কুয়েতের প্রভাবশালী পত্রিকা আল-কাবাসের খবরে বলা হয়েছে, লক্ষ্মীপুর-২ আসনের এমপি কাজী শহিদ ইসলাম পাপুলকাণ্ডে জড়িত বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের আরো একজন এমপি। ওই এমপির স্ত্রীও সংরক্ষিত নারী আসনের এমপি। কাবাসের মতে, কুয়েতে তিন সদস্যের একটি চক্র (র্যাকেট) গড়ে উঠেছে। এর অন্য সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন দ্বিতীয় ওই এমপি। কিন্তু তিনি কে সে তথ্য প্রকাশ করা হয়নি। ফলে কে এই এমপি তা নিয়ে চলছে আলোচনা। একই সঙ্গে আল-কাবাসের রিপোর্ট অনুযায়ী, পাপুলকাণ্ডে ফেঁসে গেছেন কুয়েত পার্লামেন্টের দু’জন এমপি। তাদের বিরুদ্ধে অর্থ এবং মানবপাচারে এমপি শহিদকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়ার তদন্ত হচ্ছে।
অর্থ পাচারের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছেন তারাও। প্রসিকিউশনের তদন্তে এসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে। তবে কুয়েতের অভিযুক্ত ওই দুই এমপি’র নামও প্রকাশ করা হয়নি। আল-কাবাস পত্রিকাকে উদ্ধৃত করে এ খবর দিয়েছে অনলাইন গালফ নিউজ। উল্লেখ্য, মানব ও অর্থপাচারের অভিযোগে অভিযুক্ত লক্ষ্মীপুর-২ আসনের এমপি পাপুল। আল-কাবাস জানিয়েছে, কুয়েতি পার্লামেন্টের অভিযুক্ত ওই দুই এমপি, যারা পাপুলকে এসব অন্যায়ে সহযোগিতা করেছেন, তাদেরকে দেয়া পার্লামেন্টারি দায়মুক্তির সুবিধা প্রত্যাহার করার আহ্বান জানিয়েছেন কুয়েতের পাবলিক প্রসিকিউটর, যাতে তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করা যায়।
কুয়েতের সামাজিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মরিয়াম আল আকিল বলেছেন, মানবপাচারের সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছেন পাবলিক ম্যানপাওয়ার অথরিটির সিনিয়র একজন কর্মকর্তা। তার বিরুদ্ধে তদন্ত করেছে পাবলিক প্রসিকিউশন। প্রসিকিউশনের অনুরোধের ভিত্তিতে ওই কর্মকর্তাকে তিন মাসের জন্য সাময়িক বরখাস্তের নির্দেশ দিয়েছেন মরিয়াম আল আকিল।
আল-কাবাসকে সূত্র বলেছেন, তদন্তে দেখা গেছে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের একজন সদস্যের জড়িত থাকার এই ঘটনায় যুক্ত কুয়েত পার্লামেন্টের দু’জন এমপি। এমপি পাপুল ও অন্য এক অভিযুক্তকে মানব ও অর্থপাচারের অভিযোগে জেল দেয়ার আবেদন জানিয়েছেন কুয়েতের পাবলিক প্রসিকিউশন। কুয়েতভিত্তিক আল রাই পত্রিকার একজন সিনিয়র সাংবাদিক মিডিয়াকে বলেছেন, তিনি (এমপি শহিদ) স্বীকার করেছেন, অবৈধ উপায়ে বাংলাদেশ থেকে কুয়েতে মানুষ নেয়ার বিনিময়ে একটি কোম্পানির ম্যানেজারকে নগদ ১০ লাখ কুয়েতি দিনার বা প্রায় ৩০ লাখ ডলার দিয়েছেন। ওই কোম্পানিটির সঙ্গে রয়েছে সরকারি কন্ট্রাক্ট। মানবসম্পদ বিষয়ক কর্তৃপক্ষের একজন পরিচালককে কাস্টডিতে নেয়ার নির্দেশ দিয়েছে প্রসিকিউটর। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তার বিচার মুলতবি রাখার মেয়াদ বাড়ানোর নির্দেশ দিয়েছে। এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার দায়ে একজন নারী ব্যবসায়ীকেও আটক করা হয়। পরে তাকে দুই হাজার দিনারের বিনিময়ে জামিন দেয়া হয়েছে বলে খবর দিয়েছে আল রাই পত্রিকা।
এমপি শহিদ পরিচিত কাজী পাপুল নামে। তার এ ঘটনায় কুয়েতে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। কারণ, এ ঘটনায় প্রকাশ পেয়েছে, কুয়েতের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তারাও ঘুষ বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত। আল রাই পত্রিকা বলছে, কুয়েতি কর্তৃপক্ষের জিজ্ঞাসাবাদে ৯ দিন পরে পাপুল অপরাধ স্বীকার করেছেন। কুয়েতের ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট গত ৬ই জুন গ্রেপ্তার করে এমপি পাপুলকে। এ সময় তিনি নিজেকে নির্দোষ দাবি করেছিলেন।
আল রাই পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী, একজন নিরাপত্তা বিষয়ক কর্মকর্তাসহ উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের বিপুল অঙ্কের অর্থ দেয়ার কথা জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছেন পাপুল। জিজ্ঞাসাবাদকারীদের কাছে তিনি বলেছেন, কুয়েতের বর্তমান ও সাবেক কিছু এমপি তার এই অপকর্ম চক্রের সঙ্গে যুক্ত। রেসিডেন্সি বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত কুয়েত সরকারের ভেতরকার সুনির্দিষ্ট একটি অংশ। এর মাধ্যমে অর্থের বিনিময়ে বাংলাদেশি শ্রমিকদের কুয়েতে যাওয়ার পথ তৈরি হয়ে যায় বলে প্রকাশিত রিপোর্টে বলেছে আল রাই।
রোববার প্রসিকিউটরদের পাপুল বলেছেন, কুয়েত সরকারের সুনির্দিষ্ট একটি অংশের কর্মকর্তাকে ঘুষ দিয়েছেন তিনি। তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে দেশের একজন সিনিয়র নিরাপত্তা কর্মকর্তার নাম বলেছেন পাপুল। তাই এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত যে কাউকে বিস্তৃত জিজ্ঞাসাবাদ ও তাদের বিচারের দাবি জানিয়েছেন কুয়েতের আইনপ্রণেতারা। দেশটির দুর্নীতি বিরোধী কর্তৃপক্ষ এক বিবৃতিতে বলেছে, তারা এই পুরো অবৈধ কর্মকাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটনের জন্য তদন্ত শুরু করেছে। বাংলাদেশি ১১ জন ভুক্তভোগীর সাক্ষাৎকার নেয়ার পর পাপুলের আটকাদেশ অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে পাবলিক প্রসিকিউশন।
কুয়েতের উপ-প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিপরিষদ বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আনাস আল সালেহ শনিবার টুইট করেছেন। তাতে তিনি বলেছেন, কুয়েতের নিরাপত্তা এখন রেড লাইনে। নিরাপত্তা রক্ষা করা হলো দেশের আলটিমেট লক্ষ্য। আমাদের আমীর, ক্রাউন প্রিন্স, প্রধানমন্ত্রী এবং কুয়েতি জনগণের কাছে এটাই আমাদের প্রতিশ্রুতি।
একই দিন একটি বিবৃতি দিয়েছেন আল সালেহ। এতে তিনি বলেছেন, এটাই মানবপাচার ও আবাসিক খাতে এশিয়ান অভিবাসীদের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ঘটনা। উল্লেখ্য, পাপুল এবং কুয়েতি একজন নাগরিক একটি বড় রিক্রুটমেন্ট কোম্পানির মালিক। এই কোম্পানির নাম মারাফি কুয়েতিয়া। প্রতিজন বিদেশি শ্রমিক নেয়ার ক্ষেত্রে তিনি কমপক্ষে ৩ হাজার দিনার পর্যন্ত নেন বলে অভিযোগ আছে। এসব শ্রমিকের বেশির ভাগই বাংলাদেশি। প্রতি বছর এসব শ্রমিক তাদের আবাসিক অনুমোদন নবায়নের জন্য আরো বিপুল অঙ্কের অর্থ দেন এই কোম্পানিকে।