মৌলভীবাজার: বন্ধুদের নিয়ে মাদক পার্টি। সেখানে রাতভর নানা আমোদ-ফুর্তি। আর সঙ্গে থাকা মেয়ে বন্ধুকে রাতভর ধর্ষণ। এরপর ওই রাতের ঘটে যাওয়া ঘটনার আদ্যোপান্ত নিজেরাই নিজেদের ফেসবুকে তুলে ধরে। প্রতিনিয়তই হতো এমন পার্টি। কিন্তু তা নিজেদের মধ্যেই চেপে রাখত। ওইদিন আমোদ-ফুর্তির ভাগ-বাটোরায় দ্বন্দ্ব নিয়ে বেসামাল হয়ে নিজেরাই বলে দেয় অভ্যন্তরীণ বেহুঁশ-বেফাঁস কথা। এমন অসামাজিক কার্যকলাপের পর আবার নিজেদের জবানিতেই ফেসবুকে তাদের বর্ণনায় বিস্মিত জেলার সর্বস্তরের মানুষ।
এমন ঘটনা লোকমুখে চাউর হলে ফুঁসে উঠে জেলার সচেতনমহল, তরুণ ও যুবসমাজ। সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শুরু হয় তোলপাড়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তারা এমন নিন্দনীয় অসামাজিক কার্যকলাপের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে সোচ্চার হন। তাদের সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করে জেলার বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন। তারা প্রশাসনের কাছে জোর দাবি তোলেন প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের। অন্যথায় তারা ওই ন্যক্কারজনক ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে রাজপথে কঠোর আন্দোলনে সোচ্চার হবেন বলেও জানাচ্ছেন।
জানা যায়, গত ৩রা আগস্ট শহরের সোনাপুরস্থ মাহমুদ এইচ খানের ভাড়া বাসায় ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। আর ২৫শে আগস্ট সাবেক ছাত্রমৈত্রী নেতা ও সংবাদকর্মী মাহমুদ এইচ খান নিজের ফেইসবুক আইডিতে সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের মৌলভীবাজার জেলা শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক ও শহর সভাপতি সজিবুল ইসলাম তুষার এর বিরুদ্ধে মধ্যপ অবস্থায় এক মেয়েকে ধর্ষণের অভিযোগ করেন। অভিযোগে তিনি বলেন- শহরে তার বাসায় ডিনার ও গাঁজা পার্টির আয়োজনে আসা এক মেয়েকে তুষার মাদকাসক্ত করে ধর্ষণ করে। আর এই কাজে মারজিয়া প্রভা নামের এক নারীবাদী নেত্রী এবং রায়হান নামের এক বাম নেতা সহযোগিতা করেছেন বলে তিনি তার ওই স্ট্যাটাসে উল্লেখ করেন।
তিনি জানান, ডিনার পার্টির আয়োজনের নেপথ্যে গাঁজা ও ধর্ষণের পূর্বপরিকল্পনা ছিল তা তিনি কোনোভাবেই জানতেন না। তারা নতুন আসা ওই মেয়েকে তুষারের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচয় করিয়ে দেন। এর একদিন পর অভিযুক্ত তুষার তার ফেইসবুক আইডিতে দেয়া স্ট্যাটাসে ওইদিন রাতের গাঁজা পার্টি এবং তারা মধ্যপ অবস্থায় ওই মেয়ের সম্মতির ভিত্তিতে যৌন কাজ করেছেন বলে উল্লেখ করেন। তবে তার দেয়া স্ট্যাটাসে ধর্ষণের বিষয়টি অস্বীকার করে তিনি ওই মেয়ের আগ্রহেই যৌন কাজে লিপ্ত হয়েছেন বলে স্বীকার করেন। তারা দু’জনই ওই রাতের ঘটে যাওয়া ঘটনার পক্ষে-বিপক্ষে চুলচেরা বর্ণনা নিজেদের ফেসবুকে তুলে ধরেন। ওই ঘটনার পর সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট মৌলভীবাজার জেলা শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক ও শহর শাখার সভাপতি সজিবুল ইসলাম তুষারকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট মৌলভীবাজার জেলা শাখার এক জরুরি সভায় সংগঠনের সভাপতি রেহনোমা রুবাইয়াৎ এর সভাপতিত্বে সংগঠনের জেলা কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত হয়। সভায় ভার্চ্যুয়াল মিডিয়ায় প্রচারিত বক্তব্যের ভিত্তিতে অনুসন্ধানপূর্বক সংগঠনের শৃঙ্খলাবিরোধী কার্যক্রম ও নৈতিক স্খলনজনিত কারণে সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট জেলা শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক ও শহর শাখার সভাপতি সজিবুল ইসলাম তুষারকে সংগঠনের প্রাথমিক সদস্যপদসহ সকল প্রকার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। একই অভিযোগে সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ মৌলভীবাজার জেলা কমিটির বর্ধিত ফোরামের জরুরি সভায় দলের শৃঙ্খলাবিরোধী কার্যক্রম ও নৈতিক স্খলনজনিত কারণে বর্ধিত ফোরামের সদস্য রায়হান আনছারীকেও দলের সকল দায়িত্ব থেকে সাময়িক অব্যাহতি ও কারণ দর্শানোর নোটিশ প্রদান করা হয়। ওই দু’টি সংগঠনই আলাদাভাবে সভাপতি সম্পাদক স্বাক্ষরিত দলীয় প্যাডে তাদের এই সিন্ধান্তের কথা গণমাধ্যমকে জানান। এদিকে মৌলভীবাজার প্রেস ক্লাবের সহযোগী সদস্য সাবেক বাংলা নিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম প্রতিনিধি সংবাদকর্মী ও সাবেক ছাত্রমৈত্রী নেতা মাহমুদ এইচ খানের মৌলভীবাজার প্রেস ক্লাবের সহযোগী সদস্য বাতিল করা হয়েছে। ৩০শে আগস্ট রাতে প্রেস ক্লাবের কার্যনির্বাহী পরিষদের জরুরি সভায় এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয় বলে জানিয়েছেন, প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক পান্না দত্ত। মাহমুদ, তুষার ও রায়হান আনছারীর সঙ্গে পরিচিত মৌলভীবাজার সরকারি কলেজের একাধিক শিক্ষার্থী অভিযোগ করে জানান, মৌলভীবাজার শহরে সোনাপুরস্থ মাহমুদ এইচ খানের ভাড়া বাসায় প্রায়ই মদ ও গাজা সেবন পার্টির আয়োজন হয়। ওখানে মেয়েদের নানা প্রলোভন দেখিয়ে যৌন কাজেও লিপ্ত করা হয়। এর প্রমাণ সোস্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া মাহমুদ ও তার বন্ধুদের সঙ্গে মেয়েদের অন্তরঙ্গ দৃশ্য। আর তার সঙ্গে এসব পার্টিতে যোগ দেন মৌলভীবাজারের বাম ছাত্র সংগঠনগুলোর বর্তমান ও সাবেক কয়েকজন নেতা।
তারা জানায় মাহমুদের ওই ভাড়া বাসায় ছাত্র ইউনিয়নসহ অনান্য বাম সংগঠনের সাবেক কয়েকজন সভাপতি-সম্পাদক, সংবাদকর্মী ও নারীবাদী কয়েকজন মেয়ে আসা-যাওয়া নিয়মিত। তারা প্রতিনিয়তই ওই বাসায় রাত কাটিয়ে মাদক সেবন ও যৌন কাজে লিপ্ত থাকেন। তারা ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, মাহমুদ এইচ খান বড়লেখা থেকে মৌলভীবাজার শহরে এসে বাসা ভাড়া নিয়ে এরূপ বেহায়াপনা, অশ্লীল ও অনৈতিক কার্যক্রমের যোগান দিচ্ছে। অথচ প্রশাসন নীরব। এটা ভাবতেও ঘৃণা লাগে। মৌলভীবাজার জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি এডভোকেট মুজিবুর রহমান মুজিব, সম্মিলিত সামাজিক উন্নয়ন পরিষদের সভাপতি খালেদ চৌধুরী, সচেতন নাগরিক ফোরাম (সনাফ)-এর সভাপতি মোয়াজ্জেম হোসেন মাতুক, বোরহান উদ্দিন (র:) ইসলামী সোসাইটির সভাপতি এম. মুহিবুর রহমান মুহিব, স্পন্দন মৌলভীবাজারের সভাপতি ইহাম মুজাহিদসহ অনেকেই এ বিষয়ে মুঠোফোনে মানবজমিনকে বলেন, মৌলভীবাজারে বাম সংগঠনের সঙ্গে জড়িত কয়েজন সদস্য প্রকাশ্যে আসর বসিয়ে মাদক সেবন ও ধর্ষণ করার স্বীকারোক্তি দিয়েছে। অথচ এখনও নীরব রয়েছে প্রশাসন। তারা ওই ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করেন। অন্যথায় তারা রাজপথে তীব্র আন্দোলনে নামবেন বলে হুঁশিয়ারিও দেন।
এ বিষয়ে নির্যাতিতা ওই মেয়ে ও অভিযুক্ত চারজনের বক্তব্য নেয়ার জন্য নানা প্রচেষ্টা চালিয়েও সম্ভব হয়নি। তাদের সবারই মুঠোফোন বন্ধ রয়েছে। তবে ম্যাসেঞ্জারে মাহমুদ এইচ খান ঘটনার বিস্তারিত তুলে ধরেন। তিনি ওই ঘটনার প্রতিবাদকারী হিসেবে নিজেকে নির্দোষ দাবি করে বলেন, আমার বাসায় শুধু ডিনার পার্টির আয়োজনের কথা বলে তারা গাঁজা সেবন ও ধর্ষণ করায় আমি এর প্রতিবাদ জানাই।
জেলা শহরের সচেতন মহল, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর যৌথ উদ্যোগে আগামী বৃহস্পতিবার সকালে মৌলভীবাজার প্রেস ক্লাবের সামনে নাগরিক সমাজের ব্যানারে ওই ঘটনার প্রতিবাদে ও ওদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ হওয়ার কথা রয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।