ঢাকা: এক সময় শিশু-কিশোরদের পদভারে মুখরিত ছিল বিদ্যালয়ের আঙিনা। প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত চলত লেখা পড়া। বাবা মায়েরা আদরের সন্তানের জন্য অপেক্ষা করতেন বিদ্যালয়ের আঙিনায়। শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি তাদের অভিভাবকদের জন্যও তৈরী করতে হতো বসার জায়গা। ফুল আর পাখিদের মত শিশুদের কলকাকলিতে উৎসবমূখর বিদ্যালয়ের আঙিনাগুলো এখন শুধুই স্মৃতি। বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগীতায় অতিথি, প্রধান অতিথিদিরে নিকটও ছিল শিক্ষকদের কদর। জাতীয় দিবসগুলোতে বিপুল পরিমান শিক্ষার্থীর অংশ গ্রহন অনুষ্ঠানের সাফল্যকে মন্ডিত করত। তাই সরকারী কর্মকর্তারাও কিন্ডারগার্ডেনগুলোকে বেশী টানাটানি করতেন। আজ সবই স্মৃতি। স্মৃতির এ্যালবাম।
হৃদয়কে ভেঙে দিতে পারে এমন একাধিক ঘটনার মধ্যে একটি হল, যে সকল অভিভাবকেরা অধ্যয়নরত সন্তানদের জন্য বিদ্যালয়ের আঙিনায় অপেক্ষা করতেন, আর মাঝে মাঝে শিক্ষক ও কর্মচারীরা হালকা টিফিন হাতে করে অভিভাবকদের আপ্যায়ন করতেন, সেই শিক্ষকদের কেউ কেউ এখন ওই অভিভাবকদের বাসায় অনিচ্ছাকৃত মেহমান। সময়ের ব্যবধানে আতিথিয়তার ভিন্নতা আসলেও আশারও তীব্রতা বিদ্যমান যে, আবারো সেই ভ্যানুতে আপ্যায়ন হবে, আনন্দে ও উন্মদনায় ভরে উঠবে শিক্ষালয়ের আঙিনা, বসবে রীতিমত জম্পেস আড্ডা।
করোনায় বন্ধ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সরকারী ও এমপিও ভুক্ত শিক্ষকেরা বেতন পাচ্ছেন। কিন্তু অভুক্ত আছেন যাদের জীবিকায় সরকারী ছোঁয়া পড়েনি এমন ১২লাখ শিক্ষক। বিদ্যালয়ের ভাড়া ও শিক্ষক কর্মচারীদের বেতন নেই। ইতোমধ্যে বেকার হয়ে যাওয়া শিক্ষকেরা রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছেন। বেঁচে থাকার জন্য তারা শিক্ষকতা ছেড়ে রিকশাচালক, ভ্যানচালক, ফলবিক্রেতা, রাজমিস্ত্রি এমনকি না বলা পেশাও চলে যাচ্ছেন। কেউ আবার প্রিয় বিদ্যালয়ের আঙিনায় ফুল ও ফলের চাষ করে প্রতিষ্ঠানের ভাড়া আয় করার চেষ্টা করছেন। অভিযোগ হয়েছে, আর্থিক চাপ ও চরম হতাশায় অনেকটা না খেয়েেই মারা গেছেন ১৪ শিক্ষক।
বর্তমানে তারা বিদ্যালয়গুলো খুলে দেয়ার জন্য সরকারের কাছে আনুষ্ঠানিক দাবী করেছেন। শনিবার(১৭ অক্টোরব) তাদের প্রতিষ্ঠান না খুললে তারা বড় ধরণের আন্দোলনে যাবেন বলে জানিয়েছেন সংবাদ সম্মেলন করে।
জানা গেছে, ১২ লাখ শিক্ষক-কর্মচারীর জীবন বিপর্যয়ের মুখে উল্লেখ করে আগামী ১৭ অক্টোবরের মধ্যে বিদ্যালয় খুলে দেওয়াসহ তিন দফা দাবী জানিয়েছেন কিন্ডারগার্ডেন শিক্ষকরা। ১১ অক্টোবর জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে শিক্ষকদের পক্ষে এ দাবি জানিয়েছে কিন্ডারগার্ডেন ও সমমান স্কুল রক্ষা জাতীয় কমিটি।
সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনটির সদস্য সচিব জাহাঙ্গীর কবীর রানা লিখিত বক্তব্যে বলেন, করোনা মহামারির কারণে ১৭ মার্চ থেকে সরকারি নির্দেশে সারাদেশে প্রায় ৪০ হাজার কিন্ডারগার্ডেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত প্রায় ৮ লাখ শিক্ষক এবং অন্যান্য কর্মচারী মিলিয়ে প্রায় ১২ লাখ শিক্ষক-কর্মচারীর জীবন আজ বিপর্যয়ের মুখে। আর্থিক চাপ ও চরম হতাশায় নিপতিত হয়ে এর মধ্যে ১৪ জন শিক্ষক আত্মহত্যা ও হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। অনেক শিক্ষক পেশা পরিবর্তন করে রিকশাচালক, ভ্যানচালক, ফলবিক্রেতা অথবা রাজমিস্ত্রির কাজ করছেন।
তিনটি মূল দাবি তুলে ধরে তিনি বলেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে আগামী ১৭ অক্টোবরের মধ্যে বিদ্যালয় খুলে দিতে হবে, শিক্ষক কর্মচারীদের জন্য একটি সম্মানজনক বরাদ্দ দিতে হবে এবং আমাদের বিদ্যালয়গুলোতে স্ব স্ব শিক্ষার্থীদের বার্ষিক পরীক্ষা নেওয়ার মাধ্যমে মেধা মূল্যায়নের সুযোগ করে দিতে হবে।
সংগঠনটির আহ্বায়ক সংবাদ সম্মেলনে সভাপতির বক্তব্যে মিজানুর রহমান সরকার বলেন, পৃথিবীর অনেক দেশে বিদ্যালয় খোলা। দেশের সবকিছু খোলা। দেশের আর কোনো খাত দেখলে বোঝা যাবে না যে, এ দেশে করোনা বলতে কিছু আছে। শুধু আমাদের বেলাতেই করোনা। অথচ এ খাতে প্রায় ৫০ লাখ মানুষ নির্ভরশীল।
অনুসন্ধানে জানা যায়, করোনার প্রথম ঢেউ মোকাবেলায় সরকারের প্রস্তুতি ও করণীয় পদক্ষেপগুলোর মধ্যে বেঁচে থাকারমত কোন সহায়তা পাননি এই বিশাল অংকের শিক্ষকেরা। লেখাপড়া করে চাকুরী না পেয়ে বাধ্যগতভাবে শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে নিয়েছেন তারা। বিদ্যালয়ের মালিকেরা শিক্ষকতার পাশাপাশি কর্মসংস্থানের সুযোগও তৈরী করেছেন। কিন্তু করোনার কারণে সবই এখন ফিকে হয়ে গেছে। করোনার প্রথম ঢেউয়ে ভেসে যাওয়া এই শিক্ষকেরা বড় করে আসার আশংকায় দ্বিতীয় ঢেউয়ে কোথায় গিয়ে নোঙর করবেন ,সেটা ভেবে দেখা দরকার।
সাধারণ মানুষ বলছেন, আন্দোলন তীব্র করে দাবী না মেনে আন্দোলন হওয়ার আগে দাবীগুলো বিবেচনা করা উচিত। কারণ আন্দোলন হলে জনজীবন ও অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্থ হয়। মানুষের স্বাভাবিক জীবন থেমে যায়। তাই সরকারের উচিত আগামী শনিবারের মধ্যে বিষয়টির ফয়সালা করা।