ঢাকা: ভারতের সঙ্গে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি করতে ব্যর্থ হওয়ার পরে চীনের সমর্থন নিচ্ছে বাংলাদেশ। তারা তিস্তা বিষয়ক একটি প্রকল্পে চীনের কাছ থেকে ১০০ কোটি ডলারের বেশি অর্থ নিচ্ছে। তিস্তা নদী ব্যবস্থাপনা এবং পানি সংরক্ষণ বিষয়ক চীনের এমন প্রস্তাব এখন বিবেচনা করছে বাংলাদেশ সরকার। তিস্তা হলো বাংলাদেশের চতুর্থ সর্ববৃহৎ নদী। ভারত থেকে তা বাংলাদেশে প্রবাহিত হয়েছে। অনলাইন দ্য থার্ড পোল ডট নেট-এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে। এতে সাংবাদিক পিনাকী রয় লিখেছেন, ভারতের সঙ্গে তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে চুক্তি চূড়ান্ত করতে প্রায় এক দশক ব্যয় করেছে বাংলাদেশ। এমন অবস্থায় চীনের ওই প্রস্তাব এলো।
ভারতের সঙ্গে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি ২০১১ সালে শেষ মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরোধিতার কারণে স্থগিত হয়ে যায়। তারপর থেকে ভারতের সঙ্গে দরকষাকষিতে আর কোনো অগ্রগতি করতে পারেনি বাংলাদেশ। এরই মধ্যে বাংলাদেশ দেখতে পেয়েছে, উজানে ড্যাম নির্মাণ, সেচ ক্যানাল খনন ও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে শুষ্ক মৌসুমে তিস্তায় পানির স্তর নাটকীয়ভাবে কমে যায়। এ অবস্থায় ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কে আরো টান ধরেছে।
শুষ্ক মৌসুমে কৃষকরা ফসল উৎপাদন করতে পারেন না। ২০১৬ সালে শুষ্ক মৌসুমে পানির স্তর নেমে দাঁড়ায় ৩০০ কিউসেক। দুই দশক আগের চেয়ে এই পরিমাণ ২০ গুণেরও বেশি কম। তাই চীন সমর্থিত নতুন তিস্তা নদী ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণাগার নির্মাণ প্রকল্প বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে বসবাসকারীদের মধ্যে আশার আলো দেখাচ্ছে। এসব মানুষ বর্ষা মৌসুমে বন্যা ও নদীভাঙনের শিকারে পরিণত হন। আবার শুষ্ক মৌসুমে মারাত্মক পানি সংকটে ভোগেন। দ্য থার্ড পোল’কে পানিসম্পদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কবির বিন আনোয়ার চীনের দিকে ইঙ্গিত করে বলেছেন, আমরা একটি প্রস্তাব পেয়েছি। এখন একটি চুক্তি চূড়ান্ত করতে তাদের সঙ্গে আমাদের শর্ত ঠিক করতে আলোচনায় বসার প্রয়োজন।
উল্লেখ্য, হিমালয়ের পূর্বাঞ্চলে জন্ম নিয়ে তিস্তা প্রথমে ভারতের সিকিম রাজ্যের ভিতর দিয়ে পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ করেছে। তারপর তা বাংলাদেশে এসে মিশে গেছে ব্রহ্মপুত্র নদের সঙ্গে। এরপর সম্মিলিত স্রোতধারা গিয়ে পতিত হয়েছে বঙ্গোপসাগরে। এই নদীর ৩১৫ কিলোমিটার চলার পথে ১০০ কিলোমিটারের কিছু বেশি রয়েছে বাংলাদেশে। এই চলার পথে প্রায় ২ কোটি ১০ লাখ মানুষ তাদের জীবনজীবিকা ও অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের জন্য নির্ভর করেন তিস্তার ওপর।
তিস্তা শাসন: ‘তিস্তা রিভার কমপ্রিহেনসিভ ম্যানেজমেন্ট এন্ড রিস্টোরেশন প্রজেক্ট’ বাস্তবায়নের জন্য গত জুলাইয়ে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় ৯৮ কোটি ৩০ লাখ ডলার ঋণ চায় চীনের কাছে। এতে বলা হয়, প্রকল্পের মোট ব্যয়ের শতকরা ১৫ ভাগ বহন করবে বাংলাদেশ সরকার। বাকিটা তারা চীনের কাছ থেকে সহায়তা হিসেবে চায়। প্রতি বছর হিমালয় থেকে বিপুল পরিমাণ পলিমাটি বহন করে তিস্তার পানি। এর ফলে এর নেটওয়ার্কে ছোট ভোট খাল ও দ্বীপের সৃষ্টি হয়েছে। এসব কারণে ঘন ঘন বন্যা হয় এবং বর্ষাকালে নদীর পাড় ভাঙে মারাত্মকভাবে। অন্যদিকে, বিপরীত চিত্র শুষ্ক মৌসুমে। কিন্তু সুরক্ষার অভাবে হাজার হাজার মানুষ তাদের জমিজমা, বাড়িঘর, জীবন জীবিকা হারান।
ওদিকে, এই প্রকল্পের জন্য ২০১৬ সালের ২৮ শে সেপ্টেম্বরে একটি বাধ্যতামূলক নয় এমন একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড ও পাওয়ার কনস্ট্রাকশন করপোরেশন অব চায়না (পাওয়ার চায়না)। পাওয়ার চায়না চীনের রাষ্ট্র মালিকানাধীন একটি প্রতিষ্ঠান। এরপর এ প্রকল্পের একটি মাস্টারপ্লান এবং উপযোগিতা বিষয়ক পর্যবেক্ষণ জমা দিয়েছে পাওয়ার চায়না। প্রাইমারি ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রোপোজালে বলা হয়, তিস্তা নদীর উভয় পাশে পুরো ১০০ কিলোমিটারে তীর মেরামত বা বাঁধ দেয়া হবে। সীমান্তে ভারতের কাছে যেখানে বাংলাদেশে এই নদী প্রবেশ করেছে সেখান থেকে শুরু করে ব্রহ্মপুত্র পর্যন্ত এই বাঁধ নির্মাণ করা হবে। এর মধ্যে রয়েছে নদীর তীররক্ষা প্রকল্প। গ্রোয়েন নির্মাণ করে নদীভাঙ্গন রক্ষা। তবে সবার আগে এই প্রকল্পে ড্রেজিং করা হবে এবং পুরো ১১০ কিলোমিটার তিস্তা নদীকে আরো গভীর করা হবে। এর ফলে নদীর গতিতে স্থিতিশীলতা থাকবে। সেখান থেকে পানি নিয়ে কৃষিকাজে ব্যবহার করা হবে। নির্মাণ করা হবে খাল ও পুকুর। সেখানে শুষ্ক মৌসুমে ব্যবহারের জন্য পানি সংরক্ষণ করা হবে। ড্রেজিং করা মাটি দিয়ে হারানো জমি পুনরুদ্ধার করা হবে। নদীর পাড় ঘেঁষে নির্মাণ করা হবে সড়ক, স্যাটেলাইট শহর ও শিল্প পার্ক। এছাড়া থাকবে গার্মেন্ট প্রসেসিং কারখানা ও সার কারখানা।
তিস্তা সেচ প্রকল্প: বাংলাদেশের পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় আশা করছে, এই প্রকল্প তিস্তা অববাহিকায় কৃষিকাজে ব্যাপক উন্নতি ঘটাবে। কবির বিন আনোয়ার স্থানীয় মিডিয়ায় বলেছেন, আমরা যদি এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারি, তাহলে সঙ্কটের সময় বাংলাদেশের বিশাল একটি অংশ পানি পাবে। বর্তমানে বছরে কমপক্ষে দু’মাস ভয়াবহ পানি সঙ্কটের মুখে পড়ে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল। কারণ, এ সময়ে তিস্তায় পানি থাকে সামান্য। পানি সঙ্কটের কারণে এ সময়ে বাংলাদেশে তিস্তা অববাহিকায় এক লাখ ১১ হাজার হেক্টর কৃষিজমির বেশির ভাগই থেকে যায় চাষের বাইরে। ২০১৩-১৪ অর্থ বছরে এসব জমির শতকরা মাত্র ৩৫ ভাগে কৃষিকাজ করা হয়েছিল। ১৯৯৭ সালে শুষ্ক মৌসুমে তিস্তায় পানি ছিল প্রায় ৬৫০০ কিউসেক। কিন্তু ২০০৬ সালে তা কমে দাঁড়ায় মাত্র ১৩৪৮ কিউসেক। ২০১৬ সালে আরো কমে তা দাঁড়ায় মাত্র ৩০০ কিউসেকে।
পরিবেশগত ক্ষতির বিষয়টি স্পষ্ট নয়: বাংলাদেশ এনভায়রনমেন্টাল ল’য়ারস এসোসিয়েশনের ( বেলা) প্রধান সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান সতর্ক করে বলেছেন, সতর্ক হওয়ার কারণ আছে। এই প্রকল্পের অবকাঠামো, ঋণের শর্ত এখনও জানা যায়নি। এমনকি তা প্রকাশ্য বিতর্কেও দেয়া হয়নি। ফলে এই প্রকল্পে পরিবেশগত স্থিতিশীলতায় কি প্রভাব পড়বে তা স্পষ্ট নয়। কিছু বিশেষজ্ঞ চীনের নেতৃত্বাধীন এই পরিকল্পনার সফলতা নিয়ে সন্দিহান। ইন্সটিটিউট অব ওয়াটার এন্ড ফ্লাড ম্যানেজমেন্ট, বুয়েট-এর প্রফেসর মনসুর রহমান বলেন, যেহেতু তিস্তা নদীর আচরণ জটিল তাই এই প্রকল্পের সফলতা নিয়ে তিনি সন্দিহান। তিনি বলেন, পানি ধরে রাখার জন্য একটি ব্যারেজ নির্মাণ করা সহজ হতে পারে। হাজার বছর ধরে তিস্তায় পলি পড়েছে। দ্বীপ সৃষ্টি হয়েছে। ফলে সেই তিস্তাকে একটি সংকীর্ণ ক্যানেলে পরিণত করা হবে একটি কঠিন কাজ। বর্তমানে তিস্তার তলদেশ ৫ থেকে ৬ কিলোমিটার চওড়া। কিন্তু পরিকল্পনামতো এই নদীকে এক কিলোমিটার চওড়া খালে পরিণত করা হবে। বাংলাদেশের নদী বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত বলেন, এই প্রকল্প সফল নাকি ব্যর্থ হবে তা বলা কঠিন। কারণ, এ বিষয়ে পর্যাপ্ত গবেষণা হয়নি। যদি ড্রেজিং করার পর বর্ষা মৌসুমের পানি ধরে রাখতে চান তারা, তাহলে ভাটিতে একটি অবকাঠামো নির্মাণ করতে হবে। তাই কোনো মন্তব্য করার আগে আমাদেরকে জানতে হবে কি নির্মাণ করতে যাচ্ছে কর্তৃপক্ষ এবং তা কীভাবে করবে।
আন্তঃনদী রাজনীতি: সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, আন্তঃনদী বিষয়ক অধিকারের পক্ষে কথা বলা উচিত বাংলাদেশের। রাজ্য পর্যায়ে বিরোধের কারণে ভারত তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি এক দশকেরও বেশি সময় ঝুলিয়ে রেখেছে। এই প্রথম বাংলাদেশে কোনো নদী ব্যবস্থাপনা প্রকল্পে জড়িত হচ্ছে চীন। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের রয়েছে অভিন্ন ৫৪টি নদী। তার মধ্যে কৌশলগত দিক দিয়ে তিস্তা গুরুত্বপূর্ণ ভারতের কাছে। এ কারণে আঞ্চলিক শত্রুর বিরুদ্ধে সুবিধা অর্জনের মাধ্যম হিসেবে এই প্রকল্পকে লুফে নিয়েছে চীন। আর এ ঘটনা এমন এক সময়ে ঘটছে যখন ভারত ও চীনের মধ্যে উত্তেজনা তুঙ্গে। বাংলাদেশের মিডিয়ায় তিস্তা ব্যবস্থাপনা প্রকল্পে চীনের বিনিয়োগের খবর প্রকাশিত হওয়ার পর ভারত তার পররাষ্ট্রসচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলাকে ঢাকা পাঠায়। তবে তিনি আলোচনার সময় এসব ইস্যু তুলেছিলেন কিনা সে বিষয়ে সরকারিভাবে কোন নিশ্চয়তা দেয়া হয়নি। ঢাকায় বাংলাদেশ-ভারত যৌথ নদী কমিশনের সদস্যরা নিশ্চিত করেছেন যে, শ্রিংলার সফরের পর পানি বণ্টন নিয়ে কোনো আলোচনা করেনি ভারত।