ঢাকা: নকল মাস্ক সরবরাহের অভিযোগ তদন্তে প্রমানিত হওয়ায় ঢাকার শাহবাগ থানায় নকল মাস্ক সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান অপরাজিতা ইন্টারন্যাশনালের মালিক শারমিন জাহানের বিরুদ্ধে মামলা করেছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে নকল ‘এন৯৫’ মাস্ক সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ‘অপরাজিতা ইন্টারন্যাশনালের’ স্বত্বাধিকারী শারমিন জাহানের বিরুদ্ধে এই মামলা করেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
বিএসএমএমইউ’র প্রক্টর বাদী হয়ে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় শাহবাগ থানায় মামলাটি দায়ের করেছেন। শাহবাগ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আবুল হাসান বলেন, এ বিষয়ে তদন্ত করা হচ্ছে।
বিএসএমএমইউ হাসপাতালের করোনা ইউনিটে নকল ‘এন৯৫’ মাস্ক সরবরাহের তথ্য গত মঙ্গলবার দেশ রূপান্তরের কাছে স্বীকার করে বিএসএমএমইউ কর্তৃপক্ষ।
তারা জানায়, ‘অপরাজিতা ইন্টারন্যাশনাল’ নামে দেশি একটি প্রতিষ্ঠান চীনের ‘থ্রিএম কোম্পানি’র লোগো বসিয়ে এসব মাস্ক সরবরাহ করে।
এ ঘটনায় অপরাজিতার স্বত্বাধিকারী শারমিন জাহানকে শোকজ ও তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। পরে মামলা দায়ের করা হয়।
শারমিন জাহান আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। সর্বশেষ আওয়ামী লীগের মহিলা ও শিশুবিষয়ক কেন্দ্রীয় উপকমিটিতে ছিলেন। তার আগের মেয়াদে দলের কেন্দ্রীয় উপকমিটিতে সহসম্পাদক পদে ছিলেন।
ময়মনসিংহ ও নেত্রকোণার মাঝামাঝি উপশহর শ্যামগঞ্জে এক সম্রান্ত পরিবারে ১৯৮০ সালের ডিসেম্বরে জন্ম শারমিন জাহানের। তার পারিবারিক নাম জাহানারা। চার ভাই ও তিন বোনের মধ্যে তিনি সবার ছোট। সাত বছর বয়সে হারান আব্বাকে। আব্বা শ্যামগঞ্জ এলাকায় বেশ প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী ছিলেন। আব্বার অবর্তমানে গৃহিনী আম্মাকেই ধরতে হয় সংসারের হাল। অনেক কষ্ট করে ছেলে-মেয়েদের বড় করেছেন। পরে বড় ভাই ব্যবসার হাল ধরেন। কিন্তু সেই বড় ভাই ও ভাবী চলে যান না ফেরার দেশে। তার বাকি তিন ভাইও পড়াশোনা করে এখন ব্যবসা করছেন। মেজো ভাই ইন্ডিয়ায় পড়াশোনা করেছেন। ভাবীরা সবাই গৃহিনী।
শারমিনের স্কুল ও কলেজ দুটোই শেষ করেন শ্যামগঞ্জে। জালশুকা কুমুদগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয় হতে অষ্টম শ্রেণিতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি লাভ করেন তিনি। ওই স্কুল থেকে ১৯৯৬ সালে এসএসসি এবং ১৯৯৮ সালে হাফেজ জিয়াউর রহমান মহাবিদ্যালয় হতে এইচএসসি পাস করেন।
জানা গেল শারমিনের ছাত্ররাজনীতিতে জড়ানো পেছনের কথা। ১৯৯৬ সালে হাফেজ জিয়াউর রহমান মহাবিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষে ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে কলেজ ছাত্র সংসদে ইলেকশন করেন শারমিন। ছাত্রী মিলনায়তন সম্পাদিকা হিসেবে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হন। শুরু হয় তার ছাত্ররাজনীতি। ক্যাম্পাসে সব ধরনের কার্যক্রমে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছেন। এইচএসসি পাস করার পরে ইকোনোমিক্স নিয়ে ভর্তি হন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পরিচালিত ময়মনসিংহ শহরে আনন্দমোহন কলেজে। কিছু দিন পড়ার পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেয়ে যান। ১৯৯৮-৯৯ শিক্ষাবর্ষে ভর্তি হন ঢাবির ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগে। উঠেন বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হলে। শুরু করেন বিশ্ববিদ্যালয় জীবন।
বাবার মৃত্যুর পরে তাকে ভাইদের সংসারেই বড় হতে হয়। কলেজে ছাত্র রাজনীতি করাতে বাধা না দিলেও ভাইয়েরা তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি না করে মনযোগ দিয়ে পড়াশোনা করার অনুরোধ করেন। কিন্তু কে শোনে কার কথা। কথায় আছে না, ‘ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে’। তার অবস্থাও হলো তাই। ২০০০ সালের ২৫ মে প্রথম বর্ষের ছাত্রী অবস্থায়ই তিনি হলের প্রচার সম্পাদক নির্বাচিত হন। ২০০১ সালের ১ অক্টোবর জাতীয় নির্বাচনের পরে ৪ অক্টোবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে প্রথম মার খেয়েছেন শারমিন। কুয়েত মৈত্রী হল ছাত্রদলের মেয়েরা তাকে ধরে নিয়ে অকথ্য নির্যাতন করেন। ওই কমিটিতে প্রেসিডেন্ট ছিলেন রোজি আপা বর্তমান মহিলা আওয়ামীলীগের দফতর সম্পাদক এবং সেক্রেটারি অপর্ণা পাল। বর্তমানে তিনি কানাডায় বাংলাদেশ অ্যাম্বাসিতে ফাস্ট সেক্রেটারি হিসেবে কর্মরত আছেন। প্রচার সম্পাদকের সব দায়িত্ব সক্রিয়ভাবে সম্পন্ন করার জন্য ২০০২ সালের একই তারিখে তিনি হলের সভাপতি নির্বাচিত হন। এভাবেই রাজনীতিতে জড়িয়ে যান তিনি।সরাজনীতি থেকে আর বের হতে পারেননি শারমিন। ঢাবি থেকে বের হয়েও ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে ছিলেন। সর্বশেষ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মহিলা ও শিশু-বিষয়ক কেন্দ্রীয় উপকমিটিতে ছিলেন। তার আগের মেয়াদেও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপ-কমিটিতে সহ সম্পাদক পদে ছিলেন।
ঢাবিতে পড়াশোনা চলাকালেই ২০০৫ সালের সেপ্টেম্বরে পারিবারিকভাবেই বিয়ে করেন শারমিন। শ্বশুর মরহুম শাহ আলম ভূঁইয়া একজন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা এবং স্বামী শরীফুল আলম ভুঁইয়া একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। বাড়ি চাঁদপুরের কচুয়ায়। শুরু হয় তার সংসার জীবন। বর্তমানে দুই সন্তানের মা। মেয়ে সাহিব শায়িরাহ আলম অরিন এবং ছেলে মো. শাহেদ আব্দুল্লাহ শাকীক। তারা দুজনই এখন উদয়ন স্কুলে পড়ছে।
একটি পত্রিকাকে ৫ জুলাই শারমিন জাহান বলেছিলেন, কোভিট ১৯ এর শুরু থেকে ঢাকা ডিসি অফিসে আমি স্বাস্থ্য সুরক্ষা পণ্যগুলো দিয়ে আসছি। ডিসি অফিসে একটা বিল আনতে গেলে এনডিসি অরুণ কৃষ্ণ পাল আমাকে বলেন, আপনার সাথে কাজ করে আমরা ভীষণ হ্যাপি। এই প্রথম কোনো সাপ্লাইয়ারের কথা এবং কাজের মিল পেয়েছি। সম্প্রতি বঙ্গবন্ধু মেডিকেলেও এন৯৫ মাস্ক দিয়েছি। বঙ্গবন্ধু মেডিকেলের বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালক (হাসপাতাল) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জুলফিকার আহমেদ আমিনও আমাকে একই কমপ্লিমেন্ট দিয়েছেন। পুলিশ প্রশাসনেও নিয়মিত স্বাস্থ্য সুরক্ষা প্রোডাক্ট দিয়েছি। সবাই আমার কাজ ও কমিটমেন্টের জন্য খুশি।
বর্তমানে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্টার অফিসের প্রশাসন- ১ শাখায় সহকারী রেজিস্ট্রার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।