জন্ম-মৃত্যু নিঃসন্দেহে মানবিক ঘটনা। পরিবেশ পরিস্থিতির ঘনঘটায় এসব আর মানবিক বিষয় থাকছে না। শেষ পর্যন্ত হয়ে উঠছে রাজনৈতিক কৌশলের প্রসঙ্গ। পুত্র হারিয়ে শোকে কাতর বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। দেশে তার নেতৃত্বেই চলছে অনির্দিষ্টকালের অবরোধ। কিন্তু যে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন সে সরকারের প্রধানমন্ত্রীই সমবেদনা জানাতে ছুটে গেছেন খালেদা জিয়ার কাছে। যিনি দেশবাসীর আহ্বান ও দাবির মুখেও বিএনপি নেত্রীর সঙ্গে সংলাপে বসতে রাজি নন। যার নেতৃত্বাধীন সরকারের সিদ্ধান্তের কারণে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে খালেদা জিয়ার চলাচল। কার্যালয়ে কাটাতে হচ্ছে অবরুদ্ধ জীবন। তিনিই যখন শোকগ্রস্ত খালেদা জিয়ার কাছে ছুটে গেলেন, তখন ঘোর অমাবস্যায় একফালি আলোর রেখা দেখলো দেশের ১৬ কোটি মানুষ। দেখলো চলমান দমবন্ধ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের একটি সম্ভাবনার সূত্র। সবার মনে উঁকি দিলো একটি স্বপ্ন। শোককে কেন্দ্র করে হয়তো দূরত্ব কমবে দুই নেত্রীর, যা রাজনৈতিক ইস্যুতে তাদের নমনীয় অবস্থানে আনতে সহায়ক হবে। শোকের দিনে সমবেদনার ভাষাগুলো নিরর্থক হবে না, যা দুই পক্ষকে এক টেবিলে বসাতে রাখবে ইতিবাচক ভূমিকা। কিন্তু তাড়াহুড়ো করে প্রধানমন্ত্রী গেলেন খালেদা জিয়ার কার্যালয়ে। যখন ঘুমের ইনজেকশনের প্রভাবে অচেতন খালেদা জিয়া। খুললো না তার কার্যালয়ের মূল ফটকের তালা। প্রধানমন্ত্রীকে অভ্যর্থনাও জানানো হলো না বিএনপির তরফে। গাড়ি থেকে নেমে রাস্তায় দাঁড়ালেও ফিরে যেতে হলো প্রধানমন্ত্রীকে। শনিবার সন্ধ্যা ৭টা ১০ মিনিট থেকে রাত ৮টা ৪০ মিনিট। দেড় ঘণ্টার মধ্যেই ঘটে গেল অনেক কিছু। মুকুলেই ঝরে গেল সব সম্ভাবনা। তৈরি হলো নতুন বিভ্রম ও বিভ্রান্তি। নতুন করে হালে পানি পেলো অপপ্রচার। শোক পরিণত হলো রাজনীতিতে।
প্রধানমন্ত্রী ফিরে যাওয়ার পর সরকারের তরফে এলো সমালোচনা। বিএনপির তরফে শোককে নিয়ে নোংরা রাজনীতি না করার আহ্বান। কিন্তু যা ঘটার তা তো ঘটেই গেছে। মধ্যরাতে ‘ঘুম ভাঙার পর’ খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ এবং যে কোন সময় স্বাগত জানালেও থামেনি বিভ্রান্তির প্রচার। মানুষের মুখে মুখে ফিরছে নানা প্রশ্ন। বিএনপি কি ভুল করলো? কে নিলো এমন সিদ্ধান্ত? খালেদা জিয়া যদি ইনজেকশনের প্রভাবে ঘুমিয়েই ছিলেন তবে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তইবা দিলো কে? কেউ কেউ বলছেন, খালেদা জিয়া অপরাজনীতির শিকার। তার কাছের লোকজনের কারণে তিনি বারবার ভুল বা অদূরদর্শী সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। আবার কেউ কেউ বলছেন, প্রধানমন্ত্রীইবা এত তাড়াহুড়ো করতে গেলেন কেন? প্রধানমন্ত্রী যাচ্ছেন অথচ বিএনপি চেয়ারপারসন কার্যালয়ে আগে থেকেই কেন দৃশ্যমান হলো না নিরাপত্তা তৎপরতা? দেশের ১৬ কোটি মানুষের স্বার্থে যেখানে খালেদা জিয়ার সঙ্গে সংলাপে অনীহা, সেখানে তার ছেলের মৃত্যুতে কেন শোক প্রকাশের এত আয়োজন? কিন্তু যারা দুই নেত্রীর এ সম্ভাব্য সাক্ষাতের মধ্যে বড় কোন সম্ভাবনার সূত্র দেখতে পেয়েছিলেন, তাদের হতাশা বেশিই। প্রবীণ আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক সমবেদনা জানাতে ছুটে গেছেন খালেদা জিয়ার কার্যালয়ে। কিন্তু যখন প্রধানমন্ত্রী যাওয়ার পর গেট খোলা বা অভ্যর্থনা জানানো হলো না, তখন তিনিই প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বললেন, ‘প্রধানমন্ত্রীকে এভাবে ফিরে যেতে হলো এটা খুবই দুঃখজনক। এখন আমি বলবো সংলাপ হবে না, কিসের সংলাপ! লাত্থি মারি সংলাপের।’
শোকগ্রস্ত খালেদা জিয়াকে সমবেদনা জানাতে প্রধানমন্ত্রীর ছুটে যাওয়া এবং ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসার মধ্যে নানা রকম যুক্তিতর্ক দেখছে বিএনপি নেতৃত্ব ও রাজনৈতিক মহল। বিএনপির শীর্ষপর্যায়ের একজন নেতা জানান, ২০০৬ সালে থেকে একের পর এক বিপর্যয়ের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে খালেদা জিয়ার জীবন। ওয়ান-ইলেভেনের সময় দুই ছেলেসহ কারাভোগ করেছেন দীর্ঘদিন। সত্তরোর্ধ্ব বয়সে পুত্র, পুত্রবধূ ও নাতনিদের ছাড়া তিনি কাটাচ্ছেন নিঃসঙ্গ জীবন। রাজনীতির কারণেই তার দুই ছেলেকে অবস্থান করতে হচ্ছে বিদেশ বিভূঁইয়ে। এ সময়ের মধ্যে প্রথমে মাকে ও পরে ভাইকে হারিয়েছেন। উচ্ছেদ হয়েছেন দীর্ঘদিনের বাসস্থান থেকে। নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে চলমান আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ২১ দিন ধরে তিনি নিজ কার্যালয়ে অবরুদ্ধ। প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছে তার স্বাভাবিক জীবনযাপনে। সর্বশেষ নিজের ছোট ছেলেকে হারিয়েছেন। নিজের ছোট ছেলেকে হারিয়ে শোকে কাতর চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। এমন পরিস্থিতিতে দুই নেত্রীর মধ্যে সাক্ষাৎ হলে কি হতো? ধারণা করা যায়, ফটোসেশন ও কান্নাকাটি ছাড়া তেমন কিছু নয়। কিন্তু দুই নেত্রীর সাক্ষাৎ হলে কি হতে পারতো এবং কেনইবা সাক্ষাৎ হয়নি এ নিয়ে তীব্র কৌতূহল তৈরি হয়েছে জনমনে। তবে বিএনপি সিনিয়র এ নেতা জানান, দুই নেত্রীর মধ্যে সাক্ষাৎ হলে চলমান আন্দোলনে একটি নেতিবাচক প্রভাব পড়তো। ভেঙে যেত চলমান অবরোধ কর্মসূচি। সাধারণ মানুষ প্রশ্ন তুলতে পারতেন, দুই নেত্রীর মধ্যে তো কথা হয়েই গেছে। একজনের শোকের দিনে পাশে দাঁড়ান আরেকজন। তাহলে আর অবরোধ কর্মসূচি কেন? তিনি আরও বলেন, বিএনপি ও ২০ দলীয় জোটের নেতৃত্ব দিচ্ছেন খালেদা জিয়া। নিজ দল ও জোটের শীর্ষ থেকে তৃণমূল পর্যন্ত হাজার হাজার নেতাকর্মী বর্তমানে কারাগারে বন্দি। যদি শোকের পরিবেশে দুই নেত্রীর মধ্যে ফটোসেশন হতো তাহলে কারাবন্দি নেতাকর্মীরা কি বলতেন? তারা প্রশ্ন তুলতে পারতেন- আমরা কি করলাম? ওয়াকিবহাল পর্যবেক্ষকরা বলছেন, খেলাটা ছিল সুপরিকল্পিত। তারা এক ঢিলে দুই পাখি মারতে চেয়েছিলেন। একদিকে শোক জানানো, অন্যদিকে অবরোধের অবসান। সে চালে বিএনপি পা দেয়নি বুঝে হোক, না বুঝে হোক বা পর্দার আড়ালের কোন কূটচালে হোক। বরং উল্টো আওয়ামী লীগের ভেতরে সমালোচনার শুরু হয়েছে। নিছক সামাজিকতার জন্য প্রধানমন্ত্রী সেখানে গেলেন কেন? কারা তাকে এই পরামর্শ দিল। তাকে তো বারণ করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল খালেদা ঘুমিয়ে আছেন।
যদি ব্যক্তিক অবস্থান থেকে বিচার করা হয় তাহলেও সামনে আসে নানা যুক্তি। বিএনপি নেতা জানান, রাজনৈতিক বিরোধিতা রাজনীতিতে স্বীকৃত। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে রাজনৈতিক বিরোধিতার চেয়ে বড় হয়ে উঠেছে পারিবারিক হয়রানি। ওয়ান-ইলেভেনের সময় নানা অভিযোগে মামলা হয়েছিল জিয়া পরিবারের সদস্যদের ওপর। কিন্তু আওয়ামী লীগ আমলে সেসব মামলা এমনভাবে পরিচালিত করা হয়েছে যার মধ্যে প্রতিহিংসার একটি ইঙ্গিত প্রকাশ পায়। যে কোকোর মৃত্যুতে প্রধানমন্ত্রী সমবেদনা জানাতে গিয়েছিলেন তার জামিনের মেয়াদ বাড়ায়নি সরকার। পলাতক দেখিয়ে তার বিরুদ্ধে দেয়া হয়েছে সাজা। প্রতিনিয়ত তার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে কটূক্তি করেছেন প্রধানমন্ত্রীসহ বর্তমান সরকারের মন্ত্রী-এমপি ও আওয়ামী লীগ নেতারা। আবার দেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল ও জোটের শীর্ষ নেত্রী খালেদা জিয়া। সাবেক প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রীও। কিন্তু সর্বোপরি তিনি একজন মা। দলীয় ও পারিবারিক সূত্র জানায়, দুই ছেলের মধ্যে ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর প্রতি একটু বেশি দুর্বল ছিলেন খালেদা জিয়া। তাদের পিতা প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের শাহাদত বরণের সময় কোকোর বয়স ছিল খুবই কম। তার ওপর ছোটবেলা থেকেই কিছুটা রোগাক্রান্ত। ফলে স্বাভাবিকভাবেই তার প্রতি তৈরি হয়েছে এ দুর্বলতা। অন্যদিকে আরাফাত রহমান কোকোও ছিলেন অনেক বেশি মায়ের নির্ভর। কিন্তু ওয়ান-ইলেভেনে পাল্টে যাওয়া পরিস্থিতির ধারাবাহিকতা চলছে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে। এমনিতে দীর্ঘদিন ধরে ছেলে অবস্থান করছেন চোখের আড়ালে। ফলে কোকোর মৃত্যুতে মানসিকভাবে খুবই বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন খালেদা জিয়া। কোন মায়ের কাছে সন্তানের মৃত্যুর চেয়ে বেদনাদায়ক আর কিইবা হতে পারে। পরিস্থিতি এমন হয়েছে, তার ব্যক্তিগত চিকিৎসক তাকে ঘুম পাড়ানোর ইনজেকশন দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
রাজনৈতিক মহল মনে করে, সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিএনপি হয়তো দূরদর্শিতার পরিচয় দিতে পারেনি। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর তরফেও কি রাজনীতিই প্রাধান্য পায়নি? নানা অপবাদ দিয়ে যেখানে বিএনপি ও জিয়া পরিবারকে কোণঠাসা করা হয়েছে, সব মহলের আহ্বানেও যেখানে সংলাপে বসতে অনীহা, সেখানে সে পরিবারের একজনের মৃত্যুতে কেন এত সমবেদনা জানানোর তাড়াহুড়ো? যেখানে প্রস্তুতির একটু সময়ও দেয়া হলো না। তাছাড়া খালেদাকে হুকুমের আসামি করে যেখানে শনিবার দুপুরেই মামলা হয়েছে সেখানে এই শোকের আয়োজন কতটা মানবিক তাও বিবেচনার দাবি রাখে। বিএনপির তরফে দাবি করা হয়েছে, একদিকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে যোগাযোগ করা হয়েছে, অন্যদিকে পরিস্থিতির কথা জানানোর পরও অল্প সময়ের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী সেখানে পৌঁছে গেছেন। সেখানে প্রধানমন্ত্রীকে অভ্যর্থনা জানানোর প্রস্তুতিও ছিল না। সাধারণত প্রধানমন্ত্রী কোথাও গেলে এ ধরনের তাড়াহুড়ো করা হয় না। এ ছাড়া সন্তানহারা কোন মা নিশ্চয়ই মেহমানদারিতে ব্যস্ত বা কোন ভিভিআইপিকে অভ্যর্থনা জানাতে অপেক্ষা করেন না।
রাতে খালেদা জিয়া ‘ঘুম ভাঙার পর’ ধন্যবাদ জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। প্রধানমন্ত্রী ফের যেতে চাইলে স্বাগতও জানিয়েছেন। কিন্তু রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, খালেদা জিয়া চেতনানাশক ইনজেকশনের কারণে ঘুমে থাকলেও প্রধানমন্ত্রীকে অভ্যর্থনা জানিয়ে কার্যালয়ের ভেতরে নিয়ে যেতে পারতেন বিএনপির সিনিয়র নেতৃত্ব। কার্যালয়ের একটি কক্ষে বসিয়ে প্রয়োজনে খালেদা জিয়ার শারীরিক পরিস্থিতির কথাটি বুঝিয়ে বলতে পারতেন। এতে অন্তত সামাজিকতার জয় হতো। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে অসৌজন্যের প্রকাশ ঘটতো না। এ নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি বা অপপ্রচারের সুযোগ তৈরি হতো না। এছাড়া ২১ দিন পর বিএনপি চেয়ারপারসন কার্যালয়ের মূল ফটকের তালা খোলার একটি সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। যে সরকারের সিদ্ধান্তের কারণে তাকে দুই সপ্তাহের বেশি কার্যালয়ে অবরুদ্ধ করা রাখা হয়েছিল, সে সরকারের প্রধানমন্ত্রীর আগমনেই খোলা হতো তালা। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা স্বচক্ষে দেখতে পেতেন কেমন পরিবেশ ও পরিস্থিতির মধ্যে অবরুদ্ধ অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন খালেদা জিয়া। সেখানে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সিনিয়র নেতাদের মধ্যে সৌজন্য আলোচনা নিশ্চয় হতো, যা দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তরণে কিছুটা হলেও ভূমিকা রাখতে পারতো। সবচেয়ে বড় কথা, দুই নেত্রীর সাক্ষাৎ হলে দেশের পরিস্থিতি উত্তরণে তাদের ওপর চাপ প্রয়োগে খানিকটা জোর পেতেন সুশীলসমাজ ও শুভাকাক্সক্ষীরা। এ কথা সত্য, শনিবার রাতের ঘটনায় পরিষ্কার, রাজনৈতিক কৌশলের কাছে হেরে গেছে সামাজিকতা।
রাজনীতি প্রাধান্য পেয়েছে আর কিছু বিবেচনায়। খালেদা জিয়া বা বিএনপি নেতৃত্ব হয়তো চিন্তা করেছেন, আন্দোলনে হতাহত ২০-দলীয় জোটের নেতাকর্মীদের প্রতি যেখানে সরকারের ন্যূনতম সহানুভূতি নেই, সেখানে কোকোর জন্য সহানুভূতির বিষয়টিকে খুব গুরুত্ব দিলে নির্যাতিত নেতাকর্মীদের মধ্যে একটি বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হতে পারে। এছাড়া কোকোর মৃত্যুতে চলমান কর্মসূচির কোন হেরফের হয়নি। তেমন কিছু হলে সেটা আরও বেশি সমালোচনার মুখে ফেলত বিএনপিকে। এক্ষেত্রে খালেদা জিয়া ব্যক্তিগত শোকের চেয়ে রাজনীতি ও দেশের মানুষের মনোভাবের প্রতি প্রাধান্য দিয়েছেন। এছাড়া ফিরে আসছে পুরোনো কিছু ঘটনাও। মুক্তিযুদ্ধের পর দুই নেত্রীর মধ্যে একটি ভাল সম্পর্ক ছিল। স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনেও তারা বারবার কাছে এসেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বামী ওয়াজেদ মিয়ার মৃত্যুতে সমবেদনা জানাতে ছুটে গিয়েছিলেন খালেদা জিয়া। যে কোকোর মৃত্যুতে সমবেদনা জানাতে প্রধানমন্ত্রী ছুটে গিয়েছিলেন তার বিয়েতেও অংশ নিয়েছেন তিনি। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দু’নেত্রীর মধ্যে দূরত্ব ক্রমশই বেড়েছে। সর্বশেষ সশস্ত্রবাহিনী দিবসে সেনাকুঞ্জের অনুষ্ঠানে দু’জন মুখোমুখি হলেও কথা বলেননি। শনিবার রাতে গুলশান কার্যালয়ে কয়েকজন বিএনপি নেতা যুক্তি দেখিয়ে বলেছেন, ২১শে আগস্ট গ্রেনেড হামলার পর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া আক্রান্ত বিরোধী নেত্রী শেখ হাসিনাকে দেখতে তার সুধাসদনের বাসায় যেতে চেয়েছিলেন। সেদিনও আওয়ামী লীগের বিরোধিতার জন্য তিনি যেতে পারেননি। সেটাকে যদি রাজনৈতিক প্রতিহিংসা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, জিয়া পরিবারের প্রতি সরকারের পদক্ষেপ ও বিদেশ বিভূঁইয়ে আরাফাত রহমান কোকোর মামলা এবং সাজা মাথায় নিয়ে মৃত্যুও প্রতিহিংসার দৃষ্টিকোণের বাইরে থাকে না।
যাই হোক, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান কার্যালয় থেকে বেরিয়ে সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘খালেদা জিয়া অসুস্থ এবং তার কক্ষের দরজা বন্ধ করে রাখা হয়েছে। কাউকে সেখানে যেতে দেয়া হচ্ছে না।’ এছাড়া ২০-দলীয় জোটের রাজনীতির অন্যতম প্রভাবশালী রাজনৈতিক কর্নেল (অব.) অলি আহমদ গুলশান কার্যালয় থেকে বেরিয়ে সাংবাদিকদের বলেছেন, মানসিক বিপর্যয় থেকে কিছুটা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন খালেদা জিয়া। তার বরাত দিয়ে টেলিভিশনে এ সংবাদ প্রচারও করা হয়েছে। তাহলে সে বিষয়টি কেন প্রধানমন্ত্রীর তরফে আমলে নেয়া হলো না। খালেদা জিয়ার কার্যালয়ে প্রধানমন্ত্রীকে অভ্যর্থনা না জানানো নিয়ে পাল্টাপাল্টি যুক্তি এখন মুখরিত রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের মুখে। কেউ বলছেন, প্রধানমন্ত্রীকে অভ্যর্থনা না জানিয়ে অসৌজন্য আচরণ করা হয়েছে। এটা চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলবে। আবার কেউ বলছেন, ধরা যাকÑ বিএনপি প্রধানমন্ত্রীকে অভ্যর্থনা জানালেন কার্যালয়ে নিয়ে গেলেন। কিন্তু খালেদা জিয়া তখন ঘুমে অচেতন। তিনি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে পারলেন না। তখনও তো অপপ্রচারের সুযোগ তৈরি হতো। যারা সবকিছুর মধ্যে রাজনীতি খুঁজেন তারা হয়তো বলতেন, প্রধানমন্ত্রী গেলেন অথচ খালেদা জিয়া বিছানা থেকে উঠলেন না। তবে নানা বিভ্রান্তির ভেতরও দু’টি বিষয় ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখছেন সবাই। প্রথমত, রাতে ঘুম ভাঙার পর প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন খালেদা জিয়া। যে কোন সময় স্বাগতও জানিয়েছেন। দ্বিতীয়ত, বিএনপির তরফে অভ্যর্থনা জানানো না হলেও সেখানে উপস্থিত বিপুল পরিমাণ বিএনপি নেতাকর্মী প্রধানমন্ত্রীর গাড়িবহর বা আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে বিরূপ আচরণও করেননি।
যা ঘটেছিল সে দেড় ঘণ্টায়
সন্ধ্যা তখন ৭টা ১০ মিনিট। প্রধানমন্ত্রী কার্যালয় থেকে একটি ফোন এলো বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ে। ফোনটি রিসিভ করলেন কার্যালয়ের একজন কর্মকর্তা। অপরপ্রাপ্ত থেকে চাওয়া হলো বিএনপি চেয়ারপারসনের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা প্রধানের ফোন নম্বর। ঘটনার আকস্মিকতায় ওই কর্মকর্তা ফোনটি দিলেন আরেক কর্মকর্তার হাতে। ততক্ষণে সেখানে উপস্থিত হলেন নিরাপত্তা প্রধান কর্নেল (অব.) আবদুল মজিদ। তিনি ওই কর্মকর্তাকে বললেন, খালেদা জিয়ার বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাসের নম্বরটি দিতে। কিন্তু অপর প্রান্তে তখন বলা হলো, নিরাপত্তা প্রধানের নম্বর দরকার, বিশ্বাস কে? যা হোক, পরে শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাসের সঙ্গেই আলাপ করলেন প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের কর্মকর্তা। শিমুল বিশ্বাস খালেদা জিয়ার কক্ষ ঘুরে এসে এবং কয়েকজন সিনিয়র নেতার সঙ্গে আলাপ করে যোগাযোগ করলেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে। জানিয়ে দেয়া হল, মানসিকভাবে বিপর্যস্ত অবস্থায় অসুস্থ বোধ করলে চিকিৎসক তাকে ঘুমের ইনজেকশন দিয়েছেন। পরে তার ঘুম ভাঙলে কথা বলে প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ে জানানো হবে। কিন্তু ততক্ষণে টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে স্ক্রল দেয়া শুরু হয়েছে যে, প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার কার্যালয়ের উদ্দেশে রওনা দিয়েছেন। রাত তখন ৮টা ১০ মিনিট। খালেদা জিয়ার কার্যালয়ের চারপাশে অবস্থান নিলেন পিজিআর-এর একটি দল। পুলিশ এবং গোয়েন্দাদের কিছু তৎপরতাও শুরু হলো। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী যাবেন অথচ কার্যালয়ে ভেতরে এবং উঠোনে থাকা বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মীদের সরিয়ে দেয়ার কোন উদ্যোগ দেখা গেল না। সন্ধ্যার পর পকেট গেট খোলা থাকায় সেখানে তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না তখন। এক পর্যায়ে নিরাপত্তাকর্মীরা বাধ্য হয়ে পকেট গেটে তালা লাগিয়ে দেয়। এ নিয়ে ছাত্রদলের কয়েকজনের সঙ্গে তাদের হাতাহাতির ঘটনাও ঘটে। রাত তখন ৮টা। কার্যালয়ের উঠোনে সাংবাদিকদের ব্রিফিং করলেন শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস। তিনি প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের যোগাযোগ এবং খালেদা জিয়ার অসুস্থতার কথা জানিয়ে বললেন, তার ঘুম ভাঙলে ফের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে যোগাযোগ করা হবে। তার এমন ব্রিফিংয়ে সবাই ধরে নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর আসা হচ্ছে না। কিন্তু মাত্র ৫ মিনিটের ব্যবধান। শিমুল বিশ্বাস কার্যালয়ের ভেতরে ঢোকার পর মুহূর্তে ৮টা ৩৫ মিনিটে কার্যালয়ের সামনে হাজির প্রধানমন্ত্রীর গাড়িবহর। প্রধানমন্ত্রী গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালেন। কিন্তু দায়িত্বশীল কারও নির্দেশ না পাওয়ার কারণে গেট খুলল না নিরাপত্তাকর্মীরা। ফের গাড়িতে চড়ে বসলেন প্রধানমন্ত্রী। খবর পেয়ে শোকবই হাতে ছুটে এলেন শিমুল বিশ্বাস। তিনি গেটের বাইরে দাঁড়ানো প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী (মিডিয়া) মাহবুবুল হক শাকিলের সঙ্গে কয়েকটি বাক্যবিনিময় করলেন। শিমুল বিশ্বাস তাদের জানালেন খালেদা জিয়া ইনজেকশনের প্রভাবে ঘুমে। সময় তখন ৮টা ৪০ মিনিট। মাহবুবুল হক শাকিলের হাতের ইশারা পেয়ে ফিরতি পথে চলতে শুরু করল প্রধানমন্ত্রীর গাড়িবহর। বাইরে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বললেন প্রধানমন্ত্রী উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী। পুরো ঘটনাটি ঘটলো একটি দমবদ্ধ নীরব পরিবেশের ভেতরে।