ঢাকা: অবিরাম বর্ষণ আর উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে বাড়ছে নদনদীর পানি। এতে দেশের প্রায় ১৬ জেলা বন্যা কবলিত হয়ে পড়েছে। উত্তরাঞ্চলের বেশ কয়েকটি জেলার নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। কুড়িগ্রামের চিলমারী ও উলিপুর উপজেলার আরো ১০টি গ্রাম নতুন করে প্লাবিত হয়েছে। এ নিয়ে জেলার সাড়ে ৩ লাখ পানিবন্দি মানুষ মানবেতর জীবন-যাপন করছেন। ত্রাণের জন্য হাহাকার করছেন বানভাসিরা। টানা বর্ষণের ফলে সুনামগঞ্জে ৩য় দফা বন্যার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ওদিকে উত্তাল পদ্মায় তীব্র স্রোতের কারণে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌরুটের ফেরি চলাচল। স্রোতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ফেরিগুলো চলাচল করতে না পারায় ঘনঘন বিকল হয়ে পড়ছে।
এতে দেখা দিয়েছে ফেরি সংকট। মাদারীপুরের কাঁঠালবাড়ি ও মুন্সিগঞ্জের শিমুলিয়া ফেরি পারাপারে তিন গুণ সময় লাগায় উভয় পাড়ে যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। এদিকে যমুনার প্রচণ্ড স্রোতে সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর থানার বেতিল সলিড স্পার বাঁধে ধস নেমেছে। আকস্মিক প্রায় ৭৫ মিটার ধসে এলাকা জুড়ে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, আগামী ২৪ থেকে ৭২ ঘণ্টায় দেশের উত্তরাঞ্চল, উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং তৎসংলগ্ন ভারতের হিমালয় পাদদেশীয় পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও মেঘালয় প্রদেশে ভারী থেকে অতিভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে ব্রহ্মপুত্র-যমুনা, উত্তরাঞ্চলের ধরলা ও তিস্তা এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলের উজান মেঘনা অববাহিকার প্রধান নদনদীগুলোতে পানি দ্রুত বৃদ্ধি পেতে পারে। বিস্তারিত আমাদের প্রতিনিধিদের পাঠানো রিপোর্টে-
সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, রাতভর বর্ষণ আর উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সুনামগঞ্জে নদীর পানি বাড়ছে। ফলে ৩য় দফা বন্যার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে জেলায়। এতে করে চলমান বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতির আশঙ্কা করেছে সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড। গতকাল সুনামগঞ্জে সুরমা, কুশিয়ারা, যাদুকাটা, রক্তি, পুরাতন সুরমা, খাসিয়ারামারা, চলতি, চেলাই নদীসহ জেলার সবক’টি নদীর পানি বেড়েছে। প্রথম ও দ্বিতীয় দফার বন্যার পানি এখনো নামেনি। এ অবস্থায় আবারো পানি বাড়তে থাকায় দুর্গত মানুষ আরো বেশি বিপাকে পড়েছেন। পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, গত ৭২ ঘণ্টায় বন্যা পরিস্থিতি কিছুটা স্থিতিশীল থাকলেও গতকাল থেকে অবনতি হতে শুরু করেছে। গেল কয়েকদিন বৃষ্টিপাত না হওয়ায় দুর্গত এলাকার বাড়িঘর থেকে পানি নেমে যেতে শুরু করেছিল। কিন্তু গতকাল সোমবার সকাল থেকে পানি বাড়তে শুরু করে। শহরের ষোলঘর পয়েন্টে সুরমা নদীর পানি বিপদসীমার ৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড আরো জানায়, শক্তিরখলা, দিরাই, সুনামগঞ্জ, মুসলিমপুর, ডলুরা, আক্তাপাড়া, জগন্নাথপুর, সোলেমানপুর স্টেশনে সুরমা, ঝালুখালি, পুরাতন সুরমা, মহাসিং, নলজুর, পাটলাই নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ১৯০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।
স্থানীয় সরকার ও প্রকৌশল অধিপ্ততর সূত্রে জানা গেছে, পরপর দু’দফা বন্যায় জেলার ২৫টি সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বন্যায় ৯০০ কিলোমিটার সড়ক ও অর্ধশতাধিক সেতু ও কালভার্টের সংযোগ সড়ক ভেঙে গেছে। এছাড়া উপজেলা সদরের গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলোর মধ্যে ২২টি ওয়াশ আউট হয়ে গেছে। সুনামগঞ্জ এলজিইডি’র নির্বাহী প্রকৌশলী মাহাবুব আলম বলেন, পরপর দু’দফা বন্যায় জেলার সড়ক অবকাঠামোর ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। পানি নামার সঙ্গে সঙ্গে দ্বিতীয় পর্যায়ের বন্যার ক্ষতচিহ্ন ব্যাপক আকারে দেখা দিয়েছে। জেলা প্রশাসকের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, জেলার ৮৭টি ইউনিয়ন ও ৪ পৌরসভার ২২১টি আশ্রয়কেন্দ্রে ১ হাজার ১০৬টি পরিবারের ৭ হাজার ৫১৯ জন আশ্রয় নিয়েছে। জেলায় ১ লাখ ৮ হাজার ৩২৯টি পরিবার বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব পরিবারের মধ্যে ২ লাখ টাকার গো-খাদ্য দুই লাখ টাকার শিশুখাদ্য বিতরণ করা হয়েছে।
স্টাফ রিপোর্টার, কুড়িগ্রাম থেকে জানান, কুড়িগ্রামে ধরলা নদীর পানি বেড়ে আবারো পানিবন্দি হয়ে পড়েছে নদী তীরবর্তী এলাকার হাজার হাজার মানুষ। অপরদিকে, ব্রহ্মপুত্র নদের পানি অপরিবর্তিত থাকলেও বিপদসীমার উপরে অবস্থান করায় টানা তিন সপ্তাহ ধরে মানুষ অবর্ণনীয় কষ্টের মধ্যে রয়েছে। চিলমারী উপজেলার কাঁচকোল এলাকায় ভাঙা রাস্তা দিয়ে বন্যার পানি প্রবেশ করে চিলমারী ও উলিপুর উপজেলার আরো ১০টি গ্রাম নতুন করে প্লাবিত হয়েছে। এ নিয়ে জেলার সাড়ে ৩ লাখ পানিবন্দি মানুষ মানবেতর জীবন-যাপন করছেন। জেলার ৭৩টি ইউনিয়নের মধ্যে ৬২টি ইউনিয়নের ৫ শতাধিক গ্রাম পানির নিচে তলিয়ে আছে। লোকজন বন্যার পানির মধ্যে বাড়ির ভিতর চৌকি উঁচু করে, রাস্তায়, রেললাইন, সড়ক ও বাঁধে অবস্থান নিয়েছে। ভারি বর্ষণের কারণে তাদের দুর্ভোগ চরমে উঠেছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ২০০ মিলিমিটার বৃষ্টি রেকর্ড করে রাজারহাট কৃষি আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগার। ফলে জেলা শহরসহ সর্বত্র জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। পানির স্রোতে সদরের যাত্রাপুর ও ঘোগাদহ ইউনিয়নের একটি সড়কের দুই জায়গা পানি তলিয়ে যাওয়ায় বড় যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। বন্যার কারণে জেলার সবচেয়ে বড় পশুর হাট ‘যাত্রাপুর হাট’ বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে।
স্টাফ রিপোর্টার, মানিকগঞ্জ থেকে জানান, উত্তাল পদ্মায় তীব্র স্রোতের কারণে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌরুটের ফেরি চলাচল। স্রোতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ফেরিগুলো চলাচল করতে না পারায় ঘনঘন বিকল হয়ে পড়ছে। এতে দেখা দিয়েছে ফেরি সংকট। আর স্র্রোতের বিপরীতে ফেরিগুলো পাটুরিয়া থেকে দৌলতদিয়া পৌঁছাতে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে দ্বিগুণ সময় লাগছে। ফলে ফেরির টিপ কমে যাওয়ায় পাটুরিয়া ও দৌলতদিয়া ঘাটে যানবাহনের চাপ বেড়েছে। বিশেষ করে পণ্যবাহী ট্রাকগুলো ২-৩ দিনেও নদী পারাপার করতে পারছে না। সব মিলিয়ে বন্যার পানি আর তীব্র স্রোতের কারণে পাটুরিয়া ও দৌলতদিয়া ঘাটে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
বিআইডব্লিউটিসি আরিচা অফিস সূত্রে জানা গেছে, পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌরুটে মোট ১৮টি ফেরি বরাদ্দ রাখা হয়েছে। তবে এর মধ্যে ১৫টি ফেরি দিয়ে যানবাহন পারাপার করা হচ্ছিল। তবে স্রোতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রো রো ফেরি আমানত শাহ্ ও বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান চলতে না পারায় বিকল হয়ে পাটুরিয়া মধুমতি ভাসমান কারখানায় মেরামত করার জন্য নেয়া হয়েছে।
চৌহালী (সিরাজগঞ্জ) প্রতিনিধি জানান, যমুনার প্রচণ্ড স্রোতে সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর থানার বেতিল সলিড স্পার বাঁধে ধস নেমেছে। আকস্মিক প্রায় ৭৫ মিটার এলাকা ধসের কারণে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। এদিকে জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ড ধসের বিস্তৃতি ঠেকাতে বালুভর্তি জিও ব্যাগ ফেলা শুরু করেছে।
স্থানীয়রা জানান, যমুনায় পানি বৃদ্ধির ফলে সোমবার সকালে বেতিল স্পার বাঁধের স্যাংকে হঠাৎ করে প্রচণ্ড স্রোতে ধস নামতে শুরু করে। তা দুপুর পর্যন্ত ৭৫ মিটারে বিস্তৃতি লাভ করে বাঁধের মাঝখান পুরো বিলীন হয়। পাথরের বোল্ডগুলো ধসে পড়ে নদীতে। ওই সময় উত্তর পাশের একটি বাড়িও ভেঙে যায়।
এদিকে বাঁধ ধসের খবর পেয়ে জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের একটি টিম সোমবার দুপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে বিস্তৃতি ঠেকাতে কাজ শুরু করে। ফেলা হয় বালুভর্তি জিও ব্যাগ। উত্তরপাশের মাঝখানে জাগা চরের ফলে নদীর গতিপথ পরিবর্তন হয়ে বাঁধের মাঝামাঝি এই স্থানে স্রোতে ধস নামার মূল কারণ বলে জানান জেলা পাউবো নির্বাহী প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম। এলাকাবাসীকে আতঙ্কিত না হবার পরামর্শ দিয়ে তিনি জানান, প্রতিবছরই এই স্থানে ধস নেমে আসছে মূলত নদীর গতিপথ পরিবর্তনের কারণে। বাঁধের উত্তর পাশের জেগে ওঠা চর অপসারণ ও আগামী শুষ্ক মৌসুমে পুরো বাঁধটি স্থায়ীভাবে মেরামত করা হলে বাঁধ ঝুঁকিমুক্ত হবে।
শিবচর (মাদারীপুর) প্রতিনিধি জানান, পদ্মায় প্রবল স্রোতের সৃষ্টি হয়েছে। এতে মাদারীপুরের কাঁঠালবাড়ি ও মুন্সিগঞ্জের শিমুলিয়া নৌপথে ফেরি পারাপারে তিনগুণ সময় লাগায় উভয় পাড়ে যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। সোমবার উভয় ঘাটে সহস্রাধিক গাড়ি আটকেছিল। এতে যাত্রী ও পরিবহন শ্রমিকেরা পড়েছেন চরম দুর্ভোগে।