ঢাকা: বিতর্ক যেন পিছু ছাড়ছে না ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যানদের। একের পর এক বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে তারা এখন আলোচনা-সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন। করোনা পরিস্থিতির মধ্যে কিছু ইউপি চেয়ারম্যানের দুর্নীতি, গরিবের হকে থাবা, চাল ও গম চুরি, ত্রাণের চাল চাওয়ার অপরাধে কৃষকের মাথা ফাটিয়ে রক্তাক্ত করা এবং যুবককে বেধড়ক পিটিয়ে আহত করাসহ নানা কেলেঙ্কারির ঘটনায় তারা বেশ ইমেজ সঙ্কটে পড়েন।
সর্বশেষ হারবাং ইউপি চেয়ারম্যান মিরানুল ইসলাম কর্তৃক মা-মেয়েকে রশি দিয়ে বেঁধে রাস্তায় হাঁটানো এবং নির্যাতনের ঘটনায় দেশজুড়ে তোলপাড় এবং সমালোচনার ঝড় বইছে।
জানা গেছে, গত ২১ আগস্ট কক্সবাজারের চকরিয়ায় গরু চুরির অপবাদ দিয়ে মা-মেয়েকে বেধড়ক পিটিয়ে কোমরে রশি বেঁধে প্রকাশ্যে রাস্তায় হাঁটিয়ে সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন করে উপজেলার হারবাং ইউপি চেয়ারম্যান মিরানুল ইসলাম ও তার লোকজন।
এ ঘটনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়ে গেলে দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। ওই ঘটনায় থানায় মামলা হলেও মিরানুল ইসলাম এখনো গ্রেফতার হননি। করোনা পরিস্থিতির মধ্যে গত ১৫ এপ্রিল প্রতিবেশী দরিদ্রদের জন্য ত্রাণসহায়তা চাইতে টেলিভিশনে দেখানো ৩৩৩ নম্বরে কল করে নাটোরের লালপুর উপজেলার বরমহাটি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুস সাত্তারের রোষানলে পড়েন আঙ্গারিপাড়া গ্রামের কৃষক শহিদুল ইসলাম।
চৌকিদার দিয়ে ডেকে নিজ হাতে লাঠি দিয়ে শহিদুলকে বেদম মারধর করে মাথা ফাটিয়ে রক্তাক্ত করে দেন ইউপি চেয়ারম্যান। এর আগে গত ১১ এপ্রিল দরিদ্রদের জন্য ত্রাণ চাওয়ার অপরাধে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে আশেক এলাহীকে বেধড়ক পিটিয়ে আহত করেন কুমিল্লার দেবিদ্বার উপজেলার ১০ নম্বর দক্ষিণ গুনাইঘর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল হাকিম খান। মারধরের সেই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায়।
শুধু ইউপি চেয়ারম্যান মিরানুল ইসলাম, আব্দুস সাত্তার কিংবা আব্দুল হাকিম এ ধরনের অপরাধকর্ম করে পার পেয়ে যাচ্ছেন এমন নয়, তাদের মতো অনেক ইউপি চেয়ারম্যান রয়েছেন করোনা পরিস্থিতির মধ্যে দুর্নীতি, ত্রাণের চাল ও গম চুরিসহ নানা কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়লেও অদৃশ্য কারণে তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছেন। যদিও দিন আনে দিন খাওয়া ও কর্মহীন হয়ে পড়া শ্রমজীবী মানুষের জন্য সরকারের বরাদ্দকৃত চাল ও গম চুরিসহ নানা অপরাধমূলক ঘটনার জন্ম দেয়ার অভিযোগে শতাধিক ইউপি চেয়ারম্যানকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করেই কাজ শেষ করছে সংশ্লিষ্টরা। অপরাধ প্রমাণিত হলেও তাদের স্থায়ী বহিষ্কার করা নিয়েও বড় ধরনের সংশয় রয়েছে।
তাই জনমনে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে, দেশের এই পরিস্থিতিতে সরকার, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও সাধারণ মানুষ যখন মানবিক বিষয়গুলো প্রাধান্য দিয়ে কাজ করছে, সেখানে এসব জনপ্রতিনিধি সেবকের ভূমিকায় অবতীর্ণ না হয়ে উল্টো জনগণের সাথে নির্দয়, অমানবিক ও খারাপ আচরণ করার পরও আইনের আওতায় আসছে না কেন, তাদের খুঁটির জোর কোথায়? আর বৈশ্বিক মহামারী করোনা পরিস্থিতির মধ্যে গরিবের হক লুটেপুটে খাচ্ছেই বা কেন? ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানদের এসব অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড প্রসঙ্গে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র অধ্যাপক ও বিশিষ্ট রাজনীতি বিশ্লেষক ড. তারেক শামসুর রেহমান বলেন, এখনতো জনপ্রতিনিধিদের জবাবদিহিতা নেই।
এর কারণে জনগণের প্রতি তাদের দায়বদ্ধতাও নেই। যারা এগুলো করছেন তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা হচ্ছে না। বর্তমান পরিস্থিতিতে অপরাধীদের দ্রুত বিচারের আওতায় এনে যদি শাস্তির ব্যবস্থা করা যেত তাহলে সবার মনে একটি ভয় তৈরি হতো। এখন বিচারও হয় না। তিনি আরো বলেন, রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণেও এগুলো হচ্ছে।
যারা এগুলো করছেন তারা মনে করেন তাদের ওপরেতো বড় বস আছে। ফলে তারা ধরেই নিয়েছেন, যা কিছু করুক না কেন তাদের কোনো বিচার হবে না, তারা পার পেয়ে যাবেন। এই ধরনের মানসিকতা থেকেও তারা বেপরোয়া হয়ে উঠছেন।
সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজনের সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার এ প্রসঙ্গে বলেন, এই ধরনের ঘটনা খুবই দুঃখজনক। এ জন্য সরকারও কম দায়ী নয়। কারণ জনপ্রতিনিধি হতে এখনতো নির্বাচন লাগে না। সরকারি সিদ্ধান্তে হয়। এখানে ভালো মানুষ বাদ দিয়ে খারাপ মানুষকে সিলেকশন করা হয়। তিনি আরো বলেন, নির্বাচন ব্যবস্থা ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। সবাই দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার জন্য তদবির করে। তারা জানে, দলীয় মনোনয়ন পেলেই চেয়ারম্যান হওয়া যাবে। আর এভাবে জনপ্রতিনিধি হলেতো জনগণের প্রতি তাদের দায়বদ্ধতা থাকে না।