আন্তর্জাতিক ডেস্ক: ১/০১/২০১৫ রবিবার, বেলা-১২.১৫ মিনিট। হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে বসে আছি ইএ ৭০১ ফ্লাইটের জন্য। কাঠমুন্ডুতে আন্তর্জাতিক জলবায়ু ও পরিবেশ সম্মেলনের আমন্ত্রণে ৭ সদস্য বিশিষ্ট প্রতিনিধি নিয়ে নেপালের উদ্দেশ্যে বিমান ছাড়ল ১.৩০ মিনিটে। হিমালয়ের ঘা ঘেঁষে প্রকৃতির অপরুপ সৌন্দর্য বিমানের জানালার পাশে বসে দেখতে দেখতে টেরই পেলাম না কখন ত্রিভূবন বিমান বন্দরে পৌঁছলাম। পোর্ট অব এন্ট্রি ভিসা নিয়ে ্ইমিগ্রেশন পার হয়ে দুইটি ক্যাব নিয়ে আমরা রওনা দিলাম কাঠমুন্ডু শহরের “থামেল” নামক এলাকায়। “পাকনাজল” এভিনিউয়ের স্কাইলার্ক হোটেলে সবাই উঠে পড়লাম। বিমানবন্দর থেকেই শিতের কামড় অনুভব করছিলাম। হোটেলে উঠেতো থরথর করে কাঁপতে শুরু করলাম। হিমালয় থেকে তেড়ে আসা শীতের দানবগুলো কাঠমুন্ডুসহ সমগ্র নেপালে ১ থেকে ২ ডিঃ সেঃ তাপমাত্রা নিয়ে দাবড়িয়ে বেড়াচ্ছে। ভাগ্যিস গরম কাপড় সাথে করে নিয়ে গিয়েছিলাম। রাতে খাবার খেতে বেড়িয়ে পড়লাম পাশ্ববর্তী এভিনিউ মুসলিম টুল এলাকায়। মুসলিম হোটেলগুলো ঐদিকে। পর্যটকরা সাধারণত “থামেলেই” এসে উঠে বেশী। এখানে খাবারের দাম অতিরিক্ত। ২০ টাকা এক কাপ চা আর ৪০ টাকা ডিম ওমলেট, ভাত ৮০ টাকা প্লেট।
পরদিন ১২ তারিখ ঘুম থেকে উঠে পুরো প্রস্তুতি নিয়ে ক্যাবে চেপে বসলাম kalamki নামক স্থানে Soalteecrown CS plaza র উদ্দেশ্যে। ৩০টি দেশের প্রায় ৪০০ আমন্ত্রিত অতিথিদের উপস্থিতিতে বাংলাদেশে নদী বাঁচাও আন্দোলনের পক্ষ থেকে আজ আমরা আমাদের দেশের নদী, পরিবেশ, জলবায়ু, নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে বিশ্ব দরবারে বক্তব্য তুলে ধরব। সকাল ৯টার মধ্যে রেজিষ্ট্রেশন সেরে বুকে কার্ড ঝুলিয়ে মেঘা হলরুমে প্রবেশ করলাম। বিভিন্ন দেশ থেকে আসা প্রতিনিধিদের সামনে উচ্চারিত হলো বাংলাদেশের নাম। বুকটা ভরে গেল। মঞ্চে উপবিষ্ট নেপালের দুইজন মন্ত্রীমহোদয়, আমন্ত্রিত বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানী, অধ্যাপকরা। উদ্বোধনী পর্ব সেরে শুরু হলো পর্যায়ক্রমে বক্তব্যের পালা। মাইকে ঘোষনা এল বাংলাদেশের নাম। আমরা ৭ সদস্য এক সারিতে বসা ছিলাম। আমি উঠে ধীর পায়ে এগিয়ে গেলাম মঞ্চের পাশে, মাইক ধরলাম এবং পাশের বড় মাল্টিমিডিয়ায় দেখানো Power Point এ Slide Presentation শুরু করলাম। মুহুর্মুহু করতালিতে বক্তব্য শেষ করতে শুরু হলো বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের প্রশ্ন জিজ্ঞাসা। আমি, রফিকুল ইসলাম আলম, ইঞ্জিনিয়ার জাবের আহমেদ এই তিনজন দাঁড়িয়ে তাদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরগুলো দিতে লাগলাম। আবারো করতালিতে হল কেঁপে উঠল। ঐ মুহুর্তটুকু আমার জীবনের সেরা মুহুর্ত। দুপুরের দিকে খাবার শেষ করে আবার শুরু হলো দ্বিতীয় পর্ব। ফাঁকে ফাঁকে আমেরিকা, জাপান, তুরষ্ক, ইরান, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, অস্ট্রেলিয়া, সুইডেন, কানাডা, ইথিউপিয়া এবং জার্মানীর প্রতিনিধিদের সাথে পারস্পরিক দেশের পরিবেশ ও জলবায়ু নিয়ে একান্ত সান্নিধ্যে আলাপচারিতা সারলাম। তাদেরকে বাংলাদেশে আসার আমন্ত্রণ জানালাম। আমাদেরকেও তারা আমন্ত্রণ জানালো পরবর্তীতে তাদের দেশে যেতে। আয়োজকদের আমন্ত্রণে রাতে কনফারেন্স শেষে বুফে ডিনার সেরে হোটেলের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম।
পরের দিন ১৩ তারিখ ভোর চারটায় সবাই ঘুম থেকে উঠে অন্ধকারেই রওয়ানা দিলাম Nagorkot এর উদ্দেশ্যে। পাহাড়ের আঁকাবাঁকা রাস্তা দিয়ে প্রায় ২১২০ মিটার উচ্চতায় আমাদের গাড়ি পৌঁছালো হিমালয়ের পাদদেশে। গাড়ি থেকে নেমে সিঁড়ি বেয়ে টাওয়ারে উঠলাম। শীতে শরীর, হাত-পা জমে বরফ। বসে রইলাম সূর্যোদয় দেখার জন্য। ফজরের নামাজ সবাই সারলাম ঐ টাওয়ারের উপরেই। আস্তে আস্তে সূর্যি মামা উঁকি দিতে লাগল। সে এক অবিশ্বাস্য দৃশ্য। সূর্যোদয় অনেক দেখেছি কিন্তু হিমালয়ের শীতল হাওয়ায় এই দৃশ্য শিহরণ জাগানিয়া। সবাই বাকরুদ্ধ হয়ে সূর্যোদয় দেখলাম। অনেক বিদেশী পর্যটকরাও আমাদের সাথে ছিল। সূর্য উঠার সাথে সাথে হিমালয়ের শীর্ষ অংশগুলো চিকচিক করতে লাগল। এ যেন স্বপ্নপুরীর এক অজানা রাজ্য, পৃথিবীটা এত সুন্দর !! আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের শুকরিয়া আদায় করলাম।
দুপুরের আগেই ফিরে আসলাম হোটেলে। আসার পথে নামলাম বসন্তপুরে। সেখানে দেখলাম প্রাচীণ এক শহর। হাজার হাজার পর্যটক ঘুরে বেড়াচ্ছে, ছবি তুলছে। প্রাচীণ হিন্দু রাজাদের প্রাসাদ, ঐতিহাসিক হনুমান ধোকা, যাদুঘর দেখলাম। হোটেলে ফ্রেশ হয়েই আবার ছুটলাম কনফারেন্সের উদ্দেশ্যে। সকালের সেশনটা মিস করলাম শহর ঘুরব বলে। যাওয়ার পথে দেখলাম Valanju, Vanas Thali, Sanobhayanga, Halchowk, Swoyambhu, Sitapalia, Soltidobato প্রভৃতি স্থান । বিকেলে শুরু হলো আমার উপস্থাপিতposter presentation এর ভিডিও পর্ব গ্রহণ। আমাকে সময় দেওয়া হলো পাঁচ মিনিট। উপস্থাপিত বিষয়বস্তুর Abstract Title হলো “ Gender Equality For Sustainable Livelihood Frame Work: A Common Feature Of Society.” যা পরবর্তীতে ওয়েবসাইট এবং টুইটারে আপলোড করেছে কর্তৃপক্ষ। রাতের ডিনার সেরে অন্যান্য প্রতিনিধিদের সাথে অত্যন্ত হৃদ্যতাপূর্ণ পরিবেশে আবারো মতবিনিময় সারলাম এবং হোটেলের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম।
১৪ তারিখ, কনফারেন্সের শেষ দিন। যথাসময়ে হলরুমে প্রবেশ করলাম। শুরু হলো আবারো আমন্ত্রিত অতিথিদের বক্তব্য এবং ৩ দিনের আলোচনার পর্যালোচনা এবং পরবর্তী করণীয়। প্রস্তাব আসলো উপস্থিত দেশগুলোর সমন্বয়ে একটি ফোরাম তৈরি করার। দুপুরের খাবার শেষ করে বিকেলে শুরু হলো বিদায়ী বক্তব্য। সবার মাঝেই দেখলাম কি যেন হারানোর বিষাদময় ছায়া। আমরা সবাই একসাথে ফটোসেশন করলাম। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। করমর্দন, বুক মিলিয়ে সবাই সবাইকে বিদায় জানালাম। এই ৩ দিনে আমরা সবাই যেন একটি পরিবার হয়ে উঠেছিলাম। রাতে হোটেলে ফিরে শহরের আশেপাশের মার্কেটগুলোতে একটু ঢু মারলাম।
১৫ তারিখ, একটু বেশী ঘুমিয়ে সকাল ১১টায় হোটেল ছাড়লাম। দুপুর ৩ টায় ফিরতি ফ্লাইট। ত্রিভূবন বিমান বন্দরে পৌঁছে ইমিগ্রেশন শেষ করলাম। বিমানে বসতেই খেয়াল করলাম আমার গায়ের কোটটা নেই। বিমান ছাড়তে তখন ১৫/২০ মিনিট বাকী। বুঝলাম VIp লাউঞ্জে যেখানে বসেছিলাম সেখানে ফেলে এসেছি। সহযাত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা মজিবুর রহমান কাকা বললেন, “ রনি, তোমাকে আবার আসতে হবে নেপালে।” তোমার ভুলে ফেলে আসা কোট এটাই বলে। আমরা সবাই হেসে উঠলাম। রানওয়েতে ছুটে চলল BG ৭০২. হিমালয়কে পাশ কাটিয়ে কিছু অবিস্মরণীয় স্মৃতি বুকে ধারণ করে, বাংলাদেশের পতাকাকে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরে আমরা ছুটে চললাম গন্তব্যের দিকে। শুরু হলো আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশ নদী বাঁচাও আন্দোলনের পথচলা ………………….
লেখক:
মনোয়ার হোসেন রনি
ঢাকা বিভাগীয় সমন্বয়কারী ও
কেন্দ্রীয় যুগ্ন সম্পাদক
বাংলাদেশ নদী বাঁচাও আন্দোলন