মানুষ যখন প্রাণঘাতি করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করছে, বিশ্ব তখন ঘুমন্ত অবস্থায় যেন কর্তৃত্ববাদী ভবিষ্যতের দিকে ধাবিত হচ্ছে। নিষ্ঠুর শক্তির সহায়তায় পুঁজিতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখতেই কর্তৃত্ববাদের দিকে এই যাত্রা। সংসদীয় ও প্রেসিডেন্ট-শাসিত গণতন্ত্রসমূহে সরকার পরিচালিত হচ্ছে কার্যকর বিরোধী দল ছাড়াই। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ব্রাজিল, ভারত, চীন, পাকিস্তান, বাংলাদেশ সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সংখ্যাগুরু-তান্ত্রিক সরকারগুলো অংশগ্রহণমূলক, ধর্মনিরপেক্ষ ও প্রগতিবাদী নিয়মনীতি লঙ্ঘন করে মানুষ ও মানুষের জীবনের বিনিময়ে বৈশ্বিক পুঁজি রক্ষায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। সাংবিধানিক ঐতিহ্যে বিধিবদ্ধ গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য ভঙ্গের মাধ্যমে সংসদীয়, প্রেসিডেন্ট-শাসিত, উদার ও সাংবিধানিক গণতন্ত্রগুলো ভেঙ্গে পড়ছে।
পুঁজিবাদী অর্থনীতি ও মুনাফাচালিত কাঠামোর অস্তিত্বের অক্সিজেন হিসেবে কাজ করছে এই কর্তৃত্ববাদী রাজনীতি। শাসক শ্রেণির বুর্জোয়া সৈনিকরা গণতন্ত্র, গণতান্ত্রিক আদর্শ ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সাময়িক সমাধিস্থ করার দিকে নিয়ে যাচ্ছে, যার ওপর নয়া-উদারবাদী কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থার বিকাশ ঘটতে পারে। কোনো একক দেশের বিষয় নয় এটি আর।
ইউরোপ থেকে আমেরিকা, এশিয়া, আফ্রিকা ও ওশেনিয়া- সর্বত্রই কর্তৃত্ববাদ ও গণতন্ত্রের ওপর কর্তৃত্ববাদের আঘাতের চিহ্ন স্পষ্ট। সংখ্যাগরিষ্ঠ-তন্ত্রের সহায়তায় সরকারগুলো অনুদার ও অগণতান্ত্রিক চর্চাকে স্বাভাবিক করে তোলার চেষ্টা চালাচ্ছে। গণতান্ত্রিক কাঠামোর এই ডানদিক ঘেষাঁর প্রবণতা ইতিহাসে নতুন কিছু নয়। কর্তৃত্ববাদী ও গণতন্ত্র-বিরোধী শক্তি সবসময়ই গণতন্ত্রকে পরাভূত করতে চেয়েছে যেন জনগণ ও সম্পদের ওপর অবাধ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা যায়। যুক্তি দেখানো হয় যে, শক্তিশালী নেতৃত্বে ও স্থিতিশীল রাজনীতি শান্তি ও সমৃদ্ধির জন্য অপরিহার্য। মানুষের জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে একাধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য এই মিথ প্রচার করে প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী।
ইতিহাসে সফল ও ব্যর্থ গণতান্ত্রিক আন্দোলনের উদাহরণ রয়েছে অনেক। কিন্তু গণতান্ত্রিক আন্দোলন কখনই আদর্শ, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও সংস্কৃতি প্রচার করতে ব্যর্থ হয়নি। অপরদিকে একচ্ছত্রবাদী, প্রতিক্রিয়াশীল ডানপন্থী গোষ্ঠী সবসময়ই তাদের সাময়িক সাফল্যের পর ব্যর্থ হয়েছে। অগণতান্ত্রিক ও কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্র ও সরকারগুলো মিথ্যা তথ্য ও ভুয়া খবর ছড়াচ্ছে যেন মানুষের যে স্বাধীনতা ক্রমেই কমে যাচ্ছে, তা নিয়ে তারা অন্ধকারে থাকে। মানুষের মনোযোগ ভিন্নদিকে নিবদ্ধ রাখার এই কৌশল শাসক শ্রেণির ব্যর্থতা লুকানো এবং নিজেদের ব্যর্থতাকে রাষ্ট্র, সরকার ও গণতান্ত্রিক কাঠামোর ব্যর্থতা হিসেবে ফুটিয়ে তোলার জন্য সহায়ক। অকার্যকর গণতান্ত্রিক কাঠামোয় দুর্বল রাষ্ট্র ও বিনয়ী সরকার কিংবা শক্তিশালী রাষ্ট্র ও শক্তিশালী সরকার মূলত পুঁজি বিস্তারের জন্য সহায়ক। প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক শাসনব্যবস্থা মূলত পুঁজিবাদী শ্রেণিরই মিত্র। তারা সুযোগ পেলেই বিরোধী রাজনৈতিক দল, প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মানহানি করা, তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট করতে এতটুকু সময় ব্যয় করে না। এতে করে এমন এক রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি করা উদ্দেশ্য, যেখানে রাজনীতি হয়ে ওঠে শাসক শ্রেণির আদর্শেরই নামান্তর। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করতে বিচার ব্যবস্থাকে পর্যন্ত ব্যবহার করা হয়। এই কূটকৌশল ব্যবহার করা হয় বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে, যেখানে ভঙ্গুর গণতন্ত্র মূলত প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতি ও পুঁজিবাদী বৈষম্য লুকিয়ে রাখার পোস্টার হিসেবে কাজ করে।
গণতন্ত্র হলো সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক রূপান্তরের একটি মাধ্যম। গণতন্ত্রের স্বল্পতা বা গণতন্ত্রের সংকট প্রগতিশীল ভবিষ্যতমুখী এই রূপান্তরকে বিলম্বিত করে। প্রগতিশীলতার পথে গণতান্ত্রিক উন্নয়নকে পুনরুদ্ধার ও শক্তিশালী করার জন্য একটি তীব্র গণ আন্দোলন শুরু করার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করা উচিত বিশ্বের। এই প্রগতিশীল ভবিষ্যতে রাজনৈতিক বিরোধীদের শ্বাসরোধ করা হবে না। ভিন্নমতের রাজনীতি মূলত গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যকেই শক্তিশালী করে, সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়াকে ধারালো করে। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো এখন শাসক শ্রেণির আদর্শ ও নীতির সঙ্গে এতটাই জড়িয়ে যাচ্ছে যে, এখন আর তাদের আলাদা করা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে যেন, উভয় পক্ষ একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। অকার্যকর বিরোধিতা বা বিরোধিতার অনুপস্থিতি মূলত গণতান্ত্রিক ক্রিয়াকেই খর্ব করে।
বিশ্বাসের ভিত্তিতে যে জনপ্রিয় মতামত তৈরি হয়, সেগুলো সবসময়ই যুক্তিযুক্ত, বস্তুনিষ্ঠ বা বিজ্ঞাননির্ভর হয় না। অতএব, প্রগতিশীলতা ও বৈজ্ঞানিক যুক্তিনির্ভর কন্ঠস্বর যদি কম মানুষেরও হয়, সেটি মেনে নেয়া সংখ্যাগুরুর জন্য জরুরি। একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এটি ভারসাম্যেরও গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। গণতন্ত্র ব্যর্থ হলে বিকল্প হচ্ছে আরও বেশি গণতন্ত্র, যা সফল হবে। গণতন্ত্র ও প্রগতির পথে রূপান্তরের যে সক্ষমতা রয়েছে গণতন্ত্রের, তার বিকল্প কখনই কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থা হতে পারে না। গণতন্ত্র ও গণতন্ত্রের সমালোচকদের প্রধান যুক্তি হলো ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের বিকেন্দ্রীকরণ, যেন সকলের মঙ্গল সাধিত হয়। বিরোধী শক্তির প্রশ্ন ও সরকারের সমালোচনা হলো জনগণের আশা আকাঙ্খার ভিত্তিতে শাসন কাঠামোর সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনের জন্য অপরিহার্য। এই ধরণের গণতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক সংস্কৃতি বিভিন্ন মত ও পথের মানুষকে ভিন্ন ভিন্ন যুক্তি আদানপ্রদানের সুযোগ করে দেয়। এর বৃহত্তর উদ্দেশ্য হলো বিভিন্ন ধরণের কাঠামোগত বৈষম্য ও অসমতা থেকে মানুষের মুক্তি। ব্যক্তি স্বাধীনতা, সাম্য, ন্যায়বিচার ও স্বাধীনতা- এসব আদর্শই হলো গণতান্ত্রিক আন্দোলনের উপহার।
সাধারণ মানুষ ক্ষুধা, গৃহহীনতা, বৈষম্য ও বিভিন্ন ধরণের বিচ্ছিন্নতায় আক্রান্ত। এটি বিশ্বজুড়েই দেখা যাচ্ছে; কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চল বা জনসংখ্যার মধ্যেই নয় শুধু। বিশ্বজুড়ে এই ধারার বিস্তার ঠেকাতে হবে মানুষের জীবন, নাগরিকত্বের অধিকার, বিশ্বের মর্যাদা ও শান্তির জন্য। এজন্য প্রয়োজন স্থানীয় কার্যক্রম ও আঞ্চলিক সংহতি নেটওয়ার্কের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা হাতে নেয়া, যেখানে মানুষের প্রয়োজনের ভিত্তিতে বিভিন্ন অঞ্চলের বিভিন্ন ধরণের প্রয়োজনকে আমলে নেয়া হবে। একচ্ছত্রবাদী যে সার্বজনীনতার কথা বুর্জোয়া গণতন্ত্রের ইউরো-সংশয়বাদী ধ্যানধারণা প্রচার করে থাকে, তার রূপান্তর ঘটাতে হবে। এর স্থলে প্রতিষ্ঠা করতে হবে বহুত্ববাদী গণতান্ত্রিক চর্চা, যা সংখ্যালঘু বা সংখ্যাগুরুর মতো সাম্রাজ্যবাদী নির্বাচনী কাঠামোর মধ্যে আবদ্ধ থাকবে না।
(ড. ভবানী শঙ্কর নায়ক হলেন যুক্তরাজ্যের কভেন্ট্রি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসা কৌশল বিভাগের জ্যেষ্ঠ প্রভাষক। তার এই নিবন্ধ ইউরেশিয়া রিভিউ-তে প্রকাশিত হয়েছে)