সিলেটে পুলিশ হেফাজতে রায়হান আহমদের (৩০) মৃত্যুর ঘটনায় নির্যাতনের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়ার পর নগরীর বন্দরবাজার ফাঁড়ি ইনচার্জ আকবর হোসেন পালিয়ে গেছেন।
এর আগে আকবরসহ পুলিশের চার সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত এবং তিনজনকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। এই অমানবিক নির্যাতন চালানো হয়েছে ফাঁড়ি ইনচার্জ আকবরের নেতৃত্বে।
সোমবার বিকাল ৫টা পর্যন্ত আকবর তদন্ত কমিটির সামনে উপাস্থিত ছিলেন। এবং তাকে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ এলাকা না ছাড়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। এক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, গতরাত থেকে তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
ধারণা করা হচ্ছে, এসআই আকবর মূলত গ্রেফতার এড়াতেই পালিয়েছেন। তাকে ধরতে বিভিন্ন স্থানে পুলিশের অভিযান চলছে।
গত রোববার রায়হানের মৃত্যুর ঘটনা তদন্তে এসএমপির উপ-কমিশনার (ডিসি-উত্তর) আজবাহার আলী শেখের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন, এসএমপির অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি ক্রাইম দক্ষিণ) এহসানুদ্দিন চৌধুরী, এডিসি ক্রাইম উত্তর শাহরিয়ার আল মামুন ও সহকারী কমিশনার (এসি এয়ারপোর্ট) প্রভাশ কুমার সিং।
কমিটির সূত্রে জানা যায়, সোমবার বিকাল ৩টা পর্যন্ত বন্দর ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই আকবরসহ সাত পুলিশ সদস্যকে দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে ইনচার্জ আকবর প্রথমে রায়হানকে ফাঁড়িতে নেয়ার বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করেন। পরে তদন্ত কমিটির সংগ্রহ করা সিলেট পুলিশ সুপারের কার্যালয়ের সিসি ক্যামেরার ফটেজ দেখানো হলে এসআই আকবরসহ একে একে সবাই মুখ খুলতে শুরু করেন।
সিসি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা যায়, শনিবার রাত ৩টা ৯ মিনিটের দিকে দুটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা এসে বন্দর বাজার ফাঁড়িতে এসে থামে। সামনের অটোরিকশা থেকে তিন পুলিশ সদস্যের সাথে রায়হানকে দেখা যায়। তিনি হেঁটে পুলিশের সাথে ফাঁড়িতে ঢুকছেন।
প্রায় তিন ঘণ্টা পর সকাল ৬টা ২২ মিনিটে একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা আসে বন্দর ফাঁড়ির সামনে। এর দুই মিনিট পর ৬টা ২৪ মিনিট ২৪ সেকেন্ডে দুই পুলিশের কাঁধে ভর করে রায়হানকে সেই অটোরিকশায় তুলতে দেখা যায়।
আকবরসহ বাকি সদস্যরা তদন্ত কমিটিকে জানান, শনিবার রাত আড়াইটার দিকে দু’জন লোক সোবহানীঘাট থেকে কাস্টঘর রোড দিয়ে যাচ্ছিল। পথে সুইপার কলোনির গেটের পাশে তাদের আটক করে ছিনতাইকারীরা। চাকু দিয়ে ট্রাউজারের পকেট কেটে তাদের টাকা-পয়সা নিয়ে পাশের সুইপার সুলাইলালের ঘরে ঢুকে যায় তিন ছিনতাইকারী।
এরপর ছিনতাইয়ের শিকার লোকজন মহাজনপট্টি দিয়ে বের হয়ে নগরীর বন্দরবাজারের মশরাফিয়া রেস্টুরেন্টে দুই পুলিশকে (কোতোয়ালি থানার মুন্সি ও এক অপারেটর) নাশতা করতে দেখে।
তারা পুলিশকে ছিনতাইয়ের বিষয়টি জানায়। পুলিশ ইকো-১-কে মোবাইলে কল দিয়ে এ খবর জানায়। এরপর ইকো-১-এর ওয়্যারলেস অপারেটর কনস্টেবল আবু তাহের এএসআই আশিক এলাহীর টিমকে খবর পাঠান। টিমের অন্য সদস্যরা হলেন, কনস্টেবল তৌহিদ মিয়া ও হারুনুর রশিদ। তারা গিয়ে ঘটনাস্থল থেকে ভিকটিমের উপস্থিতিতে রায়হানকে আটক করে। তার সাথে থাকা দু’জন দৌড়ে পালিয়ে যান। পরে রায়হানকে ফাঁড়িতে নিয়ে আসা হয়।
এ সময় এএসআই আশিক এলাহী ছিনতাইয়ের শিকার লোকের নাম-পরিচয় রাখেননি বলে তদন্ত কমিটিকে জানান।
ইনচার্জ আকবর চুপ থাকলেও আটককারী সদস্যরা কমিটিকে জানান, ফাঁড়িতে নিয়ে আসার পর এসআই আকবরের নেতৃত্বে রায়হানকে নির্মমভাবে নির্যাতন করা হয়। তার নির্দেশেই তৌহিদের ফোনে রায়হান তার মায়ের সাথে কথা বলে ১০ হাজার টাকা নিয়ে আসতে বলেন।
এ ঘটনায় সোমবার বিকালে ফাঁড়ি ইনচার্জ এসআই আকবর হোসেন ভূঁইয়াসহ চারজনকে সাময়িক বরখাস্ত ও তিনজনকে প্রত্যাহার করা হয়। তদন্ত কমিটির প্রধান ও এসএমপির উপকমিশনার (ডিসি উত্তর) আজবাহার আলী শেখ এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
আজবাহার আলী শেখ জানান, ঘটনার পর থেকে প্রাথমিক তদন্তের ফলাফল বিশ্লেষণ করে বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে এক আদেশে চারজনকে সাময়িক বরখাস্ত ও তিনজনকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। বরখাস্ত হওয়া অন্য তিনজন হলেন, কনস্টেবল তৌহিদ মিয়া, টিটু চন্দ্র দাশ ও হারুনুর রশীদ। আর প্রত্যাহার করা তিনজন হলেন, এএসআই আশেক এলাহী, কুতুব আলী ও কনস্টেবল সজীব হোসেন।
পুলিশের একটি সূত্র জানায়, বরখাস্ত ও প্রত্যাহার করা সাত পুলিশ সদস্যকে নিয়ে আরেক দফা তদন্ত চলছে। এই তদন্তের পর এদের মধ্য থেকে রায়হান হত্যা মামলায় আসামি করা হতে পারে।
শনিবার রাতে রায়হানকে বন্দরবাজার ফাঁড়িতে ধরে নিয়ে ১০ হাজার টাকা ঘুষ দাবি করে পুলিশের কয়েকজন সদস্য। ফোনে পরিবারের সদস্যদের টাকা নিয়ে আসতে বলেন রায়হান। রোববার সকালে পাঁচ হাজার টাকা নিয়ে তার পরিবারের সদস্যরা থানায় গিয়ে জানতে পারেন, অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাকে ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। সেখানে গিয়ে শুনেন রায়হান মারা গেছেন।