমন মন্তব্যের শিকার হয়েছেন যে- আপনার মা-বোনকে কি হাফ প্যান্ট পড়ে রাস্তায় বের হতে দিবেন? আরে বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী, আমাদের দেশের মা বোনরা কি রাস্তায় হাফপ্যান্ট পরে বের হয়? তার জন্য কি ধর্ষন হচ্ছে? আমার দেশের মা বোনেরা সব সময় শালীন পোষাক পড়ে। রাস্তার একটা পাগলিও মোটা ছালা পেচিয়ে নিজেকে ঢেকে রাখে- পাগলীরাও রক্ষা পায় না, ধর্ষিত হয়।
হাফপ্যান্ট পরে প্রকাশ্যে বের হয় এ দেশের কিছু পুরুষরা। খালি গায়ে প্রকাশ্যে ঘুরে এদেশের পুরুষরা। জনবহুল রাস্তায় বিশেষ অঙ্গ বের করে রাস্তায় প্রসাব করে এ দেশের সে পুরষরা। কিন্তু কখনো শুনছেন এমন পুরুষদের রাস্তা থেকে টেনে নারীরা বিছানায় নিয়ে গেছেন? কিন্তু আপনারা শালীন পোশাকে অশালীন বলে ধর্ষণকে জায়েজ করার চেষ্টা করছেন।
“ধর্ষণের জন্য পোশাক দায়ী নয়, বিকৃত মানসিকতায় দায়ী।” এর অর্থ কি পর্দা করা যাবে না বা পর্দার বিরোধিতা করা? ভুল। মুসলিম নারীদের জন্য পর্দা অবশ্যই সম্মান ও গৌরবের। আমাদের দেশের বোনেরা জানে কিভাবে শালীন পোশাক পরতে হবে। কিন্তু আপনি চরমপন্থীর মত বলতে পারেন না ধর্ষণের জন্য নারী পোশাক দায়ী। পোশাকের কারণে নারীকে ধর্ষণ করতে হবে এরকম অথরিটি কোন ধর্ম দেয় না। নারী ধর্ষিত হচ্ছে আবার এর দায়ভার নারীর উপরে চাপানো মানসিকতা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে।
অনেক কলগার্ল বা প্রস্টিটিউটও আজকাল বোখরা পড়ে। বোখরা পরে ফুটওভার ব্রিজ গুলোতে নিজেকে বিক্রি করার জন্য দাড়িয়ে থাকে অনেক পতিতা। এর জন্য কি বলা যাবে বোকরা পতিতা হওয়ার জন্য দায়ী? শুধু পোশাক না পোশাকের ভিতরে মানুষটাই হলো আসল। পুরুষের স্পর্শ ছাড়া কোন নারী মা হতে পারে না। পুরুষের স্পর্শ সৃষ্টি হয় পতিতা- কিন্তু এর দায়ভার নারী বহন করে সবসময়। কারণ নারী দুর্বল তাই।
কিছু লোক অশালীন পোশাকের কথা বলছেন। থ্রিপিস শাড়ি এগুলো কি অশালীন পোশাক? বাঙালি নারীরাতো শালীন পোষাকই পড়ে। আপনার দৃষ্টিভঙ্গি যদি ঠিক না থাকে শালীন পোশাক পরা নারীকেও আপনি বস্ত্রহীন ভাবে কল্পনা করতে পারবেন। একজন নারীকে আপনি মায়ের দৃষ্টিতে দেখবেন, না বোনের দৃষ্টিতে দেখবেন, নাকি পতিতার দৃষ্টিতে দেখবেন এটা আপনার মানসিকতার উপরে ডিপেন্ড করে। সো দৃষ্টিভঙ্গি শালীন করতে হবে।
সবচেয়ে দেশি পর্দা করে কোন জেলার মানুষ? এর সঠিক সমীকরণ না থাকলেও এ প্রশ্নের উত্তরে নোয়াখালী জেলার নাম আসবে। কারণ নোয়াখালীর নারীরা বেশি পর্দাশীল। কিন্তু জঘন্যতম বর্বর ভাবে ধর্ষণের ঘটনা গুলো নোয়াখালীতে বেশী। অতঃপর বিকৃত মানসিকতার কাছে পর্দাশীল নারী রক্ষা করা এবং অবুঝ নিষ্পাপ শিশুও রক্ষা পায় না। জিন্স প্যান্ট আর টি-শার্ট পরে গুলশান – ধানমন্ডির উচ্চবিত্ত মেয়ারা, নোয়াখালী বা অন্যান্য জেলার পুরুষেরা গুলশান ধানমন্ডি এসে এদের দেখে সামলাতে না পেরে নিজ জেলাই গিয়ে ধর্ষণ করে?
অনেক কথা বলেছি এখন আসল কথায় আসি-
মানুষ সাধারণত দুর্বলের প্রতি জুলুম করে, দুর্বলের প্রতি অন্যায় করে, দুর্বলের প্রতি অবিচার করে। একজন রিক্সাওয়ালার সাথে যেভাবে মানুষ ব্যবহার করে, হরহামেশাই তুই তোকারি করে চড় থাপ্পড় দিয়ে বসে। একজন মন্ত্রীর সঙ্গে এ কিরূপ ব্যবহার কখনো করে না। এর একমাত্র কারণই দুর্বল মানুষ আর শক্তিমান ও সফল মানুষ পার্থক্য। এখন মূল কথায় আসুন।
নারীদের আমরা দুর্বল নতজানু জেনে আসছি মেনে আসছি। এটা আমাদের মাথায় মাইন্ড সেট হয়ে আছে। তাই এই নারীদের প্রতি অন্যায় অবিচার স্বাভাবিকভাবে করা শিখে গেছি।
তারা দুর্বল এই শিক্ষা আমাদের পরিবার দিয়েছে, সমাজ দিয়েছে। শিশু থেকেই চুপ থাকা, অন্যায় মেনে নেয়া, কন্যাশিশুদের চর্চা করানো হয়। এখনো গ্রামবাংলায় মানুষ মনে করে অশোভন এবং অশ্লীল কান্ড যা সমাজে ঘটছে তা লুকিয়ে রাখাই বুদ্ধিমানের কাজ। সে কারণে ধর্ষণের শিকার হয়ে মেয়েরা মুখ লুকিয়ে রাখে। বুঝানো হয় পুরুষ শক্তিশালী, পুরুষ প্রভু! পরিবারে এবং নিকটতম আত্মীয় স্বজনের কাছে কন্যারা ট্রমাটাইজড হয়, অনেক ছোট থেকেই সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট মত জঘন্যতম অভিজ্ঞতা মেয়েদের সাথে ঘটে। কিন্তু তারা মুখ ফুটে বলতে পারে না,
এটার প্রতিবাদ করতে পারে না। কারণ তাদের শিখানো হয়েছে, এমন খারাপ বিষয় প্রকাশ করা যাবে না, প্রতিবাদ করা যাবে না। এই সমাজ দুর্বল একে আরও দুর্বল করে রাখার জন্য মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার খরচ করে।
ছেলেদেরকে উচ্চশিক্ষার জন্য শহরে পাঠানো হয়, বিদেশ পাঠানো হয় সে একই পরিবারের মেয়েকে কোনরকম ইস্কুলের গণ্ডি পার করে বিয়ে দেয়া হয়। এই যে বৈষম্যের কালচার, নারীকে দুর্বল করে রাখার সিস্টেম। এখানে পরিবর্তন নিয়ে আসতে হবে। গাছের শিকড় যদি পচে যায় গাছের মাথায় পানি ঢেলে কোন লাভ হবে না। যত কঠিন আইন হক ধর্ষণ নির্মূল হবে না। এর জন্য গাছের শিকড়ের দিকে যত্নশীল হতে হবে। পিঁপড়ার গর্তে বিষ ঢালতে হবে। নারীদেরকে শিখাতে হবে তোমরাও মানুষ, শিক্ষা দীক্ষায় এবং অর্থবৃত্তে করতে হবে সফল শক্তিশালী।
পরিবারে সমাজে যৌন হেনস্তা, ধর্ষণ, নারী নির্যাতনের মূল কারণ যদি পরিবার থেকে নির্মূল না হয়, আমার আশঙ্কা ধর্ষণ চলতেই থাকবে। প্রতিবাদ পরিবার থেকে শুরু করতে হবে। মনে করা যাবে না অশোভন এবং অশ্লীল কান্ড যা সমাজে ঘটছে তা লুকিয়ে রাখাই বুদ্ধিমানের কাজ। ধর্ষণের শিকার হলে মেয়েরা মুখ লুকিয়ে রাখা যাবে না, আপন মানুষকে বলতে হবে কী ঘটেছে, প্রতিবাদ করতে হবে বিচার চাইতে হবে।
এক সময় ধর্ষণ শব্দটাই উচ্চারণ করতে আলাদা সাহসের দরকার হতো, এখন হয় না। এটি নিশ্চয়ই উত্তরণ।
যারা ধর্ষণ করতে চায়, তারা যদি এখন ধর্ষণ না করে, তাহলে কী কারণে করবে না? এর খুব সহজ উত্তর, মৃত্যুদন্ডের ভয়ে। কিন্তু ধর্ষণের ইচ্ছেটা তো তাদের রয়েই যাবে। মাথায় কিলবিল করতে থাকবে ধর্ষণের লোভ। সেটি তো কোথাও যাদুবলে উবে যাচ্ছে না? তবে? আমরা জানি পুরুষের ‘নারীবিদ্বেষী মানসিকতা’ ধর্ষণ ঘটায়, ধর্ষণ ঘটায় টক্সিক মাস্কুলিনিটি বা ‘বিষাক্ত পৌরুষ’। নারীবিদ্বেষী মানসিকতার বা ওই বিষাক্ত পৌরুষের কিন্তু কোনও পরিবর্তন হচ্ছে না। এগুলো পরিবর্তন না করে ধর্ষণের জন্য পোশাক দায়ী স্ট্যাটাসে কোন কাজ হবে না। নারীর শিক্ষা স্বাবলম্বী অর্থবিত্তে এতে সফল হবে তত ধর্ষণ কমে যাবে এতে কোন সন্দেহ নেই। পরিবারের চিন্তা চেতনা পরিবর্তন না করে পোশাকের সঙ্গে ধর্ষণের বিষয়টি বলা খুবই বেমানান অযৌক্তিক অপ্রাসঙ্গিক।
লেখক- ওমর অক্ষর