ঢাকা: নতুন বন্দিতে ঠাসা দেশের কারাগারগুলো। যেন তিল ধারণের জায়গা নেই। রাজনৈতিক ধরপাকড় আর গণগ্রেপ্তারে কারাগারগুলোতে প্রতিদিনই নিত্যনতুন বন্দি আসছে। কিন্তু বন্দির ভারে উপচে পড়ছে দেশের ৬৮টি কারাগারই। কারাগারগুলোর ধারণ ক্ষমতা যেখানে ২৯ হাজার, সেখানে বন্দি রয়েছে ৮০ হাজারেরও বেশি। মাত্রাতিরিক্ত বেশি বন্দি সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে কারা কর্তৃপক্ষ। দেশের কারাগারগুলোতে বর্তমানে মাত্রাতিরিক্ত বন্দির কারণে নানা ধরনের সমস্যা দেখা দিচ্ছে। তীব্র শীতে কারা অভ্যন্তরে বন্দিদের দুর্দশা প্রতিনিয়তই বাড়ছে। রংপুর ও রাজশাহী বিভাগের কারাগারগুলোতে সবচেয়ে বেশি দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থা। কারাবন্দিরা ঠা-াজনিত নানা রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হলেও যথাযথ চিকিৎসা মিলছে না। ফলে কারা অভ্যন্তরে মানবিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ভুক্তভোগী বন্দিরা জানান, কারাগারে নেয়ার পর প্রথম ২-৩ দিন ঘুমানোর কোন সুযোগ জুটে না। দুবেলা খাবারও পাওয়া যায় না। পরে পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে মিয়াসাবদের দাবিকৃত টাকা পরিশোধ করার পরই কিছুটা শান্তি আসে। আর টাকা না দিতে পারলে কারারক্ষীরা খুবই নির্যাতন করে। এর প্রতিবাদ করলে নির্যাতনের পরিমাণ আর েবেড়ে যায়। কারাগারে বন্দির সংখ্যা বেশির বিষয়টি স্বীকার করতে রাজি নন কারা অধিদপ্তরের এক উপমহাপরিদর্শক। তিনি জানান, অন্য যে কোন সময়ের তুলনায় এখন কারাগারে বন্দির সংখ্যা কম।
বর্তমানে দেশের ৬৮টি কারাগারে ৬৬ হাজারের মতো বন্দি রয়েছে। এসব বন্দি ব্যবস্থাপনায় তেমন কোন সমস্যা হচ্ছে না। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, অপরিকল্পিতভাবে নির্মিত কারাগারে ভিআইপি বন্দিদের জন্য উপযুক্ত সেল নেই। এর ওপর নিরাপত্তার অজুহাতে বন্দিদের এক কারাগার থেকে অন্য কারাগারে ক্রমাগত স্থানান্তর করায় শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন অনেক রাজনৈতিক বন্দি। স্থানাভাবে মহিলা বন্দিরাও নানা বিড়ম্বনা ভোগ করছেন। বস্তুত, বর্তমানে সব কারাগারের পরিবেশই অত্যন্ত নাজুক হয়ে পড়েছে। অতিরিক্ত বন্দির ঠাসাঠাসিতে স্বভাবতই সৃষ্টি হয়েছে মারাত্মক অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। এ অবস্থায় কারাবিধি অনুযায়ী বন্দিরা বিশেষত ভিআইপি বন্দি এবং আদালত থেকে ডিভিশনপ্রাপ্তরা তাদের প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ উঠেছে। কারা অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি ধারণ ক্ষমতা মাত্র ২ হাজার ৬৮২। কিন্তু সেখানে বন্দি রয়েছে পাঁচ হাজার ৩৯২। অর্থাৎ ধারণ ক্ষমতার দ্বিগুণ বন্দি বাস করছে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। বিষয়টি সম্পর্কে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার ফরমান আলী মানবজমিনকে বলেন, ধারণ ক্ষমতার চেয়ে বেশি বন্দি থাকায় কিছু তো সমস্যা হচ্ছেই। সেগুলো ম্যানেজ করেই রাখা হচ্ছে বন্দিদের। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, মাসাধিককাল ধরে সারা দেশে ধরপাকড় ও গ্রেপ্তারের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় কারাগারে বন্দির সংখ্যাও বাড়ছে। তবে এ বন্দির বেশির ভাগই বিরোধী দলের নেতাকর্মী। দেশের কারাগারগুলোর নির্ধারিত সেলগুলোতে এখন বন্দিদের ঠাঁই হচ্ছে না। ফলে বাধ্য হয়েই কারা কর্তৃপক্ষ কারাগারের ভেতরে বিভিন্ন গোডাউন, বড় সেলের বারান্দা, এমনকি যেসব সেলের বাথরুমগুলো বড় সেগুলোকেও সেল বানিয়ে বন্দি রাখার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। আর এসবের মধ্যেই গাদাগাদি করে থাকতে হচ্ছে বন্দিদের। আর ভারসাম্য রক্ষার্থে মাঝেমধ্যে এক কারাগার থেকে আরেক কারাগারে বন্দি অদল-বদল করা হচ্ছে।
কারাগারগুলোতে মাত্রাতিরিক্ত বন্দির কারণে যে কোন কারা অভ্যন্তরে অস্থিরতা সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে। কারা অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, সারা দেশে ছোট-বড় ৬৮টি কারাগার রয়েছে। এর মধ্যে ১৩টি কেন্দ্রীয় কারাগার এবং দুটি হাইসিকিউরিটি সেল। ৫৫টি বিভিন্ন জেলা সদরে ছোট কারাগার রয়েছে। এসব কারাগারে বর্তমানে রাজনৈতিক বন্দির সংখ্যাই বেশি। মৃত্যুদ-প্রাপ্ত কারাবন্দিদের অনুমোদিত ধারণ ক্ষমতা যেখানে ৮৩ জনের, সেখানে বর্তমানে রয়েছে ৯৮৯। এখন প্রতিদিনিই ২০০ থেকে ৩০০ বন্দি কারাগারে প্রবেশ করছে। কোন কোন দিন এর চেয়ে বেশিও হচ্ছে। কিন্তু এভাবেই বন্দিদের জামিন হচ্ছে না। আর নির্বাচনের আগ পর্যন্ত জামিন ছিল না বললেই চলে। গত কয়েক দিনে প্রায় ১২০০ রাজনৈতিক কর্মীকে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে সাজা দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া ২ হাজার সন্ত্রাসীকে আটক করে কারাগারে পাঠানো হয়। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার সূত্রে জানা গেছে, এ মুহূর্তে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি পাওয়া বন্দির সংখ্যা তুলনামূলকভাবে খুবই কম।
এ ছাড়া কারাগারের গেট থেকেই জামিনে মুক্তি পাওয়া বন্দি গ্রেপ্তারের সংখ্যাও ইদানীং বেড়ে গেছে। বিএনপির সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত ৪ বছরে বিএনপির ২০ হাজারেরও বেশি নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে মামলার পরিমাণও শ’ শ’। এ ছাড়া অন্যান্য দলেরও বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছে। জামায়াতে ইসলামীর মতে, গত ৪ বছরে দলের ২১ হাজারেরও বেশি নেতাকর্মী গ্রেপ্তার হয়েছে। দেড় হাজার মামলায় জামায়াতের ২ লাখেরও বেশি নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়। এদিকে দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতাকে কাজে লাগিয়ে লাগামহীন বাণিজ্যে নেমেছেন পুলিশ ও কারাগারের কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারী। জামিন পেলেও রেহাই পাচ্ছেন না বন্দিরা।
পেন্ডিং মামলায় নতুন করে গ্রেপ্তারের ভয় দেখিয়ে জামিন পাওয়া আসামিদের কাছ থেকে তারা মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে। ফলে জামিনে মুক্তি পাওয়া বন্দিরা পেন্ডিং মামলা আতঙ্কে ভুগছেন। কারাগারগুলোর সামনে পুলিশের সিভিল টিমের দুর্নীতিবাজ সদস্যরা কারা কর্মচারীদের সহযোগিতায় জামিনপ্রাপ্ত বন্দিদের আবার আটক করে সাজানো পুরনো ভাঙচুর, আগুন, বিস্ফোরকদ্রব্যসহ নানা অভিযোগে মামলায় ঢুকিয়ে দেয়ার অভিযোগ উঠেছে। সিন্ডিকেটের দাবি অনুযায়ী টাকা দিতে পারলে সে ক্ষেত্রে কোন সমস্যা হচ্ছে না। এক পরিসংখ্যান মতে, গত এক সপ্তাহেই দেশের বিভিন্ন এলাকায় গ্রেপ্তার হয়েছেন কয়েক হাজার, বিএনপি ও জামায়াতের নেতাকর্মী। নিখোঁজ রয়েছেন কয়েক শতাধিক। এ সরকারের শাসনামলে ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারির আগে ও ২০১৫ সালের ৫ই জানুয়ারির পরে সব মিলিয়ে প্রায় ৩০ হাজার বিএনপি-জামায়াতের নেতাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ কারণে কারাগারের ব্যবস্থাপনা সঙ্কটের মুখে পড়েছে। গ্রেপ্তারের হার বেড়ে যাওয়ায় এ সঙ্কট গুরুতর আকার ধারণ করেছে।