৫ দিন রীতিমতো হিমশিম পরিস্থিতির মধ্যে কাটাতে হয়েছে ধানমণ্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন ফরম বিক্রি করতে গিয়ে এ অবস্থা তৈরি হয়। পরিস্থিতি এড়াতে পরে বাধ্য হয়ে কার্যালয়ের সামনে মনোনয়ন ফরম বিক্রির নিয়মের নোটিশ টানানো হয়। এরপরও থেমে থাকেনি নিয়মের বাইরে ফরম কিনতে আসা আগ্রহীদের ভিড়। মন্ত্রী ও এমপিদের প্যাডে স্বাক্ষর নিয়ে মনোনয়ন ফরম কিনতে আসেন অনেকে। আওয়ামী লীগ অফিস থেকে জানানো হয়েছে, মন্ত্রী বা এমপিদের ডিও লেটারের ওপর ভিত্তি করে কাউকে মনোনয়ন ফরম দেয়া হয়নি। কারণ এটা নিয়মের মধ্যে নেই। তবে কেউ কেউ জানিয়েছেন, কয়েকজন মন্ত্রী ও এমপির ডিও লেটারের পাশাপাশি তাদের টেলিফোনের কারণে ফরম দেয়া হয়েছে।
তবে সুনির্দিষ্টভাবে বিষয়টি কেউ স্বীকার করেননি। আগামী অক্টোবরে মামলার জটে আটকে থাকা ৬১টি ইউপিতে উপনির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে। এই নির্বাচনকে সামনে রেখে গত ১৬ই সেপ্টেম্বর থেকে দলীয় মনোনয়ন ফরম বিক্রি শুরু করেছে আওয়ামী লীগ। দলের ঘোষণা অনুযায়ী গতকাল বিকাল ৫টা পর্যন্ত ফরম বিক্রির কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত তা বাড়ানো হয়। রাত পর্যন্ত চলে ফরম বিক্রি ও জমা নেয়া। সংঘাত আর বিভেদ এড়াতে এবার স্থানীয় নির্বাচনে মনোনয়ন ফরম বিতরণে নয়া কৌশল নিয়েছে আওয়ামী লীগ। দলীয় ম্যান্ডেট নিতে হলে জেলা, উপজেলা এবং ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের স্বাক্ষরিত রেজ্যুলেশনে প্রার্থীর নাম থাকতে হবে। অর্থাৎ দলের সমর্থনের বাইরে কেউ যেনো নির্বাচনে অংশ নিতে না পারে সেজন্য এই পন্থা অবলম্বন করা হয়েছে বলে জানান আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা। তবে তারা জানিয়েছেন, দলের গঠনতন্ত্রে এভাবেই মনোনয়ন ফরম বিতরণের বিধান রয়েছে। অতীতে এই বিধান কার্যকর করা হয়নি। এবার বিষয়টি নিয়ে বেশ কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। দলের সভাপতি শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে প্রেসিডিয়ামের বৈঠকের পরদিনই এ উদ্যোগ নিয়েছে দলটি।
এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আবদুর রহমান মানবজমিনকে বলেন, দলের নিয়ম অনুযায়ী প্রার্থী তালিকা পাঠানো হলেও অনেক জায়গায় যোগ্য প্রার্থীদের নাম বাদ পড়েছে। এর পেছনে নানাবিধ কারণ রয়েছে। মন্ত্রী বা এমপিরা হয়তো যোগ্য প্রার্থীদের মনোননয়ন ফরম দেয়ার জন্য ডিও লেটার দিয়েছেন। এর মধ্যে খারাপ কিছু দেখছি না। আওয়ামী লীগ অনেক বড় দল। অনেক যোগ্য ব্যক্তি আছেন নির্বাচন করার। তবে নিয়ম অনুযায়ী হলে সবচেয়ে বেশি ভালো হয়। বিষয়টি আমাদের মাথায় আছে। ডিও লেটারের মাধ্যমে মনোনয়ন ফরম দেয়ার উদ্যোগে দলীয় বিভেদকে আরো উস্কে দেবে কিনা প্রশ্নে আবদুর রহমান বলেন, মনোনয়ন ফরম নিলেই যে তাকে চূড়ান্ত মনোনয়ন দেয়া হবে- এমন নিশ্চয়তা তো নেই। এজন্য মনোনয়ন বোর্ড রয়েছে। সেখানেই আলাপ-আলোচনা ও সার্বিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে যোগ্য ব্যক্তিকে নির্বাচনের জন্য মনোনয়ন দেয়া হবে। আর আমাদের বিশ্বাস রয়েছে দল যাকেই মনোনীত করবে সবাই তার পক্ষে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করবে। আগামী মাসে নির্বাচন হতে যাওয়া কয়েকটি ইউনিয়ন পরিষদের নেতাদের সঙ্গে আলাপ করলে তারা জানান, অনেক এলাকায় মন্ত্রী ও এমপিদের স্থানীয় রাজনীতিতে শক্তিশালী অবস্থান নেই। স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে তাদের বিরোধ থাকায় নিজেদের প্রভাব খাটিয়ে প্যাডে ডিও লিটার দিয়েছেন পছন্দের ব্যক্তিকে মনোনয়ন দেয়ার জন্য। কিন্তু যেসব মন্ত্রী ও এমপিরা স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ে একসঙ্গে কাজ করছেন প্রার্থী বাছাইয়ে তাদের কোন সমস্যা হচ্ছে না। এদিকে ফরম বিক্রি প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের উপ-দপ্তর সম্পাদক সায়েম খান মানবজমিনকে বলেন, দলীয় নিয়ম অনুযায়ী ফরম বিক্রি করা হয়েছে। যাদের বিষয়ে স্থানীয় নেতাদের সুপারিশ রয়েছে তাদের কাছে ফরম বিক্রি করা হয়েছে। যারা মন্ত্রী বা এমপিদের ডিও লেটার নিয়ে এসেছেন তাদের কাছে ফরম বিক্রি করা হয়নি। মনোনয়ন ফরম বিক্রি শুরু হলে ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে অংশ নিতে আগ্রহী অনেকেই স্থানীয় সংসদ সদস্যদের ‘ডিও লেটার’ নিয়েও মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করতে পারছেন না বলে অভিযোগ ওঠে। অনেকেই বলছেন, মনোনয়ন ফরম বিক্রিতে আওয়ামী লীগ ‘কড়াকড়ি’ আরোপ করেছে। তবে আওয়ামী লীগ বলছে, বাড়তি কোনো কড়াকড়ি আরোপ হয়নি মনোনয়ন ফরম বিক্রিতে। গঠনতন্ত্র অনুযায়ীই ইউপি নির্বাচনের জন্য এমপিদের ‘ডিও লেটার’-এর ভিত্তিতে ফরম বিক্রির কোনো নিয়ম নেই।
আওয়ামী লীগ নেতারা জানান, ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন নির্বাচন এখন দলীয় প্রতীকে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। জেলা পরিষদ নির্বাচন দলীয় প্রতীকে হয় না, সেখানে আমরা সমর্থন দেই। সামনে মৌলভীবাজার, মাদারীপুর, ফরিদপুর ও ফেনীর জেলা পরিষদ নির্বাচন আছে। এ ছাড়া ৯টি উপজেলা পরিষদ ও ৬১টি ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন আছে। নির্বাচন আইন অনুযায়ী ইউপি ও উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীরা অংশ নেবেন। আর আমাদের গঠনতন্ত্র অনুযায়ীই এসব নির্বাচনে উন্মুক্তভাবে মনোনয়ন ফরম বিতরণের নিয়ম নেই। তারা বলেন, নিয়ম অনুযায়ী, যে ইউনিয়নে নির্বাচন হবে, সেই ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ একটি বর্ধিত সভা করবে। সেখানে তারা তিন জনের একটি প্যানেল তৈরি করবে। তারা সেটি উপজেলা আওয়ামী লীগকে অবহিত করবে। উপজেলা আওয়ামী লীগ ফরোয়ার্ডিংসহ সেটি জেলা আওয়ামী লীগে পাঠাবে। ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক এই ছয় জনের যৌথ সইয়ের সর্বোচ্চ তিন জনের একটি প্যানেল কেন্দ্রে আসবে। ওই প্যানেলকে ফরম দেয়া হয়েছে। এর বাইরে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে কারও ফরম কেনার সুযোগ নেই।
অনেক জায়গায় দেখা যাচ্ছে, এমপিরা ডিও দিচ্ছেন। পার্টির গঠনতন্ত্রে এরকমভাবে কোনো এমপি বা জনপ্রতিনিধির ডিও’তে ফরম দেয়ার কোনো বিধান নেই। দলীয় সূত্রে জানা গেছে, আজ বিকাল ৪টায় প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে সীমিত পরিসরে স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ডের সভা অনুষ্ঠিত হবে। আওয়ামী লীগ সভাপতি ও স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ডের সভাপতি শেখ হাসিনা সভায় সভাপতিত্ব করবেন। এখানেই চূড়ান্ত করা হবে প্রার্থীদের নাম। বর্তমানে দেশে ৪ হাজার ৫৭১টি ইউনিয়ন পরিষদ রয়েছে। ২০১৬ সালের ২২শে মার্চ শুরু হয়ে কয়েক ধাপে ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন শেষ হয় ঐ বছরের ৪ঠা জুন। আইন অনুযায়ী, কোনো ইউনিয়ন পরিষদের মেয়াদ শেষ হওয়ার পূর্ববর্তী ১৮০ দিনের মধ্যে নির্বাচন সম্পন্ন করতে হবে।