ঢাকা: ভারত থেকে আসা পাহাড়ি ঢল ও টানা বৃষ্টিপাতের ফলে দেশের বিভিন্ন জেলায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে। নদ-নদীর পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে অনেক জেলায়। এর মধ্যে সুনামগঞ্জের পরিস্থিতি খুবই খারাপ। সরকারের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছে, বন্যা এরই মধ্যে ১০ জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে। আরো ১০ থেকে ১২ দিন তা চলতে পারে। দেশের ১৮ থেকে ২০টি জেলার নিচু এলাকা এই বন্যায় প্লাবিত হতে পারে। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার কৃষকরা ফসল নিয়ে কী করবেন, সে ব্যাপারে আবহাওয়া অধিদফতর ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর থেকে এই পরিস্থিতিতে কৃষকদের করণীয় নিয়ে একটি বিশেষ বুলেটিন প্রকাশ করেছে।
এ দিকে সীমান্ত সংলগ্ন সুনামগঞ্জ জেলা শহরসহ বিভিন্ন উপজেলার সড়ক বন্যার পানিতে ডুবে গেছে। অন্য যানবাহনের পাশাপাশি এখন সড়কে চলছে নৌকা। গন্তব্যে পৌঁছতে অল্প ভাড়ায় এ নৌকাই যেন আশার আলো। ২০০৪ সালের ভয়াবহ বন্যার পর ২০২০ সালে সড়কে এমন নৌকা দেখছে হাওরবাসী। এ ছাড়া জামালপুরের বিভিন্ন উপজেলায় বন্যার পানিতে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। দেওয়ানগঞ্জে ব্রহ্মপুত্র, যমুনার শাখা নদীগুলোর পানি বেড়ে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। বাহাদুরাবাদ পয়েন্টে নদীর পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। যমুনার পানি সারিয়াকান্দির কাছে বিপদসীমার ৩৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। হুমকির মুখে পড়েছে সারিয়াকান্দিতে নির্মিতব্য কোটি টাকার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ। নীলফামারীর ডালিয়া তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে পানি বিপদসীমার ১৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। তিস্তার পানি বেড়ে যাওয়ায় নদীভাঙনও শুরু হয়েছে।
গাজলডোবার সব ক’টি গেট খুলে দেয়া এবং পাহাড়ি ঢল ও ভারী বর্ষণে তিস্তার ১৫২ কিলোমিটার এবং ধরলা ও ব্রহ্মপুত্র এলাকার ৩৬০ কিলোমিটার এলাকার নিম্নাঞ্চলের লক্ষাধিক মানুষ এখন পানিবন্দী। মহা দুর্ভোগে দিন কাটছে তাদের।
সুনামগঞ্জ থেকে তৌহিদ চৌধুরী প্রদীপ জানান, গত কয়েক দিনের টানা বৃষ্টিপাত ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলের পানি বাড়তে থাকায় সুনামগঞ্জে লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দী অবস্থায় রয়েছেন। জেলায় ৭৮টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে ও ১৪৮টি পরিবারকে সেখানে নেয়া হয়েছে। জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, প্রাথমিক পর্যায়ে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪৪ হাজার ১১০টি। কিন্তু বেসরকারি হিসাব মতে, লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দী রয়েছেন। জেলা শহরসহ ছাতক, দোয়ারাবাজার, তাহিরপুর, বিশ্বম্ভরপুর, জামালগঞ্জ, দক্ষিণ সুনামগঞ্জ, দিরাই ও শাল্লাসহ সব ক’টি উপজেলার নিন্মাঞ্চল প্লাবিত হয়ে লাখো মানুষ ঘরবন্দী হয়ে পড়েছেন। পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, গত ২৪ ঘণ্টায় শহরের ষোলঘর পয়েন্টস্থ সুরমা নদীর পানি বিপদসীমার ৭২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। রোববার বিকেল পর্যন্ত সুরমার পানি ৬৩ সেন্টিমিটার বেশি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
এ দিকে গত ২৪ ঘণ্টায় ২১৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। ছাতক-সুনামগঞ্জ ও সিলেটের রাস্তা পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে জেলার ছাতক উপজেলা। ছাতকের সুরমা নদীতে গত ২৪ ঘণ্টায় বিপদসীমার ১৭৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ১৩০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। এই উপজেলায় ইতোমধ্যে তিনটি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে এবং বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে প্রস্তুত রাখা হয়েছে। প্রায় লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী রয়েছেন বলে উপজেলা প্রশাসন জানিয়েছেন।
সুনামগঞ্জ শহরের কাজীর পয়েন্ট, উকিলপাড়া, নতুনপাড়া, বড়পাড়া সাহেববাড়ি ঘাট, ষোলঘর হাজীপাড়া, জামতলাসহ অধিকাংশ এলাকার বাসাবাড়ি রাস্তাঘাট পানিতে নিমজ্জিত হয়ে পড়ায় রাস্তাঘাটে যানবাহন চলাচল নেই বললেই চলে। ফলে মানুষজন খাদ্য সঙ্কটে ভুগছেন। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় জামালগঞ্জ-সুনামগঞ্জ সড়কের উজ্জলপুরের উত্তরে মূল সড়ক ভেঙে জেলা সদরের সাথে জামালগঞ্জের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। সারা দিন বিদ্যুৎও বিচ্ছিন্ন ছিল। এ ছাড়া বিশ্বম্ভরপুর, তাহিরপুর, দিরাই শাল্লা ও ছাতক উপজেলার সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কে পানি উঠে যাওয়ায় যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। সুনামগঞ্জ জেলা শহরের সাথে ১১টি উপজেলার সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, ৩ হাজার ৭৬৫ হেক্টর আউশ ধানের জমি ও ১৮৮ হেক্টর বর্ষাকালীন সবজিক্ষেত ঢলের পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। আগামী ৪৮ ঘণ্টায় সুনামগঞ্জে আরো বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে বলেও জানান পাউবো কর্তৃপক্ষ। জামালগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বিশ্বজিত দেব জানান, জরুরি কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে। বন্যায় প্লাবিত সব এলাকায় সরকারি ত্রাণসহায়তা প্রদানের জন্য জনপ্রতিনিধিদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, যেভাবে বৃষ্টিপাত অব্যাহত রয়েছে তাতে বন্যার আশঙ্কা থেকে প্রতিটি উপজেলার আশ্রয়কেন্দ্রগুলোকে প্রস্তুত রাখা হয়েছে। বন্যায় কত হাজার পরিবার ঘরবন্দী হয়েছেন তাদের সঠিক পরিসংখ্যান এখনো জানা না গেলেও প্রায় লাখো মানুষ পানিবন্দী হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ দিকে জেলায় রোপা আমন, সবজিক্ষেত ও পুকুরের মাছ ভেসে যাওয়ায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। জেলা প্রশাসন জেলায় বন্যাকবলিত এলাকার মানুষজনের জন্য খাদ্যসহায়তা হিসেবে ৪১০ মেট্রিক টন চাল ও ২৯ লাখ টাকা বিভিন্ন উপজেলা নির্বাহী অফিসারদের হাতে পৌঁছে দেয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো: সহিবুর রহমান জানান, টানা অবিরাম বৃষ্টিপাতের ফলে জেলা শহরসহ কয়েকটি উপজেলার নিন্মাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। যেভাবে বৃষ্টিপাত অব্যাহত রয়েছে তাতে বন্যার একটি আশঙ্কা রয়েছে।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল আহাদ বলেন, এই বৃষ্টিপাতের ফলে বিভিন্ন জায়গাতে বাসা বাড়িতে পানি প্রবেশ করেছে। জেলায় ৭৮টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে ও ১৪৮টি পরিবারকে আশ্রয়কেন্দ্রে নেয়া হয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪৪ হাজার ১১০টি। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তার জন্য ইতোমধ্যে ৪১০ মেট্রিক টন চাল ও ২৯ লাখ টাকা বিভিন্ন উপজেলায় নির্বাহী অফিসারের নিকট পাঠানো হয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রে কারো করোনা উপসর্গ থাকলে তাকে আলাদা স্থানে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রে সাবান, হ্যান্ড স্যানিটাইজার ও মাস্ক সরবরাহ এবং চিকিৎসা নিশ্চিত করার জন্য মেডিক্যাল টিম গঠন করা হয়েছে।
ছাতকে দুই লক্ষাধিক পানিবন্দী
ছাতক (সুনামগঞ্জ) সংবাদদাতা জানান, ছাতকে টানা তিন দিনের ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে পানিবন্দী হয়ে পড়েছে প্রায় দুই লক্ষাধিক মানুষ। সুরমা, চেলা, পিয়াইনসহ উপজেলার সব নদ-নদীতে পানি বাড়ছে। বন্যার পানি হাওর ও খাল-বিলে থই থই করছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র অনুযায়ী, ছাতক পয়েন্টে সুরমা নদীর পানি বিপদসীমার ১৬০ সেমি. এবং চেলা ও পিয়াইন নদীর পানি বিপদসীমার ১৮০ সেমি. ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে পানি বৃদ্ধির ফলে পৌরসভাসহ উপজেলার ইসলামপুর, কালারুকা, নোয়ারাই, উত্তর খুরমা, চরমহল্লা, ভাতগাঁও, দোলারবাজার, জাউয়া, দক্ষিণ খুরমা, সিংচাপইড়, ছৈলা-আফজালাবাদ ও গোবিন্দগঞ্জ- সৈদেরগাঁও ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রাম ও হাটবাজার প্লাবিত হয়ে পড়েছে। গ্রামীণ সড়ক ডুবে যাওয়ায় যান চলাচল বন্ধ হয়ে পড়েছে। বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে ছাতক-সিলেট সড়কের একটি অংশ। এতে ঝুঁকি নিয়ে যান চলাচল করছে। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে সারা দেশের সাথে ছাতকের সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। বসতঘরে পানি উঠে যাওয়ায় শতাধিক পরিবার আশ্রয় নিয়েছেন নিরাপদ স্থানে। ইতোমধ্যে ভেসে গেছে কয়েক শতাধিক মৎস্য খামারের মাছ। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শাকসবজির বাগান ও ক্ষেতের ফসল। এ ছাড়া বিভিন্ন ইউনিয়নের দুই লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী অবস্থায় রয়েছেন।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো: গোলাম কবির জানান, উপজেলা পরিষদ চত্বর, পৌরসভার বিভিন্ন এলাকা এবং হাটবাজার ও রাস্তাঘাটে বন্যার পানি ঢুকে পড়েছে। এখানে প্রবল বন্যার আশঙ্কা করা হচ্ছে। তিনি সবাইকে সতর্ক থাকা এবং দুর্যোগ মোকাবেলায় প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন।
ধর্মপাশায় শতাধিক গ্রাম পানিবন্দী
ধর্মপাশা (সুনামগঞ্জ) সংবাদদাতা জানান, ধর্মপাশায় গুরুত্বপূর্ণ একাধিক পাকা সড়কসহ শতাধিক গ্রাম পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। সুরমা ও কংশ নদীতে বিপদসীমার ওপর দিয়ে ঢলের পানি প্রবাহিত হচ্ছে। এ দিকে গত বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার বজ্রপাত ও কালবৈশাখীতে নৌকাডুবির ঘটনায় স্থানীয় তিন ব্যক্তি প্রাণ হারিয়েছেন। ধর্মপাশার ওপর দিয়ে কয়েক দিন ধরে কালবৈশাখী অব্যাহত রয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় গত শনিবার সকাল ৯ টায় উপজেলার সুখাইড় রাজাপুর উত্তর ইউনিয়নের নুরপুর গ্রামে হঠাৎ ঝড়ের আঘাতে ২৫-৩০টি কাঁচা ও আধা পাকা বাড়িঘর লণ্ডভণ্ড ও গাছপালা বিধ্বস্ত হয়।
এ ছাড়া বন্যা পরিস্থিতির অবনতিতে ইতোমধ্যে উপজেলার ১০টি ইউনিয়নের কাঁচা ও পাকা সড়ক তলিয়ে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। উপজেলার শতাধিক গ্রাম পানিবন্দী হয়ে রয়েছে। জয়শ্রী বাজার, গোলকপুর, মধ্যনগর বাজার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। দুই শতাধিক পুকুরের পাড় ডুবে কোটি কোটি টাকার মাছ ভেসে গেছে।
এ ব্যাপারে স্থানীয় সংসদ সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন রতন বলেন, খবর পেয়েই তাৎক্ষণিক নূরপুর গ্রামে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের লোকজনকে উদ্ধার করে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। এসব পরিবারের জন্য যা প্রয়োজন আমরা সরকারের পক্ষ থেকে তাই করব। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো: মুনতাসির হাসান পলাশ তিনি বলেন, বন্যা ও ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারদের সরিয়ে নিরাপদ স্থানে আনা হচ্ছে।
বাহাদুরাবাদ পয়েন্টে বিপদসীমার ওপর পানি
দেওয়ানগঞ্জ (জামালপুর) সংবাদদাতা জানান, দেওয়ানগঞ্জে ব্রহ্মপুত্র, যমুনার শাখা নদীগুলোর পানি বৃদ্ধি পেয়ে নিন্মাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। বাহাদুরাবাদ পয়েন্টে বিপদসীমার ওপর পানি প্রবাহিত হচ্ছে। উপজেলা পরিষদ, দেওয়ানগঞ্জ রেল স্টেশন, হাসপাতাল রোড পানিতে ডুবে গেছে। উপজেলা পরিষদের বেশির ভাগ বিভাগীয় দফতরগুলোর প্রাঙ্গণে পানি উঠায় স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। অফিসের কাগজপত্র ও আসবাবপত্র অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হচ্ছে। সরকারি কার্যক্রম অস্থায়ী স্থানে করার প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে।
দেওয়ানগঞ্জ-খোলাবাড়ী রোডে মণ্ডল বাজার এলাকায় প্রধান সড়কের বৃহদাংশ ভেঙে গেছে। দেওয়ানগঞ্জ-তারাটিয়া রোডের সবুজপুর এলাকায় সড়ক ভাঙনের মুখে। চিকাজানী ইউনিয়নের খোলাবাড়ীতে প্রায় ৬ কোটি টাকায় নির্মিত বাহাদুরাবাদ নৌ-থানা বিলীনের মুখে। দেওয়ানগঞ্জ ইউএনও সুলতানা রাজিয়া ও উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিসার এনামুল হাসান জানান, ইতোমধ্যে বন্যার্তদের জন্য দুইটি আশ্রয়কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। এখানে ১১৬টি পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। করোনার সঙ্কটে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে সামাজিক দূরত্বকে। পিআইও এনামুল হাসান জানান, পৌরসভাসহ উপজেলার দেওয়ানগঞ্জ, চুকাইবাড়ী, চিকাজানী, বাহাদুরাবাদ, হাতিভাঙ্গা, পাররামপুর, চরআমখাওয়া ও ডাংধরা ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে।
বকশীগঞ্জে প্লাবিত নতুন নতুন এলাকা
বকশীগঞ্জ (জামালপুর) সংবাদদাতা জানান, বকশীগঞ্জে বন্যার পানি হু হু করে বাড়ছে। উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও কয়েক দিনের প্রবল বর্ষণের ফলে নদ-নদীগুলো ভরে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এতে করে নদী তীরবর্তী এলাকায় বন্যা শুরু হয়েছে। বন্যার পানি বৃদ্ধির পাশাপাশি কয়েকটি গ্রামে নদী ভাঙন দেখা দিয়েছে। নদীতে বিলীন হয়েছে কমপক্ষে ১০টি বাড়ি। অব্যাহতভাবে পানি বাড়ার ফলে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। নতুন করে আরো ১০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এ নিয়ে উপজেলার সাধুরপাড়া, মেরুরচর, নিলক্ষিয়া ও বগারচর ইউনিয়নের ২৫ গ্রামে বন্যার পানি প্রবেশ করেছে। এতে প্রায় ১০ হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন।
গত শুক্রবার ও শনিবারে নিলক্ষিয়া ইউনিয়নের দক্ষিণ কুশলনগর গ্রামে দশানী নদীর ভাঙনে ১০টি বাড়ি নদীতে চলে গেছে। আরো ১৫ পরিবার ভাঙনের কবল থেকে রক্ষা পেতে বাড়িঘর সরিয়ে নিচ্ছেন। পানি বৃদ্ধির ফলে সাধুরপাড়া ইউনিয়নের বিলেরপাড়, উত্তর আচ্চা কান্দি, মদনের চর, কুতুবের চর, চর গাজীরপাড়া গ্রাম প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। নৌকা ব্যতীত এই গ্রামগুলোতে যাওয়া যাচ্ছে না। এ কারণে মানুষের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। অন্য দিকে দ্রুত গতিতে পানি বৃদ্ধির কারণে কৃষকের সবজি, মরিচখেত, পাটখেত পানিতে ডুবে যাচ্ছে। দিশেহারা কৃষক পাট পরিপক্ব হওয়ার আগেই কেটে ফেলছেন।
সাধুরপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মাহমুদুল আলম বাবু জানান, তার ইউনিয়নের ১০ গ্রামের মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। তিনি বন্যাকবলিত এলাকায় সরকারিভাবে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম শুরুর দাবি জানিয়েছেন। বকশীগঞ্জের ইউএনও আ স ম জামশেদ খোন্দকার জানান, উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বন্যা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। পরিস্থিতি দেখে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম শুরু করা হবে।
যমুনার পানি ৬৩ সেন্টিমিটার ওপরে
জামালপুর সংবাদদাতা জানান, জামালপুরে যমুনা ও ব্রহ্মপুত্রের পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। গতকাল রোববার বেলা ৩টায় দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার বাহাদুরাবাদ পয়েন্টে যমুনার পানি বিপদসীমার ৬৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। এ পর্যন্ত জেলার ইসলামপুর, দেওয়ানগঞ্জ, বকশীগঞ্জ, মেলান্দহ, মাদারগঞ্জ ও সরিষাবাড়ী উপজেলার অন্তত ২০টি ইউনিয়নে পানিবন্দী হয়ে পড়েছে অন্তত ২০ হাজার মানুষ। পানি প্রবেশ করেছে দেওয়ানগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয় চত্বরে। ইসলামপুর-উলিয়া-মাহমুদপুর সড়ক ও গুঠাইল বাজার-জারুলতলা-মলমগঞ্জ সড়কে যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। তলিয়ে গেছে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
নতুন করে প্লাবিত হয়েছে ইসলামপুর উপজেলার বেলগাছা, কুলকান্দি ও সাপধরী ইউনিয়ন, দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার বাহাদুরাবাদ ইউনিয়ন ও পৌরসভার বিভিন্ন এলাকায়, বকশীগঞ্জ উপজেলার সাধুরপাড়া ও মেরুরচর ইউনিয়ন এবং সরিষাবাড়ী উপজেলার পিংনা, পোগলদীঘা, আওনা, কামারাবাদ ও সাতপোয়া ইউনিয়নের নিন্মাঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকা।
সারিয়াকান্দিতে হুমকির মুখে বাঁধ
বগুড়া অফিস ও সারিয়াকান্দি সংবাদদাতা জানান, পাহাড়ি ঢল ও ভারী বর্ষণের ফলে যমুনার পানি সারিয়াকান্দির নিকট বিপদসীমার ৩৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি বৃদ্ধির ফলে সারিয়াকান্দি উপজেলার চালুয়াবাড়ী, হাটশেরপুর, কাজলা, কর্নিবাড়ী, চন্দনবাইশা, বোহাইলসহ ছয়টি ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চলের ৪ হাজার ৭৬ হেক্টর জমির পাট, আউশ, শাকসবজি, রোপা আমন বীজতলা, ভ্ট্টুা ও মরিচ ফসল পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আব্দুল হালিম জানান, পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে আরো ফসলি জমি তলিয়ে যেতে পারে। উপজেলার কুতুবপুর ইউনিয়নের প্রায় এক কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণাধীন বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। অসময়ে বাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু হওয়ায় উপজেলার কুতুবপুর, চন্দনবাইশা, কামালপুর ইউনিয়নের লোক আতঙ্কে রয়েছে। বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধটির নির্মাণকাজ সমাপ্ত না হলে যেকোনো মুহূর্তে পানির তোড়ে এলাকার ফসলি জমিসহ বাড়িঘর পানিতে ভেসে যেতে পারে বলে তারা আশঙ্কা করছেন।
তিস্তার পানি বিপদসীমার ওপরে
নীলফামারী সংবাদদাতা জানান, তিস্তা নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়া অব্যাহত রয়েছে। রোববার সকাল ৬টা থেকে নীলফামারীর ডালিয়া তিস্তা ব্যারাজ পয়েন্টে বিপদসীমার ১৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। তিস্তার পানি বেড়ে যাওয়ায় নদী ভাঙন শুরু হয়েছে। ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানায়, তিস্তার পানি গত দুই দিন ধরে বিপদসীমার ১৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানির গতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে তিস্তা ব্যারাজের ৪৪টি জলকপাট খুলে দেয়া হয়েছে।
এ দিকে তিস্তার পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় ডিমলা উপজেলার পূর্বছাতনাই, টেপাখড়িবাড়ী, খগাখড়িবাড়ী, খালিশা চাপানি, ঝুনাগাছ চাপানি, গয়াবাড়ী ও জলঢাকা উপজেলার গোলমুন্ডা, শৌলমারি ও ডাউয়াবাড়ী ইউনিয়নের প্রায় ১৫টি চরের মানুষজন বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে বলে জানিয়েছেন জনপ্রতিনিধিরা। অপর দিকে ঝুনাগাছ চাপানি ইউনিয়নের ছাতুনামা ও ভেণ্ডাবাড়ি এলাকার ২২টি পরিবার নদী ভাঙনের কবলে পড়ে ভিটেমাটি ও বসতঘর হারিয়েছে। ঝুনাগাছ চাপানি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আমিনুর রহমান জানান, আরো ৪০টি পরিবারের ঘরবাড়ী ভাঙনের মুখে পড়েছে।
উত্তরে বাড়ছে দুর্ভোগ, ভাঙছে স্থাপনা
রংপুর থেকে সরকার মাজহারুল মান্নান জানান, গজলডোবার সব ক’টি গেট খুলে দেয়া এবং পাহাড়ি ঢল ও ভারী বর্ষণে তিস্তার ১৫২ কিলোমিটার এবং ধরলা ও ব্রহ্মপুত্র এলাকার ৩৬০ কিলোমিটার এলাকার চরাঞ্চল ছাড়াও নদী তীরবর্তি নিম্নাঞ্চলের লক্ষাধিক মানুষ এখন পানিবন্দী। চরম কষ্টে কাটছে দুর্গতদের জীবন। হাজার হাজার হেক্টর জমির বাদাম, ভুট্টা, পাট, আমনের চারা, উঠতি বোরো ধান, শাকসবজিসহ বিভিন্ন ফসল পানিতে তলিয়ে গেছে। কয়েক হাজার পুকুর তলিয়ে ভেসে গেছে মাছ। কুড়িগ্রামে পাউবোর টি বাঁধে ধরেছে ভাঙন। গাইবান্ধায় বাঁধের ওপর দিয়ে যাচ্ছে পানি। তিস্তা ব্যারাজ ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছে, রোববার বিকেলে তিস্তার ডালিয়া পয়েন্টে পানি বিপদসীমার ২০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে এবং রংপুরের কাউনিয়ার তিস্তা ব্রিজ পয়েন্টে ১৬ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে ডালিয়া ব্যারাজ কর্তৃপক্ষ ব্যারাজের ৪৪টি জলকপাট খুলে দিয়েছে। অন্য দিকে ব্রহ্মপুত্র নদের ফুলছড়ি পয়েন্টে ৫৫ সেন্টিমিটার, নুনখাওয়া পয়েন্টে ২৪ সেন্টিমিটার, ধরলার কুলাঘাট পয়েন্টে ৪৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের উত্তরাঞ্চলীয় প্রধান নির্বাহী প্রকৌশলী জ্যোতি প্রসাদ ঘোষ নয়া দিগন্তকে জানান, পানিবৃদ্ধির কারণে রংপুর অঞ্চলের তিস্তা, ধরলা ও ব্রহ্মপুত্র, যমুনেশ্বরী, টাঙ্গন, পুনর্ভবা, ইছামতি, কুশিয়ারা নদীর চরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চলের গ্রামগুলো প্লাবিত হয়ে গেছে। দেখা দিয়েছে ভাঙন।
বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্য মতে, তিস্তার পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় বন্যায় নীলফামারীর ডোমার, ডালিয়া, জলঢাকা, রংপুরের গঙ্গাচড়া, কাউনিয়া, পীরগাছা, লালমনিরহাটের সদর, আদিতমারী, পাটগ্রাম, হাতিবান্ধা, কালিগঞ্জ, কুড়িগ্রামের রাজারহাট, উলিপুর, চিলমারী, নাগেশ্বরী, ফুলবাড়ি, ভুরুঙ্গামারী, গাইবান্ধার সদর, সুন্দরগঞ্জ, ফুলছড়ি ও সাঘাটা উপজেলার চরাঞ্চলে পানি ঢুকেছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য মতে, এ রকম পরিস্থিতিতে এই ৪ জেলার চরাঞ্চলের ২১০টি গ্রামে বন্যার পানি ঢোকে ও প্রায় ২ লাখ মানুষ প্লাবিত হয়।
এ ছাড়াও পানি বাড়ায় লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার দহগ্রাম, হাতীবান্ধার সানিয়াজান, গড্ডিমারী, সিন্দুর্না, পাটিকাপাড়া, সিংগিমারী, কালীগঞ্জ উপজেলার ভোটমারী, কাকিনা, আদিতমারী উপজেলার মহিষখোঁচা, পলাশী, সদর উপজেলার খুনিয়াগাছ, রাজপুর, গোকুন্ডা, ইউনিয়নের তিস্তা নদীর তীরবর্তী নিম্নাঞ্চলের প্রায় ১০ হাজার পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। গৃহপালিত পশুপাখি নিয়ে বিপাকে পড়েছেন বন্যাকবলিত এলাকার কৃষকরা।
অন্য দিকে ফুলছড়ি-গাইবান্ধা আঞ্চলিক মহাসড়কের ওপর এখন হাঁটুপানি। সৈয়দপুর ঘাট এলাকায় গত বছর পানির তোড়ে ভেঙে যাওয়া অংশ দিয়ে পানি প্রবেশ করে বালাসীঘাটের ওয়াপদা বাঁধের পূর্ব এলাকায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ পাঁচ গ্রামের অন্তত দুই হাজার পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। অন্য দিকে ফুলছড়ি উপজেলার গজারিয়া, খাটিয়ামারী ইউনিয়নের বেশির ভাগ এলাকা ও বালাসী ঘাট এলাকার ১৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।
প্লাবনের সাথে নদীভাঙনের মুখে পড়েছে উলিপুর উপজেলার হাতিয়া, থেতরাই, বুড়াবুড়ি ও বেগমগঞ্জ, রৌমারীর কর্ত্তিমারী, চিলমারীর নয়ারহাট, কুড়িগ্রাম সদরের মোগলবাসা ও সারডোব এলাকা। গত এক সপ্তাহের ভাঙনে বিভিন্ন উপজেলা মিলিয়ে প্রায় ৩ শতাধিক বাড়িঘর নদীতে গেছে। রংপুর বিভাগীয় কমিশনার কে এম তারিকুল ইসলাম বলেছেন, পানিবৃদ্ধি ও ভাঙন অধ্যুষিত এলাকার ডিসি, উপজেলা নির্বাহী অফিসার এবং মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেয়া আছে।