টেকনাফ (কক্সবাজার):রোহিঙ্গা আগমনের তিন বছর পূর্ণ হচ্ছে মঙ্গলবার। মিয়ানমারের আরাকানে রোহিঙ্গা মুসলমানদের উপর সেদেশের মগ সেনারা নির্মম নির্যাতন, ধর্ষণ, হত্যা ও বাড়ি ঘরে অগ্নিসংযোগের ফলে বাস্তচ্যুত হয়ে লাখ লাখ রোহিঙ্গা এদেশে পালিয়ে আসে। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট দলে দলে রোহিঙ্গা আসার তিন বছর পূর্ণ হলো আজ। ২৫ আগস্টকে ‘গণহত্যা দিবস’ হিসেবে ঘোষনা দিয়ে গত দুই বছর পালন করেছে রোহিঙ্গারা। এবারও ২৫ আগস্টকে ‘গণহত্যা দিবস’ হিসেবে পালনের ভিন্ন ভাবে উদ্যোগ নিয়েছে। করোনার (কোভিড-১৯) কারণে জন সমাবেশ এড়িয়ে এবার মসজিদে মসজিদে নামাজের পর বিশেষ দোয়া ও সারা দিন ঘর থেকে বাহির না হয়ে পরিবার পরিজনদের নিয়ে আল্লাহর কাছে বিশেষ দোয়া চাইবেন।
রোহিঙ্গা নেতারা দাবী করেন, ২০১৭ সনে সেনাদের হাতে ১০০ নারী ধর্ষিত, ৩০০ গ্রামকে নিশ্চিহ্ন, ৩৪ হাজার শিশুকে এতিম, ১০ হাজারের বেশী রোহিঙ্গাকে হত্যা, ৯ হাজার ৬০০ মসজিদ, ১২০০ মক্তব, মাদ্রাসা ও হেফজখানায় অগ্নিসংযোগ, ২ হাজার ৫০০ রোহিঙ্গা মুসলিম এখনো বন্দি ও ৮ লাখের বেশী রোহিঙ্গা আরকান রাজ্য থেকে বাস্তচ্যুত হয়।
২৪ আগস্ট সরেজমিন টেকনাফ উপজেলার শালবাগান (নং- ২৬) ও জাদিমুরা (নং-২৭) ক্যাম্প ঘুরে এ তথ্য জানা গেছে।
শালবাগান ক্যাম্পের হেড মাঝি বজলুর ইসলাম নামে রোহিঙ্গা নেতা বলেন, ২৫ আগস্ট গণহত্যা দিবস উপলক্ষে ২০১৮ সালে প্রতিটি ক্যাম্পে ও ২০১৯ সালে শুধুমাত্র কুতুপালং ক্যাম্পে বৃহৎভাবে দিবসটি পালন করা হয়। এবারও ২৫ আগস্ট গনহত্যা দিবস উপলক্ষে গত ২৩ আগস্ট শালবাগান, কুতুপালং, বালুখালী, থাইয়ংখালীর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের হেড মাঝি ও রোহিঙ্গা নেতাদের নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। সভায় করোনা ভাইরাস (কোভিড- ১৯) এর কারণে বৃহৎভাবে পালন না করে রোহিঙ্গারা নিজ নিজ ঘরে অবস্থান করবে, দোকান-পাট খুলবেনা, খেলাধুলা করবেনা, পথে ঘাটে না ঘুরে পরিবার পরিজন নিয়ে কান্নাকাটি করে আল্লাহর কাছে দোয়া চাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
চোখের সামনে স্বামীকে হত্যা :
মংডু থানার চালিপ্রাং গ্রাম। একদিন বিকেলে ২০-২৫ জনের বর্মী সেনার দল হঠাৎ মনিরার বাড়ির চারদিক ঘিরে ফেলে। ভয়ে কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে পড়ে মনিরা ও তার স্বামী বশির আহমদ। ৩-৪ জন সেনা বাড়িতে ঢুকে মনিরাকে শ্লীলতাহানির চেষ্টা করে। আকস্মিকভাবে স্ত্রীকে শ্লীলতাহানী ও নির্যাতন সইতে না পেরে বাধা দেয় স্বামী বশির। এসময় আরো ৪-৫ জন সেনা এসে বশিরকে বাড়ী থেকে টেনে হেঁচড়ে বাড়ী থেকে বের করে উঠানে নিয়ে যায়। লাথি, কিল-ঘুষি ও বন্ধুকের আঘাতে নির্যাতন করতে থাকে। এক পর্যায়ে গুলি ও জবাই করে হত্যা করে। নির্যাতন ও শ্লীলতাহানী করে মনিরাকে। তিন বছর পূর্বে মিয়ানমারে ঘটে যাওয়া নির্মম ঘটনা এখনো ভুলতে পারেনি মনিরা। স্বামীর শোকে মুহ্যমান এখনো। সে বর্তমানে টেকনাফ উপজেলার শালবাগান (নং- ২৬) রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ই- ব্লকের বাসিন্দা। সে আরো জানায়, ‘আমার স্বামীর কারো সাথে শত্রুতা ছিল না। সেনারা বাড়ি ঘেরাও করে ঘরে ঢুকে আমার দিকে ঝাপ (ঝাপটে ধরে) দেয়। স্বামী বশির আহমদ পাশেই ছিল। এভাবে কেন স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরবে বলে বাধা দিতে গেলে সেনারা স্বামী বশিরকে ব্যাপক মারধর ও নির্যাতন করে গুলি করে এবং জবাই করে হত্যা করে। এমনকি স্বামী দাফনও দিতে পারিনি। সেনারা মৃত অবস্থায় স্বামী বশির কে নিয়ে যায়’। পরে ২৭ আগস্ট ৩ ছেলে-মেয়েকে নিয়ে অন্যান্য রোহিঙ্গাদের সাথে মনিরাও এদেশের আশ্রয়ের জন্য সীমান্ত ফাড়ি দিয়ে শালবাগান ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়। সে আরো জানায়, এনজিওরা রেশন হিসেবে যা দেয় তা নিয়ে কোন ভাবেই ছেলে-মেয়ে নিয়ে চারজনের পরিবার চলছে। কিছু বিক্রি করে ঘর ভাড়া দিতে হয়। এভাবেই চলছি।
স্বদেশ মিয়ানমার ফিরতে চায় রোহিঙ্গারা:
কখন স্বদেশে ফিরে যাব, সরকার ও আন্তর্জাতিক সংস্থাদের দিকে চেয়ে আছি। মাতৃভূমি আরকান দেশের মন জন্য কাঁদে। নাগরিকত্ব ও নিজ ভিটে-বাড়ি ফিরিয়ে দিলেই এদেশে আর থাকবো না। স্বেচ্ছায় চলে যাব। এই ভাসমান জীবন ভাল লাগছে না। ছেলে-মেয়েদের ভবিষ্যত দিন দিন অন্ধকার হয়ে উঠছে। ১০-১২ ফুট দৈর্ঘ্য-প্রস্থ তেরপালের ছাউনির ঘর। পরিবারের ৮-১০ জনের ঠেসাঠেসি বসবাস। এ পরিবেশে এভাবে কি থাকা যায়। সাধারণ রোহিঙ্গা জাকারিয়া বলেন, সরকার পাঠানোর আগেই আমরা ফিরে যাব। যদি আমাদেও দাব মিয়ানমার সরকার গ্রহণ করে। যেভাবেই আছি সেভাবেই থাকতে চাই না। মিয়ানমার আরকানে আমাদের বাড়ীঘর ছিল। সেখানে গিয়ে সুখে শান্তিতে থাকতে চাই।
শালবাগান ক্যাম্পের রোহিঙ্গা মাঝি (নেতা) হোছন আহমদ জানান, ‘তিন বছর ধরে তেরপালের (ত্রিপল) ছাউনির বাসায় বসবাস করে আসছি, পাইলে খায়, না পাইলে খাইনা, আমাদের বিচার কোন দেশই করছে না, আমরা দেশে ফিরতে চাই, এখনই ফিরতে চাই, যে জুলুম নির্যাতন নিয়ে এদেশে এসেছি, এখানেও সেই জুলুম-নির্যাতন চলছে। আমরা ফিরতে চাই। কিন্তু আমাদের নাগরিকত্ব, নিজের ভিটে বাড়ী ও জমি ফিরিয়ে দেওয়া, গনহত্যার বিচার, রোহিঙ্গা স্বিকৃতিসহ ছয়টি দাবী মানলেই স্বইচ্ছায় ফিরে যাব।
ক্যাম্প লিডার (চেয়ারম্যান) রমিদা বেগম বলেন, ‘দাবী পুরন হলেই স্বদেশ চলে যাব। ক্যাম্পের অবস্থা খুবই খারাপ। পুরুষ-মহিলা কেউ নিরাপদে নেই। দ্রুত নিজ দেশে ফেতর যেতে চাই’।
সে আরো বলেন, ‘একটি ১০-১২ ফুট দৈর্ঘ্য প্রস্থের বাড়ীতে পরিবারের ৮-১০ জনের বসবাস। এই ছোট ত্রিপলের ছাউনির ঘরে বিশেষ করে বিবাহ উপযুক্ত যুবতী মহিলাদের বেশী সমস্যা হচ্ছে। মা-বাবা, মেয়ে-ছেলে একসাথে ঘুমাতে হচ্ছে। বৃষ্টির দিনে উপর-নীচ দিয়ে পানি এবং গৃষ্মকালে তেরপালের গরমে অতিষ্ট হয়ে উঠে মহিলারা। পুরুষদের মতো মহিলারা ঘর হকে বের হতে পারেনা’।
‘ক্যাম্পে বড় মেয়েদের জন্য কোন শিক্ষা ও প্রতিষ্ঠান নেই। ছোটরা পড়ছে, যাচ্ছে এবং আসছে, তবে নেই শ্রেনীর ব্যবস্থা। এনজিওদের সাথে বিভিন্ন সভা ও বৈঠকে মহিলাদের সমস্যা নিয়ে তুলে ধরা হয়। কিন্তু এ পর্যন্ত বাস্তবায়ন হয়নি’।
উল্লেখ্য, মিয়ানমারে চরম নির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা উখিয়া-টেকনাফের ৩০টিরও বেশী অস্থায়ী ক্যাম্পে মানবেতর জীবন যাপন করছে। গত ২০১৭ সনের ২৫ আগস্ট দেশটির রাখাইন রাজ্যে সেনা অভিযান শুরুর পর ১১ লাখের বেশী রোহিঙ্গা এসব মিবিরে আশ্রয় নিয়েছে। আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গারা সব ধরনের সরকারি বেসরকারি সুযোগহ সুবিধা পেলেওে এভাবে অনিশ্চিত ভাসমান অবস্থায় দীর্ঘদিন থাকতে চাই না রোহিঙ্গারা।
আরসা নামক একটি উগ্রপন্থি সংগঠনের সদস্যরা সেনা ছাউনিতে হামলার অজুহাতে গত ২০১৭ সনের ২৫ আগস্ট রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতন শুরু করে মিয়ানমার সেনা বাহিনী। দেশটির সেনা, বিজিপি, ও উগ্রবাদী রাখাইন যুবকরা গ্রামের পর গ্রাম পুড়িয়ে দিয়ে রোহিঙ্গা নর-নারী, শিশুর উপর বর্বরোচিত নৃশংসতা চালায়। প্রান বাঁচাতে বানের ¯্রােতের মতো বাংলাদেশের দিকে ছুটতে থাকে রোহিঙ্গারা। বর্তমানে নতুন-পুরনো মিলে ১১ লাখের বেশী রোহিঙ্গা উখিয়া-টেকনাফের বিভিন্ন জায়গায় আশ্রয় নিয়েছে।
রোহিঙ্গাদের কারণে বিপাকে স্থানীয়রা :
উখিয়া-টেকনাফের আট হাজার ৫০০ হেক্টরের বেশী জমিতে রোহিঙ্গারা আশ্রয় শিবির গড়ে তুলেছে। প্রায় সাড়ে এগারো হাজার রোহিঙ্গা কক্সবাজারের এই দুই উপজেলাতে অবস্থান করায় নানা সংকট ও বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে। রোহিঙ্গাদের কারণে দিন দিন ফুঁসে উঠছে স্থানীয়রা। নানান দূর্ভোগ সৃষ্টির পাশাপাশি তাদের কারণে মোবাইল নেটওয়ার্ক, ইন্টারনেট বন্ধ রয়েছে প্রায় এক বছর ধরে। অথচ রোহিঙ্গারা দেদারছে ব্যবহার করছে উচ্চ গতির ইন্টারনেট ওয়াইফাই। এছাড়া রোহিঙ্গাদের অবাধ চলাফেরার কারণে স্থানীয়দের যাতায়ত ব্যবস্থায সবচেয়ে বেশী দূর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। টেকনাফ হতে কক্সবাজারের পথে পথে প্রায় ৮টির বেশী বিভিন্ন আইন শৃংখলা বাহিনীল তল্লাশি পয়েন্ট বসিয়েছে। এতে সবচেয়ে বেশী দুর্ভোগ ও সময় ব্যয় করে যেতে হচ্ছে স্থানীয়দের । শুধু তাই নই, দেখাতে হচ্ছে জাতীয় পরিচয়পত্র। অনেক সময় হেনস্থার শিকার হতে হচ্ছে। এছাড়া সস্তায় দখল করে নিয়েছে শ্রমবাজার।
তাদের প্রত্যাবাসনের জন্য দুই দফা প্রস্তুতি নিলেও স্বেচ্ছায় ফিরতে রাজি না হওয়ায় ভেস্তে যায় প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া। ফলে আরো উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে স্থানীয়রা। এমন কোন অপরাধ নেই যা রোহিঙ্গারা করছেনা। মাদক ইয়াবা পাচার ও বহন, হত্যা, গুম, সংঘাত, দ্বন্দ্ব ইত্যাদি অপকর্মে লিপ্ত হয়ে পড়েছে রোহিঙ্গারা। শুধু তাই নই, বিভিন্ন দ্রব্য মুল্য উর্ধ্বগতি, পতিতাবৃত্তি, উঠতি যুবকদের চারিত্রিক অবনতি ও আইনশৃংখলার অবনতি ঘটছে। এব্যাপারে উপজেলা রোহিঙ্গা প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি মোজাম্মেল হক বলেন, রোহঙ্গিাদের কারণে স্থানীয়রা মারাত্মক হুমকীতে পড়েছে। স্বাস্থ্য ও শিক্ষা ব্যবস্থা চরম ক্ষতি হচ্ছে। বিশেষ করে যত্রতত্র অবাধ বিচরণ ভাবিয়ে তুলেছে স্থানীয়দের। দেশের মানুষ ভিন দেশের মতো চলতে হচ্ছে। বিভিন্ন স্থানে দেখাতে হচ্ছে জাতীয় পরিচয় পত্র। যা খুবই গায়ে লাগে। টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ সাইফুল ইসলাম জানান, রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে নজরদারী বাড়ানো হয়েছে। গতবারের মতো অনাকাক্সিক্ষত কর্মসূচি করতে দেয়া হবে না।