ঢাকা: দেশে করোনার সংক্রমণ থামেনি। এর মধ্যেই সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ের আশঙ্কা বাড়ছে। শঙ্কা দেখা দিয়েছে সর্বত্র। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকারও নানামুখী পরিকল্পনা নিচ্ছে। ইতিমধ্যে জরুরি বৈঠক করে পরিকল্পনা সংক্রান্ত নির্দেশনা দিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়েছে কিনা এ নিয়েও রয়েছে বিতর্ক। কেউ কেউ বলছেন এখন করোনার দ্বিতীয় ধাক্কা চলছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রথম ঢেউই এখনো শেষ হয়নি।
সামনের শীতে দ্বিতীয় ধাক্কা আসতে পারে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও আসন্ন শীতকালে কোভিড-১৯ পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে পারে উল্লেখ করে এই মুহূর্ত থেকেই তা মোকাবিলায় প্রস্তুতি গ্রহণ করতে সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন। দ্বিতীয় দফার সংক্রমণ প্রতিরোধের পাশাপাশি সংক্রমণ হলে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে রাখার পরামর্শ দিয়েছে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত পরামর্শক কমিটি। দ্বিতীয় দফার সংক্রমণ দ্রুত নির্ণয়ের লক্ষ্যে সতর্ক থাকার পরামর্শও দেয়া হয়। দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের সেকেন্ড ওয়েভ (দ্বিতীয় ঢেউ) শুরু হয়েছে বলে মনে করেন না জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটির অন্যতম সদস্য, দেশের বিশিষ্ট ভাইরোলজিস্ট এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম। তিনি বলেন, দেশে এখনো করোনার প্রথম ঢেউই চলছে। করোনা সংক্রমণের সেকেন্ড ওয়েভ শুরু হয়ে গেছে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর এমন বক্তব্য প্রসঙ্গে অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম এ মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, মার্চ থেকে আমাদের প্রথম ওয়েভ চলছে। এখনো সেটা চলমান। সংক্রমণ এখন বাড়ছে না। শনাক্তের হার ১১-এর মধ্যে ওঠানামা করছে। যদি এখান থেকে বাড়া শুরু করে তখন হয়তো বলা যাবে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের কথা। এখনই দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়েছে বলা যাবে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বরাত দিয়ে এই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ আরো বলেন, সংক্রমণের হার ৫-এর নিচে নামলে তখন স্কুল-কলেজ খুলে দেয়া সম্ভব।
এদিকে গত ২২শে সেপ্টেম্বর সচিবালয়ে করোনাভাইরাস সংক্রমণের দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হওয়ার আশঙ্কাকে সামনে রেখে কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিবরা সভায় অংশ নেন। সভা শেষে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম জানান, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে আর লকডাউনের কথা ভাবছে না সরকার। তবে আসন্ন শীতে করোনা সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ের শুরুর আশঙ্কা সামনে রেখে কর্মপরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হচ্ছে। মূলত অর্থনীতি সচল রেখেই দ্বিতীয় ধাক্কা সামলানোর পরিকল্পনা নেয়া হচ্ছে। মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, যদি (করোনার দ্বিতীয় পর্যায়) আসে আমরা টোটাল প্রোগ্রামকে ভাগ করে নিলাম। ওয়ার্ক প্ল্যান রেডি করে নিতে হবে। ক্লিনিক্যাল সাইডটা আমাদের এক্সপার্টরা রেডি করবেন, যদি রোগটা বিস্তার করে, কীভাবে তার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান হবে। সাপ্লিমেন্টারি ক্লিনিক্যাল সাইট, যেহেতু শীতের সময় অ্যাজমা, নিউমোনিয়া, ইনফ্লুয়েঞ্জা বেশি থাকবে, সেটাও ইমিডিয়েটলি সবাইকে সচেতন করে দেয়া এবং তারও একটা ট্রিটমেন্ট প্ল্যান রেডি করা। তিনি আরো বলেন, ব্যাপক প্রোমোশনাল ক্যাম্পেইন চালাতে হবে, সবাই যাতে মাস্ক পরে। সবাই যাতে দূরত্বটা বজায় রাখে। স্বাস্থ্য নির্দেশিকা সবাই যাতে মেনে চলে। এনফোর্সমেন্ট সাইড, মাঠ প্রশাসন, স্থানীয় সরকার, পুলিশ, সেনাবাহিনী-এটা (নিজেদের কাজ) কীভাবে করবে, সেই ওয়ার্ক প্ল্যান করা হবে। বাইরে থেকে অনেক লোকজন দেশে আসছে ও বাইরে যাচ্ছে জানিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, এ ব্যাপারে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা করা হবে, যাতে বাইরে থেকে আর ভাইরাস না আসে। বিমানবন্দরে সশস্ত্র বাহিনীর বড় টিম আছে, উনারা দেখাশোনা করছেন।
তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দিয়েছেন। আমরা বসে সভা করে ওয়ার্ক প্ল্যান (কর্মপরিকল্পনা) করে ওপেন করে দেব। স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিতে অভিযান বাড়ানো হবে কি-না জানতে চাইলে খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, পরিস্থিতির ওপর ডিপেন্ড (নির্ভর) করবে। যদি কোনো রকম ইমপ্যাক্ট না পড়ে, আমাদের মূল কথা থাকবে আমরা ইকোনমিকে সচল রাখবো ইন্শাআল্লাহ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার বিষয়ে তিনি বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। প্রত্যেকটা মন্ত্রণালয়ের ওপর দায়িত্ব দেয়া হয়েছে, তাদের অধিক্ষেত্রের অফিসগুলো কীভাবে চালাবে তারা সেই ব্যবস্থা নেবে। মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, পিআইডি, তথ্য মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার বিভাগ এবং ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে মসজিদগুলোকে ব্যবহার করে মানুষকে আরো সচেতন করা হবে। স্বাস্থ্য বিভাগের ইউনিয়ন পর্যন্ত কর্মচারী আছে, তারা এ বিষয়ে কাজ করবেন। গণমাধ্যমেরও একটা বড় ভূমিকা আছে। ৭ থেকে ১০ দিন সময় দিয়েছি এ সময়ে তারা কর্মপরিকল্পনা প্রস্তুত করবে। এর আগে গত ২১শে সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে থেকে দেশে করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় দুই অনুশাসন দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বৈঠকের পর মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম এই তথ্য জানিয়ে বলেন, আগামী অক্টোবর-নভেম্বরে করোনার সেকেন্ড ওয়েভ আসবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। তাই অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করার প্রস্তুতি নেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি আরো জানান, ‘ইদানীং দেশের বিভিন্ন মসজিদে মুসল্লিদের মাস্ক ছাড়া নামাজ পড়তে দেখা যায়। তাই প্রধানমন্ত্রী ধর্ম মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিয়েছেন, মাস্ক পরার জন্য সচেতনতা বাড়াতে হবে।
এদিকে গত ২০শে সেপ্টেম্বর কোভিড-১৯ জাতীয় কারিগরি পরামশর্ক কমিটির এক সভা থেকে সুপারিশ করে বলেছে, বিভিন্ন দেশে দ্বিতীয় দফায় সংক্রমণও দেখা যাচ্ছে। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে সংক্রমণের মাত্রা অনেক বেশি। এছাড়া বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যোগাযোগ উন্মুক্ত হচ্ছে এবং হতে থাকবে। স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়েও জনসাধারণ এর মধ্যে এক ধরণের শৈথিল্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এই সবগুলোর কারণে আমাদের দেশেও পুনরায় সংক্রমণের আশংকা রয়েছে। দ্বিতীয় দফার সংক্রমণ প্রতিরোধের পাশাপাশি সংক্রমণ হলে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে রাখার পরামর্শ দেয়া হয়।
অন্যদিকে গতকাল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের আধুনিকায়ন, উন্নতমানের চিকিৎসাসেবা এবং শিক্ষার সমপ্রসারণমূলক কাজের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের সেকেন্ড ওয়েভ (দ্বিতীয় ঢেউ) শুরু হয়ে গেছে। তিনি বলেন, জীবন ও জীবিকার তাগিদে মানুষ ঘরের বাইরে বের হচ্ছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলায় উদাসীনতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তবে সেকেন্ড ওয়েভ মোকাবিলায় চিকিৎসক-নার্সসহ স্বাস্থ্যবিভাগ প্রস্তুত রয়েছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, শীতকালে বিয়ে ও পিকনিকসহ নানা অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। জনসমাগম বেশি হওয়ায় করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে। এ কারণে এসব অনুষ্ঠানের আয়োজন থেকে বিরত থাকতে হবে। এ সময় জনগণকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চল?া ও গণমাধ্যমকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান মন্ত্রী।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এবিএম খুরশীদ আলম, অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবু ইউসুফ ফকির, ঢামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল একেএম নাসির উদ্দিন, ঢাকা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. খান আবুল কালাম আজাদসহ প্রমুখ।