আজাদের বিস্ফোরক মন্তব্যে আতঙ্ক সারা দেশে

Slider জাতীয় ফুলজান বিবির বাংলা


নিজেও করোনায় আক্রান্ত ছিলেন। হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে কাজে ফিরেছেন বেশি দিন হয়নি। গতকাল অনেকটা আকস্মিকভাবেই হাজির হন দুপুরের নিয়মিত ব্রিফিং এ। সেখানে তার বলা একটি উক্তিতে রীতিমতো হতাশা, ক্ষোভ ও আতঙ্ক তৈরি হয় মানুষের মধ্যে। বলছি, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদের কথা। গতকাল তিনি বলেন, করোনা পরিস্থিতি এক বা দুই তিন মাসে শেষ হচ্ছে না।আগামী দুই থেকে তিন বছর বা তারও বেশি সময় করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ থাকবে। তবে সংক্রমণ উচ্চ হারে নাও থাকতে পারে।

তার এই বক্তব্য ব্যাপক প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে। সবাই একবাক্যে বলছেন, হতাশা ও আতঙ্ক ফেরি করা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাজ নয়।
পদক্ষেপ না নিলে করোনা কখনওই যাবে না। সারা বিশ্বই করোনার বিরুদ্ধে লড়ছে। অনেক দেশ পরিস্থিতি এরই মধ্যে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছে। কিছু কিছু দেশে আবার দ্বিতীয় পর্যায়ে সংক্রমণ হতে পারে এমন শঙ্কা তৈরি হয়েছে। কিন্তু হাত গুটিয়ে বসে নেই কেউ। চেষ্টা করছেন করোনা নিয়ন্ত্রণের। কেউ সফল হয়েছেন, কেউ ব্যর্থতার জন্য সমালোচিত হচ্ছেন। ভিয়েতনাম, নেপাল, শ্রীলঙ্কার মতো বহুদেশ সারা পৃথিবীর সামনে উদাহরণ তৈরি করেছে। টিকা উৎপাদনের সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন বিজ্ঞানীরা।

এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নেয়া পদক্ষেপ নিয়ে শুরু থেকেই সমালোচনা ছিল। আবুল কালাম আজাদ আইনত করোনা বিরোধী লড়াইয়ের প্রধান মুখ। অথচ শুরু থেকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক দেখানোর চেষ্টা করে গেছেন তিনি, অধিদপ্তর এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। টিভি খুললেই একটা কথা শোনা যেতো। আমরা প্রস্তুত, আমরা ইউরোপ আমেরিকা থেকে ভালো আছি। অথচ চিকিৎসকরা শুরুতে সুরক্ষা সামগ্রী পেলেন না। যা পেলেন তারও মান নিয়ে প্রশ্ন রয়ে গেছে। আর এখনতো আমরা দেখছিই কীভাবে চিকিৎসা না পেয়ে অ্যাম্বুলেন্সে, রাস্তায় মানুষ মারা যাচ্ছেন।
আবুল কালাম আজাদ কিসের ভিত্তিতে তার এই নতুন তত্ত্ব হাজির করলেন তা নিয়েও প্রশ্ন ওঠেছে। বাংলাদেশে কোনো বিশেষজ্ঞ এখন পর্যন্ত এ ধরনের কথা বলেননি। পরামর্শ দেয়ার জন্য যে সরকারি কমিটি আছে তারাও কিছু বলেননি। বিশ্ব স্বাস্হ্য সংস্থাও এ ধরনের কোন কথা বলেনি। খ্যাতিমান কোনো বিজ্ঞানী এ ধরনের কথা বলেছেন বলে জানা যায় না। তাহলে আবুল কালাম আজাদ কখন এ গবেষণা করলেন। তার মন্তব্য সরকারের জন্যও বিব্রতকর। তার চুক্তির মেয়াদ কি নবায়ন হচ্ছে এ নিয়েও চলছে নানা আলোচনা।

জনস্বাস্থ্যবিদ অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ গণমাধ্যমকে বলেন, কিসের ওপর ভিত্তি করে এমন মন্তব্য বুঝতে পারছি না। আপনি যদি সংক্রমণ প্রতিরোধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা না নেন, তাহলে করোনা আজীবন থাকবে। এ রকম কথার অর্থ হচ্ছে, হাল ছেড়ে দেয়া।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ আব্দুন নূর তুষার এ প্রসঙ্গে ফেসবুকে লিখেছেন, মন্তব্য করার ভাষা নেই। নেপাল পারলো কেমন করে? শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড? কোরিয়া? তাইওয়ান? দায়িত্ববান ব্যক্তির নিচের সংবাদ ও ছবিতে লেখা এইসব মন্তব্যই প্রমাণ করে তার কোভিড বিষয়ে ভালো করে জানা ছিল না, কোনো প্রস্তুতিও ছিল না। এ প্রসঙ্গে আবুল কালাম আজাদের আগের দেয়া একটি বক্তব্যও আলোচনায় এসেছে। একসময় তিনি বলেছিলেন, সর্বশেষ বৈজ্ঞানিক তথ্যের ওপর ভিত্তি করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর মনে করে গরম আবহাওয়া ও আদ্রতার কারণে বাংলাদেশে কোভিড-১৯ রোগের প্রচণ্ডতা দেখা দিবে না।

শুরু থেকেই গোজামিল আর সমন্বয়হীনতাই হচ্ছে বাংলাদেশের করোনা বিরোধী লড়াইয়ের বড় বৈশিষ্ট্য। আবুল কালাম আজাদ এবার তা আরো স্পষ্ট করলেন। গত কয়েকদিনে লকডাউন, লকডাউন করে কী ই না হয়ে যাচ্ছে।অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে এখানে মানুষের জীবন মূল্যহীন। হাত গুটিয়ে বসে থেকে, কী হয় দেখি এমন নীতিতে আর যাই হোক করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসবে না। প্রতিটি জীবনই মূল্যবান। প্লিজ, মানুষের জীবন বাঁচাতে কিছু একটা করুন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নথিতে বাংলাদেশের কভিড-১৯ তথ্যের অপ্রতুলতা
প্রতি সপ্তাহে এক বার বাংলাদেশ সরকার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কাছে কভিড-১৯ সম্পর্কিত কিছু তথ্য-উপাত্ত পাঠায়। যেমন, কতটি টেস্ট করা হলো, কয়জন রোগী শনাক্ত হয়েছে বা মৃত্যুবরণ করেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) সেসব উপাত্ত বিশ্লেষণ করে বাংলাদেশে কভিড-১৯ মহামারি বিষয়ক সাপ্তাহিক সিচুয়েশন রিপোর্ট তৈরি করে। সেই প্রতিবেদন সংস্থাটির ওয়েবসাইটে দেওয়া হয়ে থাকে। এখন পর্যন্ত ডব্লিউএইচও এই ধরণের ১৬টি প্রতিবেদন তৈরি করেছে।
তবে সর্বশেষ ২ সিচুয়েশন রিপোর্টে দেখা যায় যে, বাংলাদেশ সরকারের দেওয়া তথ্যে ঘাটতি রয়েছে অনেক। কভিড-১৯ আক্রান্তদের বয়স, লিঙ্গ, ভৌগোলিক অবস্থান ও মৃত্যু সম্পর্কিত পর্যাপ্ত তথ্য দেওয়া হয় না। মনে হতে পারে যে, সরকার কভিড-১৯ আক্রান্ত ও মৃত্যুবরণকারী সকলের বয়স ও লিঙ্গ জানে। কিন্তু ডব্লিউএইচও’র সাম্প্রতিক সিচুয়েশন রিপোর্ট দেখলে বোঝা যায়, বিষয়টি তা নয়।
১৫ জুন প্রকাশিত সর্বশেষ রিপোর্টে, ডব্লিউএইচও লিখেছে, ‘শনাক্ত হওয়া রোগীদের মাত্র ২৪ শতাংশের বয়স ও লিঙ্গ সংক্রান্ত উপাত্ত বর্তমানে উপলভ্য আছে।’ এতে আরও বলা হয়, তথ্যের এই অপ্রতুলতার মানে হলো ৯০ হাজার ৬১৯ জন রোগীর মধ্যে মাত্র ২১ হাজার ৪২৩ জন রোগীর বয়স ও লিঙ্গ কী, তা সরকার জানে।

তাই ডব্লিউএইচও’র রিপোর্টে যখন বলা হয়, আক্রান্তদের মধ্যে ২৬.৫ শতাংশ হলো ৩১-৪০ বছর বয়সী, ২৬ শতাংশ হলো ২১-৩০ বছর বয়সী, ১৮ শতাংশ হলো ৪১-৫০ বছর বয়সী, ১২ শতাংশ হলো ৫১-৬০ বছর বয়সী, তখন তাতে ভরসা রাখার জায়গা কম। কারণ, এতে ৭৬ শতাংশ রোগীর তথ্যই বাদ পড়ে গেছে।

কভিড-১৯ রোগে আক্রান্ত হয়ে যারা মারা গেছেন তাদের বয়স ও লিঙ্গ সম্পর্কে আরেকটু কিছু তথ্য আছে। কিন্তু তা-ও আংশিক। ডব্লিউএইচও বলেছে, ‘কভিড-১৯ সংক্রান্ত মৃত্যুর ৫৮.৯ শতাংশের ক্ষেত্রে উপাত্ত রয়েছে।’ অর্থাৎ, ১২০৯ জন মৃত্যুবরণকারী রোগীর মধ্যে ৭১২ জনের তথ্য আছে।
তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যেই তথ্যের ঘাটটি রয়েছে তা হলো কভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের ভৌগোলিক অবস্থান। এই তথ্য সরকারের জানা থাকা অত্যন্ত জরুরী। সরকারি নীতি নির্ধারনে এই তথ্যের অনেক প্রভাব থাকবে। কিন্তু ১৫ জুনের রিপোর্টে ডব্লিউএইচও বলেছে, মাত্র ৫৭ শতাংশ রোগীর ভৌগোলিক অবস্থান সংক্রান্ত তথ্য রয়েছে। তাই যখন ডব্লিউএইচও লিখেছে যে, ৬৭ শতাংশ রোগী ঢাকা বিভাগে, ১৮ শতাংশ চট্টগ্রাম বিভাগে, ৩ শতাংশ ময়মনসিংহ, ২.৯ শতাংশ খুলনা, ২.৮ শতাংশ সিলেট, ২.৬ শতাংশ রংপুর, ২.২ শতাংশ রাজশাহি ও ১.৩ শতাংশ বরিশাল বিভাগে, তখন মনে রাখতে হবে যে, এখানে ৪৩ শতাংশ রোগীর হিসাব নেই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *