ডেস্ক: নাটোরের একটি প্রত্যন্ত অঞ্চলের বাসিন্দা ইকবাল হাসান। গ্রামে রিকশা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। এবারের ঈদে তার একমাত্র কলেজ পড়ুয়া ছেলের আবদার ছিল একটি স্মার্টফোন। দরিদ্র বাবা একমাত্র ছেলের আবদার রাখতে কষ্ট করে কিছু টাকা সঞ্চয় করেন। এরমধ্যে ছেলে তার বন্ধুর ফোনে ফেসবুকে লোভনীয় এক বিজ্ঞাপন দেখতে পান। সেল সিটি নামক ওই ফেসবুক পেজের পোস্টে লেখা ছিলো, ২৬ হাজার টাকা দামের স্মার্টফোন পাচ্ছেন মাত্র ৩৫০০ টাকায়; কোরিয়া থেকে আমদানি করা সুপার মাস্টার কপি। দামি ফোন এতো কম টাকায় পাওয়ার আসায় না বুঝে অনলাইনে অর্ডার করেন ছেলে কাবিরুল ইসলাম। ২৪ ঘণ্টায় এসএ পরিবহনে ফোন পাঠিয়ে দেয়ার কথা বলা হয়।
পরের দিন এস এ পরিবহনের নাটোর শাখা থেকে কল আসলে সেখানে যান কাবিরুল ও তার বন্ধু। তাদের কথামতো ৩৫০০ টাকা দিয়ে পার্সেলটি হাতে নিয়ে খুলেই দেখেন স্মার্টফোনতো দূরের কথা ভেতরে কোন ফোনই নেই, আছে শুধু মাত্র একটি ফোন চার্জার। পরে তাদেরকে কল করলে বলেন ভুলে চলে গেছে, আগামীকাল স্মার্টফোনটি পূনরায় পাঠানো হবে। ততক্ষণে বুঝতে বাকি নেই কাবিরুলের, যে বড় ধরনের প্রতারণার শিকার হয়েছেন। পরে কথা বলতে বলতেই ফোন কেটে দেন। কিছুক্ষণ পর আবার কল দিলে ফোন আর রিসিভ করা হয়নি।
পরে এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় কাবিরুলের। তিনি জানান, সেল সিটি নামক ওই ফেসবুক পেজের পোস্টটি বুস্ট করা হয়েছে। যেখানে এই লোভনীয় বিজ্ঞাপন দেয়া ছিলো। সেই সঙ্গে বলা আছে, সঙ্গে পাবেন একটি পাওয়ার ব্যাংক ও ৬ মাসের মানিব্যাক গ্যারান্টি। শুধু কাবিরুল নয়, আসন্ন ঈদকে সামনে রেখে অনেক ভোক্তারাই এমন প্রতারণার শিকার হচ্ছেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, এমন অসংখ্য অনলাইন প্রতারক চক্র রাজধানীসহ সারা দেশেই নির্বিঘ্নে এসব অবৈধভাবে ব্যবসা করে যাচ্ছে। চক্রটি প্রতিদিন হাজার হাজার টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে সাধারণ ভোক্তাদের কাছ থেকে। বিশেষ করে গ্রামের সরলমনা মানুষদের টার্গেট তাদের।
দুই দিনের অনুসন্ধানে এমন অন্তত ৩০টিরও বেশি ফেসবুক পেজ খুঁজে পাওয়া যায়, যারা লোভনীয় অফার দেয়ার কথা বলে প্রতিনিয়ত ভোক্তাদের ঠকিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে অনলাইনে স্মার্টফোন বা ইলেকট্রনিকস পণ্যের ক্ষেত্রে এমন প্রতারণা বেশি চলছে। এই অসাধু কর্ম তাদের নতুন নয়, দীর্ঘদিন ধরে চলছে এমন অনলাইন প্রতারণা। সারাবছরই এভাবে চললেও ঈদ উপলক্ষে তাদের দৌরাত্ম বেড়ে যায়। এবছর লকডাউন থাকায় নতুন করে নড়েচড়ে বসেছে এসব প্রতারক চক্র। ভোক্তাদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেয় বিপুল পরিমাণ অর্থ।
অনুসন্ধানে আরো জানা গেছে, নামে বেনামে অসংখ্য ফেসবুক পেজ থেকে প্রতারক চক্রটি বিভিন্ন লোভনীয় পোস্টগুলো বুস্ট করেন। এতে তাদের টার্গেটকৃত গ্রাহকদের কাছে পোস্টটি পৌঁছে যায়। যার অধিকাংশ গ্রামের মানুষ।
এর মধ্যে কয়েকটি ফেসবুক পেজগুলো হলো- সেল সিটি, মোবাইল জোন, দারাজঅনলাইন২৪, মোবাইল সোর্স, বিডিএক্সপ্রেস, ঢাকাশপ, অনলাইন গুরু, বিডিমার্ট, কপি মোবাইল, কোরিয়ান মোবাইল, কোরিয়া স্মার্টফোন, চায়না স্মার্টফোনসহ আরো অনেকগুলো পেজ থেকে এমন প্রতারণা চলছে।
পোস্টগুলোতে যে নাম্বারগুলো দেয়া আছে সেগুলো হলো- ০১৭৭৮৪২০৪৮, ০১৭৯২৪৪০৯৩২, ০১৭২৩৪৬৯৭২৬, ০১৭০১৯৭৬৮৯৬, ০১৩১১৭১৬৩৬৮, ০১৭৪৬২৬৩১৫৬। এদের বেশিরভাগই অফিসের কোন ঠিকানা ব্যবহার করেনি। যারা ঠিকানা বলছে তারা ভুল ঠিকানা দিয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কয়েকটি নাম্বারে যোগাযোগ করা হলে তারা একেকবার একেক ঠিকানা দিচ্ছে। কল্পনা নাম জানিয়ে একজন প্রতারক ফোনে বলে, আমাদের অফিস মগবাজারের একে টাওয়ার। পরে আরেক নম্বর থেকে ফোন করা হলে বলেন, লেভেল ১, শপ নম্বর ১১, খান মার্কেট ঢাকা।
প্রতারণার শিকার আরো একজনের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বগুড়ায় সিকিউরিটি গার্ডের চাকরি করেন। নাম বাবলু। তিনি ৪২০০ টাকা দিয়ে অর্ডার করেন একটি স্যামসাং গ্যালাক্সি এস ১০ প্লাস ফোন। কিন্তু তিনি পার্সেল খুলে পেয়েছেন ৫টি দেশি আলু। এই ঘটনা লজ্জায় কাউকে বলতেও পারেননি তিনি। কাঁদো কাঁদো কন্ঠে এ প্রতিবেদককে তিনি ফোনে বলেন, এ মাসের বেতন পেয়েই চিন্তা ছিলো একটি স্মার্টফোন কিনবো। লকডাউনে মার্কেট বন্ধ তাই অনলাইনে খোঁজ নিচ্ছিলাম কিছুদিন যাবত। প্রথমে একটি মোবাইল জোন নামের ফেসবুক পেজের পোস্ট দেখতে পাই। এটা দেখার পর কিছুক্ষণ পর আরো অনেকগুলো পেজ সামনে আসতে থাকে। পরে দারাজঅনলাইন২৪ নামের একটি পেজ থেকে মোবাইলে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে একটি ফোন অর্ডার করি। কিন্তু কভার খুলে দেখি কয়েকটি আলু দেয়া হয়েছে।
আশিক রাজা নামের একজন জানান, তিনি একটি ভিভো স্মার্টফোন অর্ডার করেছিলেন ৩৫০০ টাকা দিয়ে। পেয়েছেন একটি চায়না ৫০০ টাকা দামের বাটন ফোন।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মাসুম আরেফিন মানবজমিনকে বলেন, প্রতারণার শিকার হয়েছে এমন কেউ অভিযোগ দিলে যথাসাধ্য ব্যবস্থা নেয়া হবে। আমরা রোজা এবং ঈদকে সামনে রেখে আমাদের নিয়মিত অভিযান চালিয়ে যাচ্ছি। এছাড়া অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কেউ অভিযোগ দিলে আমরা ব্যবস্থা নিয়ে থাকি।