স্বাস্থ্যবান গাজীপুর-১৫: সাহেদ-মাসুদের সিন্ডিকেটে ১২ কোটি টাকা কারা দিল?

Slider জাতীয় টপ নিউজ


গাজীপুর: করোনা রিপোর্ট জালিয়তির মাধ্যমে আবিস্কার হওয়া সাহেদ করিমের রিজেন্ট হাসপাতালকে ঘিরে স্বাস্থ্য খাতের দূর্নীতি ও অনিয়ম সরকারের নজরে আসে। মিডিয়ার রিপোর্টে বেরিয়ে আসে সব তথ্য। সাহেদের অন্যতম সহযোগী রিজেন্টের এমডি মাসুদ পারভেজের বাড়ি কাপাসিয়ায়। কাপাসিয়ায় মাসুদ পারভেজের বাড়ির নাম ডাক্তার ভবন। কাপাসিয়া বাজারে তার বাবার ঔষুধের দোকানের নাম মাসুদ হোমিও হল।

মাসুদ পারভেজ গ্রেফতারের কয়েক ঘন্টার মধ্যে গ্রেফতার হয় সাহেদ করিম। র‌্যাব বলছে, মাসুদ পারভেজের তথ্যের ভিত্তিতে সাহেদ গ্রেফতার হয়েছে। কিন্তু আলোচিত এই ঘটনার রেশ শুধুই ঢাকায়। এরপর গ্রেফতার হলেন ডাঃ সাবরিনা ও স্বামী আরিফ। এখনো চলছে অভিযান। সাহেদের ঢাকায় প্রতিদিন বিভিন্ন হাসপাতালে অভিযান চলছে। কিন্তু যার তথ্যের ভিত্তিতে সাহেদ গ্রেফতার হল, তার বাড়ি গাজীপুরে হলেও নেই কোন অভিযান। এর কি কারণ তা জানা যায়নি।

অনুসন্ধান বলছে, করোনা নিয়ে ব্যবসা করা সাহেদের অন্যতম সহযোগী মাসুদ পারভেজের বাড়ি গাজীপুর জেলার কাপাসিয়ায়। কাপসিয়া থেকে গাজীপুর হয়ে ঢাকায় গড়ে উঠা একটি বড় সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রন করতেন মাসুদ পারভেজ। সাহেদের সহযোগী মাসুদের সিন্ডিকেট গাজীপুরে এতই শক্তিশালী যে, সাহেদ পালিয়ে থাকা অবস্থায় কাপাসিয়ায় এসেছিলেন আত্মগোপন করতে বলে তথ্য দিয়েছিল ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। তাহলে মাসুদের সেই শক্তিশালী সিন্ডিকেট আবিস্কার করতে কি উদ্যোগ নিয়েছে প্রশাসন!

জানা গেছে, সাহেদের সাথে মাসুদের মাধ্যমে গাজীপুরের অনেক বড় বড় নেতার সখ্যতা ছিল। করোনা রিপোর্ট, কীট, এন-৯৫ মাস্ক ও পিপিই সহ নানা ধরণের বানিজ্যের বিস্তার গাজীপুরেও ঘটেছিল কি না, তা জানা যায়নি। গাজীপুরে বেসরকারী স্বাস্থ্যসেবাখাতে প্রশাসনের নজরদারী তেমনই ইঙ্গিতবহন করে।

সিআইডি জানিয়েছে, সাহেদ ২০১৭ সালের ১ জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের ১৫ জুলাই পর্যন্ত প্রতারণা ও জালিয়াতি করে সাত কোটি ৯০ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। এ ছাড়া করোনার ভুয়া পরীক্ষা ও জাল সনদ দেওয়ার মাধ্যমে সরিয়েছেন তিন কোটি ১১ লাখ টাকা। সাহেদ, মাসুদ পারভেজ ও অজ্ঞাতনামা ৬-৭ জন পরস্পর যোগসাজশে সাড়ে তিন বছরে মোট ১১ কোটি ২ লাখ ২৭ হাজার ৮৯৭ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।

পর্যালোচনায় দেখা যায়, করোনার প্রথম থেকেই সারা দেশের পরিসংখ্যানের সাথে গাজীপুর জেলার তথ্য আসেনি। দুুই, তিন বা চারদিন পরও করোনা সংক্রমনের তথ্য পেয়েছে গাজীপুরবাসী। ৬৩ জেলার ক্ষেত্রে এক নিয়ম আর গাজীপুরের ক্ষেত্রে অন্য নিয়ম। এটা কেন হল, তা নিয়ে অসংখ্য লেখালেখি হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও সংবাদমাধ্যমে গাজীপুরের করোনা আপডেটের তথ্য দেরী হওয়ার পিছনে কি কারণ সে নিয়ে রীতিমত লেখালেখি হয়েছে। এই দেরীর দায়ভার নিয়ে গাজীপুর সিভিল সার্জনকে চলে যেতেও অনুরোধ করেছেন অনেক মাধ্যম। কিন্তু কোন উন্নতি হয়নি। এমনো ঘটেছে, কয়েকদিন ধরে গাজীপুর জেলার করোনা আপডেট না আসায় গাজীপুরের জেলা প্রশাসক তার নিজের ফেসবুক পেজে আপডেট দিয়েছেন। অনেক সময় জেলার সিভিল সার্জন ও জেলা প্রশাসকের আপডেটের মধ্যে অমিলও খুঁজে পাওয়া গেছে। সারাদেশের ন্যায় গাজীপুর জেলার করোনা আপডেট নিয়মিত না আসায় মানুষের চাহিদার কারণে করোনা আপডেট নিয়ে নানা ধরণের মিল -অমিলের ট্রলও হয়েছে। কিন্তু দেরীর কারণ কেন তার কোন ব্যবস্থা গ্রহন হয়নি।

সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, সাহেদ-মাসুদের বড় শক্ত সিন্ডিকেট গাজীপুরে। বড় নেতা থেকে ছোট নেতা অনেকেই সাহেদ-মাসুদের সাথে সখ্যতায় ছিলেন। নিবিড় সখ্যতায় গড়ে উঠা সিন্ডিকেটের শক্তি এতই বেশী যে, বাংলাদেশ যাকে পাগলের মত খুঁজেছিল সেই পলাতক ব্যক্তি গাজীপুরে এসেছিল আত্মগোপনে থাকতে। এতেই বোঝা যায়, সাহেদ-মাসুদের সিন্ডিকেট গাজীপুরে কত শক্তিশালী ছিল। গাজীপুরে সাহেদ-মাসুদ সিন্ডিকেটের ভয়াবহ শক্তির কারণেই গাজীপুর জেলায় হাসপাতালের সংখ্যা জানা সম্ভব হয়নি। এই সিন্ডিকেটের শক্তির কবলে পড়ে আছে তথ্যপ্রমান সহ প্রকাশিত অসংখ্য খবরের এ্যাকশন। ঢাকার বড় ডাক্তারের সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে চেম্বারে ডাক্তারের চেয়ারে বসা ব্যক্তি যখন বলেন আমি ডাক্তার না, বসে বসে ফেসবুক চালাই, এমন খবর সচিত্র প্রকাশের পরও নো এ্যাকশন। চাকুরী না করে বেতন নেয়া দুই ডাক্তারের বিষয়ে খবর প্রকাশ হওয়ার পর জেলার সিভিল সার্জন ওই দুই ডাক্তারের নাম জানতে চেয়েছিলেন ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য। বিষয়টি হাস্যকর মনে হলেও শক্তিশালী সিন্ডিকেটের কারণেই এই জেগে জেগে ঘুমানো কি না জানা হল না। আবাসকি মেডিকেল অফিসার নিজে স্বীকার করেছেন, তিনি হাসপাতালের আবাসিক এলাকায় থাকেন না। এরপরও কোন ব্যবস্থা হয় না। সব মিলিয়ে বলা যায়, সাহেদ-মাসুদ সিন্ডিকেটের ভয়ঙ্কর শক্তিশালী সিন্ডিকেট কি গাজীপুরে থেকেই যাবে!!!

সাড়ে তিন বছরে ১১ কোটি টাকা সরিয়েছেন সাহেদ

রিজেন্ট হাসপাতাল ও রিজেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাহেদ ওরফে সাহেদ করিমের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে মামলা করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। মঙ্গলবার রাজধানীর উত্তরা পশ্চিম থানায় এ মামলা করা হয়।

সিআইডি জানিয়েছে, সাহেদ ২০১৭ সালের ১ জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের ১৫ জুলাই পর্যন্ত প্রতারণা ও জালিয়াতি করে সাত কোটি ৯০ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। এ ছাড়া করোনার ভুয়া পরীক্ষা ও জাল সনদ দেওয়ার মাধ্যমে সরিয়েছেন তিন কোটি ১১ লাখ টাকা। সাহেদ, মাসুদ পারভেজ ও অজ্ঞাতনামা ৬-৭ জন পরস্পর যোগসাজশে সাড়ে তিন বছরে মোট ১১ কোটি ২ লাখ ২৭ হাজার ৮৯৭ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন।

সিআইডির জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার জিসানুল হক জানান, প্রতারণা ও জালিয়াতি মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন-২০১২ এর ২ (শ), ৫ ও ৬ ধারা অনুযায়ী অপরাধ। এসব অপরাধের অভিযোগে মোহাম্মদ সাহেদ ও সংঘবদ্ধ চক্রের সদস্যদের বিরুদ্ধে ৩০টি মামলার তথ্য পাওয়া গেছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবে লেনদেনের মাধ্যমে রূপান্তর এবং ভোগবিলাসে অর্থ ব্যয় করার অপরাধে সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম (ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইম) বিভাগ বাদী হয়ে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে। অর্গানাইজড ক্রাইম বিভাগ এ মামলার তদন্ত করবে।

সিআইডি সূত্র জানায়, সাহেদ তার অপরাধকর্মের প্রধান সহযোগী মাসুদ পারভেজের সহায়তায় রিজেন্ট ডিসকভারি ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস লিমিটেড নামে ঢাকায় মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের শাহ মখদুম এভিনিউ শাখায় গত ২৪ ফেব্রুয়ারি একটি অ্যাকাউন্ট খোলেন। হিসাবটি পরিচালনা করতেন সাহেদের বাবা সিরাজুল করিম ও এমডি মাসুদ পারভেজ। অপরাধলব্ধ আয় লেনদেনের সুবিধার্থে তিনি রিজেন্ট হাসপাতাল, রিজেন্ট কে.সি.এস. লিমিটেড ও অন্যান্য অস্তিত্বহীন ১২টি প্রতিষ্ঠানের নামে ৪৩টি ব্যাংক হিসাব পরিচালনা করেছেন। হিসাবগুলো খোলার সময় কেওয়াইসি ফরমে তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠানগুলোর চেয়ারম্যান বা স্বত্বাধিকারী হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন। সাহেদের পক্ষে হিসাবগুলো প্রত্যক্ষভাবে পরিচালনা করেছেন প্রতিষ্ঠানগুলোর এমডি মাসুদ পারভেজ।

লেনদেন পর্যালোচনায় দেখা যায়, গত কয়েক বছরে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে নগদ টাকা হিসাব নম্বরগুলোয় জমা করা হয়েছে। ৪৩টি ব্যাংক হিসাবে সর্বমোট ৯১ কোটি ৭০ লাখ টাকা জমা এবং এর মধ্যে ৯০ কোটি ৪৭ লাখ টাকা তোলা হয়েছে। এক্ষেত্রে হিসাবগুলোয় বর্তমান স্থিতি দুই কোটি চার লাখ টাকা; এর মধ্যে ৮০ লাখ টাকা ঋণ রয়েছে। অভিযুক্ত মাসুদ পারভেজের ১৫টি ব্যাংক হিসাবে মোট জমা হয়েছে তিন কোটি ৯৮ লাখ ৫ হাজার টাকা। তোলা হয়েছে তিন কোটি ৯৮ লাখ টাকা। স্থিতি পাঁচ হাজার টাকা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *