সিলেট: সিলেট বিভাগে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা দুই হাজার অতিক্রম করলো। বৃহস্পতিবার নতুন করে আরো ৭০ জন আক্রান্ত হয়েছে। এ নিয়ে বিভাগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ২০৩৪ জন। এর মধ্যে শুধু সিলেট জেলাতেই আক্রান্ত ১২১০ জন।
সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজের উপ-পরিচালক ডা. হিমাংশু লাল রায় জানিয়েছেন- বৃহস্পতিবার সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজের পিসিআর ল্যাবে ১৮৫ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়। এর মধ্যে ৪৭ জন নতুন রোগী শনাক্ত হন। আক্রান্ত সবাই সিলেট জেলার বাসিন্দা। এর মধ্যে চিকিৎসক, আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্য ও স্বাস্থ্যকর্মী রয়েছেন।
এদিকে- শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবে ১৮৮ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়। এতে নতুন ২৩ জন করোনা শনাক্ত হয়েছে। শনাক্ত হওয়া রোগীরা সুনামগঞ্জ জেলার বাসিন্দা। এ নিয়ে সুনামগঞ্জে করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৪১৯ জন। এছাড়া- হবিগঞ্জে ২২৭ ও মৌলভীবাজারে ১৭৮ জন রোগী রয়েছেন।
সিলেট বিভাগে এ পর্যন্ত সুস্থ হয়েছেন ৪৩৩ জন ও মারা গেছেন ৪১ জন। হাসপাতালে ভর্তি আছেন ৩৮০ জন।
গণমাধ্যমের খবরে বলা হচ্ছে, ‘ডেঞ্জার জোন’ সিলেট। এতদিন ঘরে বসে দেশে দেশে মৃত্যুর খবর শুনছিলেন সিলেটবাসী। ইউরোপ, আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্যে বসবাসকারী স্বজনের খবরে শোকের সাগরে ভাসছিলেন সিলেটের স্বজনরা। এবার মহামারি করোনা আঘাত হেনেছে সিলেটে। দিনে দিনে করোনার ‘ডেঞ্জার জোনে’ পরিণত হয়েছে সিলেট। চারিদিকে উদ্বেগ আর আতঙ্ক। স্বস্তিতে নেই গোটা বিভাগের মানুষ। প্রতিদিনই বাড়ছে করোনা রোগী। মৃত্যুর বহরে যুক্ত হচ্ছে প্রিয়জনের নাম।
এরপরও সতর্ক হচ্ছে না সিলেটের মানুষ। নগরে হাটা-চলাই দায় হয়ে পড়েছে। যানজটের কারণে গাড়ির চাকা ঘুরছে না। দোকানপাট সব খোলা। মানুষে মানুষে গিজগিজ করছে পুরো শহর।
এই অবস্থায় নীতি নির্ধারক মহলেও দুশ্চিন্তা বাড়ছে। কোনো প্রস্তুতি ছিলো না। এখনো নেই। এ কারণে নতুন করে ফের চিকিৎসার প্রস্তুতি নিতে হচ্ছে। করোনার জন্য নির্দিষ্ট একমাত্র শহীদ শামসুদ্দিন হাসপাতাল রোগীতে ভর্তি। ঠাঁই হচ্ছে না হাসপাতালে। বৃহস্পতিবার এক দিনেই সিলেটে রোগী বেড়েছে ২৬৬ জন। এর মধ্যে সিলেট জেলাতেই ১৩৬ জন। বিভাগে রোগীর সংখ্যা দুই হাজার ছুঁইছুঁই। রাতের মধ্যে সেই হিসাব দুই হাজার অতিক্রম করে ফেলছে। সিলেট জেলায় আক্রান্তের সংখ্যা এক হাজার পাড়ি দিয়েছে বুধবার রাতেই। বৃহস্পতিবার বিকাল পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা ছিলো ১১৬৩ জন। ভয়ঙ্করভাবে বেড়ে চলে করোনা। তথ্যও তাই বলছে। ৫৬ দিনে সিলেটে করোনা রোগীর সংখ্যা বেড়েছিলো ৫০০ জন। আর গত ১০ দিনে বেড়েছে প্রায় সাড়ে ৬শ’জন। স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন- আগামী ১৫ দিনে এই সংখ্যা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে সেটি এখনই বুঝা যাচ্ছে। নমুনা দেয়ার জায়গা সংকোচিত হয়ে গেছে।
শহীদ শামসুদ্দিন আহমদ হাসপাতালের মাত্র একটি বুথে নমুনা সংগ্রহ করা হয়। চালু থাকা দু’টি ল্যাবের পরীক্ষায়ও সংকুলান হচ্ছে না। নতুন করে লেগেছে নমুনা জট। এ কারণে সিলেট থেকে গত তিন দিন ধরে নমুনা ঢাকায় পাঠানো হচ্ছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য বিভাগের সহকারী পরিচালক আনিসুর রহমান। নমুনার ফলাফল পেতেও হচ্ছে বিলম্ব। এক সপ্তাহে মিলছে না ফলাফল। অসুস্থ রোগী পরীক্ষার ফলাফলের অপেক্ষায় থেকে থেকে সুস্থ হয়ে উঠছেন। আবার উপসর্গ নিয়ে অনেকেই মারা যাচ্ছেন। করোনা আক্রান্ত ছিলেন কী-না সেটি জানা যাচ্ছে মৃত্যুর পর। সিলেটে আরো চারটি ল্যাব স্থাপনের প্রস্তাব করা হয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে। বিভাগের প্রতিটি জেলায় একটি করে ও সিলেটের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে আরো একটি ল্যাব স্থাপনের আবেদন করা হয়েছে ঢাকার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে। স্বাস্থ্য বিভাগ সিলেটের সর্বশেষ তথ্য মতে- সিলেট বিভাগে গতকাল পর্যন্ত করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ছিলো ১৯৬৪ জন। ২৪ ঘন্টায় রোগী বেড়েছে ২৬৬ জন। আক্রান্তদের মধ্যে রয়েছেন- সিলেট জেলায় ১১৬৩ জন, সুনামগঞ্জে ৩৯৬ জন, হবিগঞ্জে ২২৭ জন, মৌলভীবাজারে ১৭৮জন। এখন পর্যন্ত মারা গেছেন ৪১ জন ও সুস্থ ৪৩৩ জন। ২৪ ঘন্টায় করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ৩ জন। হাসপাতালে ভর্তি আছেন ৩৮০ জন। উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়া রোগীর হিসেব নেই। তবে- সম্প্রতি ঢাকার একটি প্রতিষ্ঠানের গবেষণা রিপোর্টে দেখা গেছে- ১০ দিনে সিলেট বিভাগে উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন ৫৩ জন রোগী। সব মিলিয়ে একশ’র উপরে রোগী মারা গেছেন বলে স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা ধারণা করছেন। করোনার ডেঞ্জার জোন সিলেটে চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে সবচেয়ে বেশি দুশ্চিন্তা। লাফিয়ে লাফিয়ে করোনা রোগী বাড়ার কারণে এখন খোদ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের টনক নড়েছে। তারা চিকিৎসার নতুন কেন্দ্র চালু করতে ইতিমধ্যে প্রস্তাবনা পাঠিয়েছেন ঢাকায়। এরই মধ্যে সিলেটের দক্ষিণ সুরমা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও খাদিমপাড়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সকে করোনা রোগী সেবা দিতে প্রস্তত করা হচ্ছে। এ দু’টি হাসপাতালে শ’খানেক রোগীকে সেবা দেয়া যাবে। প্রবাসীদের একটি গ্রুপ এ দু’টি হাসপাতাল সেন্ট্রাল অক্সিজেন ব্যবস্থা চালু করতে আর্থিক সহযোগিতা দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। তবে- এখনই এ দু’টি হাসপাতালে রোগী ভর্তি করা সম্ভব হবে না। প্রস্তুত করতে সময় লাগবে ১০ দিনের মতো। ফলে আগামী দিনগুলোতে রোগীর জায়গা কোথায় দেয়া হবে সেটি নিয়েও রয়েছে অনিশ্চয়তা। কারণ- সিলেটে যে পরিমান করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছেন তাদের এক তৃতীয়াংশ হাসপাতালমুখি হলে হাসপাতালের বারান্দা এবং রাস্তায়ও রোগী রেখে চিকিৎসা সেবা প্রদান করতে হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। পাশাপাশি অক্সিজেন ও আইসিইউ সংকট চলছে। সিলেটের করোনা পরিস্থিতি অনুধাবন করে জেলা প্রশাসক কাজী এমদাদুল ইসলাম এক হাজার শয্যা বিশিষ্ট একটি আইসোলেশন সেন্টার প্রস্তুত করার প্রস্তাব করেছেন। ইতিমধ্যে এই প্রস্তাবনা ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। নগরীর শাহজালাল উপশহর সংলগ্ন আবুল মাল আবদুল মুহিত ক্রীড়া কমপ্লেক্সে এই আইসোলেশন সেন্টার স্থাপনের প্রস্তাবনা করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য বিভাগের সহকারী পরিচালক আনিসুর রহমান। তিনি জানান- ওই কমপ্লেক্সে ২৫টি বাথরুম রয়েছে। এছাড়া আনুসাঙ্গিক সাপোর্টও রয়েছে। এ কারণে এই কমপ্লেক্সে আইসোলেশন কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহারে সিলেটের জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দও একমত রয়েছেন। এদিকে- জ্যামিতিক হারে সিলেটে বাড়ছে রোগী। নতুন হটস্পটে পরিণত হয়েছে। নতুন করে চিকিৎসা সেবা চালু করতে সময় লাগবে। এই সময়ের মধ্যে বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে রোগী রেখে চিকিৎসা সেবা চালুর চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। সিলেটের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী জানিয়েছেন- বেসরকারি চিকিৎসা সেবা চালু হলেও সেটি কতটুকু কাজে আসবে তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। কারণ- কোভিড চিকিৎসায় নিয়োজিত থাকা ফ্রন্টলাইনের যোদ্ধা চিকিৎসক স্বাস্থ্যকর্মীদের নিজেদের রক্ষার সামর্থ নেই। নানা সীমাবদ্ধতা রয়েছে তাদের। এজন্য অনেকেই চিকিৎসা প্রদান থেকে পিছু হটছেন বলে খবর এসেছে। তিনি জানান- সিলেটবাসীর পক্ষ থেকে তিনি নিজেও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে দু’টি প্রস্তাব পাঠিয়েছেন। এই প্রস্তাবের মধ্যে রয়েছে- অবিলম্বে সিলেটে ৫০০ শয্যার একটি বেসরকারি হাসপাতাল সরকারিভাবে রিক্যুজিশন করে চিকিৎসা সেবা চালু করা এবং সিলেটের পুরাতন কারাগারকে আইসোলেশন সেন্টার হিসেবে চালু করা। এসব নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী একাধিক ডিও দিলেও স্বাস্থ্য বিভাগের নির্দেশনা পেতে বিলম্ব হচ্ছে বলে জানান মেয়র।
৩ জনের মৃত্যু: সিলেটের করোনা আইসোলেশন সেন্টার শহীদ শামসুদ্দিন আহমদ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিন রোগীর মৃত্যু হয়েছে। বৃহস্পতিবার তারা মৃত্যুবরণ করেন বলে হাসপাতালের কর্তব্যরত চিকিৎসকরা জানিয়েছেন। এর মধ্যে করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন গোলাপগঞ্জ উপজেলার বাঘা ইউনিয়নের তুরুকভাগ গ্রামের মতিন মিয়া। সিলেট শহরতলীর শাহ্ পরান এলাকার আব্বাস উদ্দিন ও খাদিমনগর এলাকার পারভিন বেগম মারা গেছেন উপসর্গ নিয়ে। তাদের দু’জনেরই নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য ল্যাবে পাঠানো হয়েছে।