স্বাস্থ্যখাতের বেহাল চিত্র অনেক পুরনো। করোনাভাইরাসে এই চিত্রটা আরো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এই ভাইরাস ঠেকাতে এবং আক্রান্তদের চিকিৎসায় হিমশিম খাচ্ছে পুরো পৃথিবী। দেশের বেহাল স্বাস্থ্য বিভাগ পরিস্থিতি মোকাবিলায় শুরু থেকেই নানা আলোচনার জন্ম দিয়ে আসছে। শুরুতে সীমিত পরিসরে পরীক্ষার কারণে অনেকের রোগ নির্ণয়ই করা যায়নি। ধীরে ধীরে ল্যাবের সংখ্যা বাড়লেও এখন দেখা দিয়েছে কিট সংকট। আগে থেকেই বিশেষজ্ঞরা বলে আসছেন বেশি বেশি ল্যাব স্থাপন করে বেশি মানুষকে পরীক্ষার আওতায় আনতে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও একই পরামর্শ দিয়ে আসছে।
এ অবস্থায় কিট সংকট পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলতে পারে। শুরু থেকেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলে আসছে দেশে পর্যাপ্ত কিট রয়েছে। কিন্তু সম্প্রতি কিছুদিন ধরে অধিদপ্তরের নিয়মিত বুলেটিনে কিটের মজুত তথ্য প্রকাশ করা হচ্ছে না। এ নিয়ে অধিদপ্তর থেকে কোনো ব্যাখ্যাও পাওয়া যায়নি। এমন অবস্থার মধ্যেই সরকার দলীয় সংসদ সদস্য ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির সদস্য একরামুজ্জামান চৌধুরী ভয়াবহ তথ্য প্রকাশ করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, কিট সংকটের পেছনে একটি সিন্ডিকেট দায়ী। কিছু ব্যবসায়ীর হাতে কিট থাকলেও এ সিন্ডিকেট তা বাজারে আনতে দিচ্ছে না। এই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর প্রতি তিনি আহ্বান জানিয়েছেন। এই সংসদ সদস্য একজন ঠিকাদারের নাম প্রকাশ করেছেন। তিনি মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠু। গত কয়েক বছর ধরেই মিঠু সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি পুরো স্বাস্থ্য খাত। এনিয়ে নানা আলোচনা হয়েছে। সংবাদ মাধ্যমে তথ্য এসেছে। কিন্তু মিঠু সিন্ডিকেট ভাঙার কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। আলোচনা রয়েছে বিদেশে থেকেই মিঠু তার সাম্রাজ্য পরিচালনা করছেন। স্বাস্থ্যের সব ধরনের ঠিকাদারি তার নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হয়। করোনাকালেও সক্রিয় এই সিন্ডিকেট। সূত্রের দাবি কয়েকজন ব্যবসায়ী করোনার কিট আমদানি করে তা সরবরাহের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু মিঠু সিন্ডিকেটের কাছে তা করতে পারছেন না। কিট সংকটের বিষয়ে গত দুইদিনে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে দফায় দফায় যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তারা কেউই এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে রাজি হননি। গত দুইদিনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকেও কিটের মজুতের বিষয়ে কোনো তথ্য জানানো হয়নি।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, দেশে করোনা পরীক্ষার কিট সংকট চরম আকারে দেখা দিয়েছে। কিটের অভাবে বিভিন্ন জায়গায় ল্যাব তিন-চারদিন বন্ধ থাকারও খবর আসছে। টেস্টিং কিটের ঘাটতি দেখা দেয়ায় করোনাভাইরাস পরীক্ষা হচ্ছে ধীরগতিতে। নমুনা সংগ্রহ এবং পরীক্ষার সঙ্গে জড়িতদের অনেকে জানিয়েছেন, এখন নমুনা সংগ্রহ কমিয়ে দেয়া হয়েছে। একেবারে প্রয়োজন ছাড়া পরীক্ষা করা হচ্ছে না।
দেশে সংক্রমণের উচ্চহারের মুখে ৩০ হাজার নমুনা পরীক্ষার টার্গেটের কথা বলা হলেও এখন ১৬ বা ১৭ হাজারের মধ্যে তা সীমাবদ্ধ থাকছে। প্রতিদিন আরো বেশি বেশি নমুনা পরীক্ষার পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। চীনা বিশেষজ্ঞ দলও বাংলাদেশ সফরকালে করোনার পরীক্ষা বাড়ানো উপর খুব জোর দিয়ে গেছে। অন্যদিকে প্রতিদিন ন্যূনতম ২০ হাজার নমুনা পরীক্ষার পরামর্শ দিয়েছে কোভিড-১৯ মোকাবিলায় গঠিত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটিও। তবে গত কয়েকদিন ধরেই দেখা যাচ্ছে, নমুনা পরীক্ষার পরিমাণ উল্টো কমছে। এর মধ্যে দেশের একাধিক করোনা ল্যাব জানিয়েছে, কিট না থাকায় পরীক্ষা করতে পারছে না তারা। ৬৬টি টেস্টিং সেন্টারের সক্ষমতার ওপর ভিত্তি করে চাহিদা আছে ২০ হাজার কিটের। তবে এর চেয়ে আরো চার-পাঁচগুণ বেশি মানুষ টেস্ট করাতে চান। কিন্তু পারছেন না। এজন্য তারা বুথের সামনে দীর্ঘ লাইনে ঘণ্টার পর ঘণ্টার অপেক্ষা করার অভিযোগ করছেন। পড়েছেন চরম ভোগান্তিতেও। জুনের শুরুর দিকে বেশি সংখ্যক নমুনা পরীক্ষা করায় করোনা শনাক্তও বেড়ে যায়। এর পরই কিট সংকট দেখা দেয়। এ কারণে পরীক্ষার পরিমাণও কমে যায়। এতে সংক্রমণের প্রকৃত চিত্র জানা যাচ্ছে না বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
এদিকে, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক সরকারে সঙ্গে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় ৫৪টি বুথ বসিয়ে করোনার নমুনা সংগ্রহের কাজ করছে। এই বুথ পরিচালনার দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে বলেন, ল্যাবের পাশাপাশি কিটের সংকটের কারণে এখন নমুনা সংগ্রহ কমানো হয়েছে। আমাদের প্রতিটি বুথ থেকে প্রতিদিন ৩০টি করে নমুনা সংগ্রহ করা হতো। এটা স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকেই বেঁধে দেয়া একটা সংখ্যা। কারণ হচ্ছে, একটা নির্দিষ্ট সংখ্যক নমুনা আমাদের ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করার ক্ষমতা আছে। এখন যেটা হয়েছে, এই সপ্তাহে আমাদের বলা হয়েছে, আমরা যেন নমুনা সংগ্রহ একটু কম করি। কারণ কিটের একটু স্বল্পতা আছে। তিনি আরো বলেন, সেজন্য এই সপ্তাহে আমরা অর্ধেক করে নমুনা সংগ্রহ করছি। অর্থাৎ ৩০টার জায়গায় আমরা ১৫টা করে নমুনা সংগ্রহ করছি।
অন্যদিকে, স্বাস্থ্য খাতের লাগামহীন দুর্নীতি ও জালিয়াতির নেপথ্যে রয়েছে সিন্ডিকেট। অত্যন্ত প্রভাবশালী এই সিন্ডিকেটের হাতেই জিম্মি হয়ে আছে পুরো স্বাস্থ্য খাত। আর এই সিন্ডিকেটের নেপথ্য নায়ক এই খাতের মাফিয়া ডন হিসেবে পরিচিত মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠু। দীর্ঘদিন পর্দার আড়ালে থেকে নাড়ছেন নিজের গড়া সিন্ডিকেটের কলকাঠি। এমনকি বর্তমান পরিস্থিতিতে বিদেশে পালিয়ে থেকেও সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনীয় সবকিছুই চালিয়ে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
সম্প্রতি মিঠু সিন্ডিকেটের বিষয়ে মুখ খুলেছেন নোয়াখালী-৪ আসনের সংসদ সদস্য এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য মোহাম্মদ একরামুল করিম চৌধুরী। এক ভিডিও বার্তায় সরকারের কাছে ‘মিঠু সিন্ডিকেট’ ভেঙে দেয়ার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, আমার জানা মতে, বাংলাদেশের তিন-চারটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান প্রায় ১০ লাখ কিট এনে রেখেছে। কিন্তু তারা তা দিতে পারছে না মিঠু সিন্ডিকেটের কারণে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ‘মিঠু সিন্ডিকেট’ যতক্ষণ পর্যন্ত ভাঙা না যাবে, ততক্ষণ এই মন্ত্রণালয় কখনো ভালো থাকবে না। সিন্ডিকেটের কারণে দেশে করোনা পরীক্ষার কিট সংকট সৃষ্টি হয়েছে।
প্রথমে করোনাভাইরাসের পরীক্ষা শুরু করা হয়েছিল ঢাকায় আইইডিসিআর-এর ল্যাবরেটরি থেকে। এখন তা ৬৬টিতে পরীক্ষা করা হয়। এর মধ্যে ৩৫টি ল্যাবরেটরিই ঢাকায় এবং বাকিগুলো বিভিন্ন বড় শহরে। করোনাভাইরাস নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে আগে দেশে মজুত থাকা কিটের তথ্য তুলে ধরা হতো। অনেকদিন ধরেই কিট সম্পর্কে তথ্য দেয়া বন্ধ রাখা হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশে করোনাভাইরাসের নমুনা পরীক্ষার জন্য ল্যাবের সংখ্যা বাড়ালেও এখন পর্যন্ত সব ল্যাবে পর্যাপ্ত কিটের সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারেনি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি দেখা দিলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কিট দিয়ে দেশে শুরু হয় করোনা পরীক্ষা। সংস্থাটি বিভিন্ন সময় বেশকিছু কিট উপহার দিয়েছে বাংলাদেশকে। কিট উপহার পাওয়া গেছে চীনসহ বিভিন্ন দেশ থেকেও। জুনের শুরুতে কিট সংকট চরমে ওঠে। সারা দেশে যেভাবে করোনা পরীক্ষা চলছে, তা বিশেষজ্ঞদের পরামর্শমতো না বাড়লেও এই কিট প্রয়োজনের তুলনায় নগণ্য। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারাও কিট সংকটের কথা স্বীকার করেছেন।