চা-কফি খেতে খেতে আলাপন। হাস্যোজ্জ্বল বারাক ওবামা ও নরেন্দ্র মোদি। মার্কিন প্রেসিডেন্টের কাপে এ সময় চা-ও ঢেলে দেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। একান্ত মুহূর্তে দুই নেতা, গতকাল নয়াদিল্লির হায়দরাবাদ হাউসের বাগানে l ছবি: রয়টার্স n আরও ছবি: পৃষ্ঠা–৭কুয়াশামাখা সকালে এয়ার ফোর্স ওয়ান থেকে নেমে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা যখন প্রটোকল ভেঙে বিমানবন্দরে উপস্থিত ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন, তখনই বোঝা গেল, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের নতুন চিত্রনাট্য রচিত হতে চলেছে। দিন শেষের আগেই সেই চিত্রনাট্যের মূল উপাদানগুলো ঘোষিত হলো।
ছয় বছর ধরে বাস্তবায়িত না হয়ে ঝুলে থাকা পরমাণু চুক্তির বাণিজ্যিকীকরণ দুই রাষ্ট্রনায়কের হস্তক্ষেপে এগিয়ে গেল; আরও ১০ বছরের জন্য ‘নবায়ন’ হলো দুই দেশের মধ্যে সম্পাদিত প্রতিরক্ষা চুক্তি; মোদি-ওবামা ও দুই দেশের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টাদের মধ্যে ‘হট লাইন’ চালু করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হলো এবং সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াইকে সর্বাত্মক করে তুলতে অঙ্গীকারবদ্ধ হলেন দুজনে। সন্ধ্যায় হায়দরাবাদ হাউসে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে দুই রাষ্ট্রনায়কই জানালেন, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের এক অনন্য অধ্যায় রচিত হলো এই সফরে।
গতকাল রোববার স্থানীয় সময় সকাল ৯টা ৪০ মিনিটে নয়াদিল্লির পালাম বিমানঘাঁটিতে অবতরণ করে মার্কিন প্রেসিডেন্টকে বহনকারী বিমান এয়ার ফোর্স ওয়ান। সেখানে প্রেসিডেন্ট ওবামা ও ফার্স্ট লেডি মিশেল ওবামাকে স্বাগত জানান মোদি। ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে তিন দিনের সফরে ভারতে এসেছেন ওবামা।
২০০২ সালের গুজরাট দাঙ্গার কারণে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের কাছে দীর্ঘদিন ধরে একঘরে হয়েছিলেন সেই সময়কার গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী মোদি। যুক্তরাষ্ট্রে ঢোকার জন্য তাঁকে অনেক দিন ভিসা দেওয়া হয়নি। কিন্তু গত বছর মোদি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর পাল্টে যায় সবকিছু। মোদিকে সানন্দে গ্রহণ করে ওয়াশিংটন।
তবে এসব ভুলে প্রজাতন্ত্র দিবসের অনুষ্ঠানে মার্কিন প্রেসিডেন্টকে আমন্ত্রণ জানান মোদি। সেই আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো ভারত সফরে রাজি হয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করলেন ওবামা। ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসের অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়া প্রথম মার্কিন প্রেসিডেন্ট হতে যাচ্ছেন তিনি। আজ ২৬ জানুয়ারি ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবস।
দুপুরে হায়দরাবাদ হাউসে মোদির সঙ্গে বৈঠকের আগে ওবামা যান প্রেসিডেন্টের প্রাসাদ রাষ্ট্রপতি ভবনে। সেখানে তাঁকে স্বাগত জানান রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখাির্জ। এ সময় গার্ড অব অনার দেন সশস্ত্র বাহিনীর চৌকস সদস্যরা। ২১ বার দাগা হয় তোপোধ্বনি। পরে রাজঘাটে যান ওবামা। সেখানে তিনি শ্রদ্ধা জানান ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের নায়ক মহাত্মা গান্ধীর প্রতি।
ওবামা ভারত সফরে রাজি হওয়ার পর থেকে দুই দেশের কূটনীতিকেরা বকেয়া বিষয়গুলোর নিষ্পত্তির জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছিলেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও লন্ডন বৈঠকে পরমাণু চুক্তি নিয়ে মীমাংসা না হওয়া এবং যাবতীয় ভারতীয় চুল্লির ওপর নজরদারির মার্কিন দাবিতে গোটা আলোচনা থমকে যায়। গতকাল দুপুরে হায়দরাবাদ হাউসের লনে মোদি-ওবামার একান্তে হাঁটা-চলা এবং এরপর চায়ের আসরে (ওবামার কাপে মোদি নিজে হাতে চা ঢেলে দেন) দুজনে অমীমাংসিত বিতর্কের অবসান ঘটান।
সন্ধ্যায় ওবামা সাংবাদিকদের সে কথা জানিয়ে বললেন, ‘আমরা অসামরিক পারমাণবিক চুক্তির অচলাবস্থা কাটিয়েছি এবং এই চুক্তির পূর্ণ রূপায়ণের দিকে এগিয়ে চলেছি।’
নরেন্দ্র মোদিও বলেন, ‘আমাদের দেশের আইন ও আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতা মেনে প্রযুক্তি ও বাণিজ্যিকভাবে অর্থবহ করে তুলে পরমাণু চুক্তির বাণিজ্যিক সহযোগিতার দিকে আমরা এগোচ্ছি।’
দুই নেতার এই মন্তব্য থেকে দিনের শেষে এটা বোঝা গেল, ভারতীয় পারমাণবিক চুল্লিগুলোর চিরন্তন পর্যবেক্ষণের মার্কিন দাবি এবং দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে দায়বদ্ধতা সম্পর্কিত ভারতীয় আইন—এ দুই অনড় অবস্থান থেকে দুই দেশই খানিকটা নেমে এসেছে। কিন্তু তার চরিত্র কী, বিশেষ করে দায়বদ্ধতার ক্ষেত্রে, তা রাত পর্যন্ত পুরোটা স্পষ্ট নয়।
এক সূত্রে জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্র শুধু তাদের সরবরাহ করা চুল্লিগুলোই পর্যবেক্ষণ করতে পারবে, অন্য দেশের সরবরাহের ওপর নয়। মার্কিন কোম্পানিগুলোও তাদের দায়বদ্ধতা পুরোপুরি ঝেড়ে ফেলতে পারবে না। বিমা কোম্পানিগুলো এ ক্ষেত্রে দায়িত্ব নিতে বাধ্য থাকবে।
এ দুটি বিষয়ই প্রধানত দুই দেশের গলায় খচখচ করছিল। ১০ বছরের জন্য প্রতিরক্ষা সহযোগিতা চুক্তি যে ফের বাড়বে, সে বিষয়ে বিশেষ সন্দেহ ছিল না। এ চুক্তি নবায়নের মধ্য দিয়ে দুই রাষ্ট্রনায়ক খুলে দিলেন প্রতিরক্ষা সহযোগিতার নতুন সম্ভাবনা। ভারত ইতিমধ্যেই এ খাতে বিদেশি বিনিয়োগের হার ২৬ থেকে বাড়িয়ে ৪৯ শতাংশ করেছে। প্রধানমন্ত্রীও বারবার ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’র ডাক দিয়েছেন। সমরাস্ত্র রপ্তানিতে রাশিয়ার আধিপত্যও ক্রমে হ্রাস পাচ্ছে। ফলে ভারতে বিভিন্ন যুদ্ধাস্ত্র তৈরি এবং তার পাশাপাশি প্রযুক্তির হাতবদলে আমেরিকার হাত বাড়ানোর এক অপার সম্ভাবনা খুলে যাচ্ছে। মোদি সেই সুযোগটাই নিতে চেয়েছেন এবং ওবামাও তাতে সমর্থন দিয়েছেন।
মোদি বলেছেন, ‘আমরা আজ প্রতিরক্ষা সহযোগিতাকে এক অন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কিছু কিছু প্রকল্প একযোগে উৎপাদন করার নীতিগত সিদ্ধান্ত আমরা আজ নিয়েছি। এতে আমাদের দেশি প্রতিরক্ষাশিল্প যেমন প্রসার পাবে, তেমনই উৎপাদন শিল্পেরও বিকাশ ঘটবে। উন্নতমানের প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রগুলোতেও সহযোগিতার বিষয় আমরা খতিয়ে দেখব।’
পারস্পরিক বিশ্বাস ও আস্থা এ সম্পর্ককে কতখানি গুরুত্ব দিয়েছে, তার প্রমাণ দুটি হটলাইন স্থাপনের সিদ্ধান্ত। একটি হটলাইন হবে মোদি ও ওবামার মধ্যে, অন্যটি দুই দেশের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টাদের মধ্যে। এত বছরের সম্পর্কে এই হটলাইন স্থাপনের কোনো প্রয়োজনীয়তা কোনো দেশই অনুভব করেনি। দুই নেতা একে অন্যের কতটা কাছাকাছি, এ সিদ্ধান্ত তারই প্রমাণ। ভারতকে আমেরিকার কতটা প্রয়োজন, তা যেমন এই সফরে বোঝা গেল, তেমনই বোঝা গেল মোদি-ওবামা কতখানি কাছে এসে পড়েছেন।
সংবাদ সম্মেলনে মোদি একাধিকবার ওবামাকে তাঁর প্রথম নামে ‘বারাক’ বলে সম্বোধন করেছেন। বলেছেন, ‘আমাদের সম্পর্কে একটা ব্যক্তিগত রসায়ন রয়েছে। কাগজের কমা-পূর্ণচ্ছেদের চেয়ে এ সম্পর্ক ও রসায়ন বেশি জরুরি।’
প্রত্যুত্তরে ওবামাও হিন্দিতে বলেছেন, ‘নমস্তে, মেরা পেয়ার ভরা নমস্কার।’ তারপর মোদিকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘চায় পে চর্চা’র (মোদি নিজে ওবামার কাপে চা ঢেলে দিয়েছেন) জন্য ধন্যবাদ। এমন আরও অনেক শীর্ষ বৈঠক হোয়াইট হাউসে দেখতে চাই।’
ওবামার সফরসঙ্গী বাণিজ্যিক প্রতিনিধিদলের সঙ্গে দুই দেশের শিল্পোদ্যোগীদের বৈঠক হচ্ছে। আজ সোমবার ভারত-মার্কিন বিজনেস কাউন্সিলের বৈঠকও রয়েছে। মোদি-ওবামা একযোগে আকাশবাণী মারফত ‘মন কি বাত’ অনুষ্ঠানেও অংশ নেবেন।