করোনায় বিপর্যস্ত দুনিয়া। গতকালও হয়েছে সংক্রমণের নতুন রেকর্ড। বাংলাদেশে মৃত্যুর তালিকায় যোগ হয়েছে ৩২ জন। শনাক্তের হার কমছেই না। অথচ গত শনিবারই স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক কথা বলেন করোনার বিদায়ের সম্ভাবনা নিয়ে। ঢাকায় এক আলোচনা সভায় তিনি বলেন, বেশিদিন লাগবে না করোনা বাংলাদেশ থেকে চলে যাবে এবং ভ্যাকসিনের প্রয়োজন হবে কি-না জানি না। তার এই বক্তব্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তৈরি হয়েছে তীব্র প্রতিক্রিয়া। বিশেষজ্ঞরা জানার চেষ্টা করছেন, কিসের ভিত্তিতে এমন মন্তব্য করলেন মন্ত্রী।
এ নিয়ে কি কোনো গবেষণা হয়েছে দেশে? জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা স্পষ্টতই দ্বিমত পোষণ করেছেন মন্ত্রীর বক্তব্যের সঙ্গে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বক্তব্যের কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি আছে কি না? জানতে চাইলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সাবেক আঞ্চলিক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. মোজাহেরুল হক বলেন, স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কথাটা বিজ্ঞান ভিত্তিক না। রাজনৈতিক হতে পারে। বিজ্ঞান ভিত্তিক কথা হলো দু’টি উপায়ে করোনা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। একটি হলো ভ্যাকসিন দিয়ে। আরেকটি হলো ভ্যাকসিন যতোদিন পর্যন্ত না আসে ততোদিন পর্যন্ত আমাদেরকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যে পরামর্শগুলো দিয়েছে করোনা নিয়ন্ত্রণের এবং সারা বিশ্বের দেশগুলো যেভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে সেটাই হলো একমাত্র উপায় করোনা নিয়ন্ত্রণে আনার। বাংলাদেশ করোনা নিয়ন্ত্রণে সঠিক কৌশল এবং সঠিক পন্থা অবলম্বন করছে না। সুতরাং এই করোনা ক্রাইসিসটি দীর্ঘস্থায়ী হবে এতে কোনো সন্দেহ নেই।
প্রখ্যাত মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ বলেন, স্বাস্থ্যমন্ত্রী কীভাবে বলেছেন এ বিষয়ে তিনিই ভালো বলতে পারবেন। কোন তথ্যের ভিত্তিতে তিনি বলেছেন সেটাতো বলা মুশকিল। আসলেই কি বাংলাদেশ থেকে করোনা চলে যাওয়ার কোনো প্রকার লক্ষণ, চিহ্ন বা সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখনো বলা মুশকিল। এখনো করোনা যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। মানুষ বাড়ি চলে গেছে। তারা আবার ঢাকায় ফেরত এসেছে। এই আসা-যাওয়াতে করোনা সংক্রমণটা একটু বেড়েছে। আগামী এক সপ্তাহ পর্যবেক্ষণের পরে বোঝা যাবে যে এটা কমেছে না বেড়েছে। এখন মূলত একই রকম। কমেনি। এক সপ্তাহ পর এ বিষয়ে মন্তব্য করা যাবে। এটা আসলেই যাবে কি না। কবে যাবে। এটা কিন্তু একেবারে হলফ করে বলার সময় এখনো হয়নি।
এ বিষয়ে জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মোশতাক হোসেন বলেন, এটা বলার মতো কোনো মিটিং ছিল না তখন। এখানে উপদেষ্টা কমিটি আছে, স্বাস্থ্যমন্ত্রী সেটার চেয়ারম্যান। সেটার কোনো সিদ্ধান্ত এটা না। বা জাতীয় পরামর্শ কমিটির সিদ্ধান্তও না। করোনা বিশ্বব্যাপী কোথাও আছে। কোথাও নেই। করোনা চলে যাবে কথাটি বৈজ্ঞানিকভাবে নেয়া যাবে না। পরিস্থিতি বিষয়ক কোনো স্টেটমেন্ট না এটা। এটা স্বাস্থ্যমন্ত্রীই ভালো বলতে পারবেন। করোনা কমছে। বাড়ছে। যাচ্ছে না। ভিন্ন প্রেক্ষাপটে তিনি এটা বলেছেন। এটা আনুষ্ঠানিক কোনো মূল্যায়ন না।
তিনি বলেন, করোনা খুব একটা কমেনি। হয়তো একদিন বাড়ে একদিন কমে। মোটের ওপর একই রকম আছে প্রায় গত তিন মাস। জুনে একটু বেশি দেখা গিয়েছিল। জুলাইতে হঠাৎ করে নমুনা সংগ্রহের সংখ্যাটা কমেছে। কিন্তু শনাক্তের হার একই রয়ে গেছে। কমতে পারে যদি আমরা সবাই মিলে চেষ্টা করি। যদি রোগী শনাক্ত করে আইসোলেশন করে সঙ্গে সঙ্গে কোয়ারেন্টিন করি। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে জনগণকে উৎসাহিত করা। সব জায়গায় যদি আমরা ভলান্টিয়ার নিয়োগ করি রাজাবাজার এবং ওয়ারির মতো। তাহলে এক মাসের মধ্যেই কমিয়ে আনা সম্ভব। বিশেষ করে শহরাঞ্চলে আমাদের ভলান্টিয়ার খুবই দরকার। গ্রামে স্বাস্থ্যকর্মী আছে। কমিয়ে আনলেও আবার বাড়তে পারে। যেসকল দেশে একেবারে নাই হয়ে গিয়েছিল সেখানে তো আবার নতুন করে দেখা দিচ্ছে। বিশ্বব্যাপী এই মহামারি দূর না হলে একটা হুমকির মুখে সব দেশই থাকবে। আমাদের দেশের ভিতরেও থাকবে। দেশে করোনা কমিয়ে আনার পর আবার আক্রান্ত হতে পারে। সেটার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।
চলতি বছরের ৮ই মার্চ বাংলাদেশে প্রথম তিনজন নোভেল করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়। আক্রান্তদের মধ্যে একজন নারী এবং দু’জন পুরুষ ছিল। তাদের বয়স ২০ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে বলে জানায় আইইডিসিআর। গত বছরের ডিসেম্বরে চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে প্রথম ধরা পড়ে করোনা আক্রান্ত রোগী। পরে চীনের অন্যান্য প্রদেশ এবং বিশ্বের নানা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। দেশে বর্তমানে মোট শনাক্ত রোগীর সংখ্যা দুই লাখ ৭৬ হাজার ৫৪৯ জনে দাঁড়িয়েছে। মৃতের সংখ্যা ৩ হাজার ৬৫৭ জন।