রাতুল মন্ডল নিজস্ব প্রতিনিধি: বেশ কয়েকবছর ধরেই মানিক মিয়া ও হিরোফা আক্তারের পরিবারের সাথে গড়ে উঠেছিল পারিবারিক সম্পর্ক। এই সর্ম্পকের আড়ালে মানিক মিয়া প্রথমে হিরোফাকে মেয়ের স্বীকৃতি দেন। পরে বাবা-মেয়ের এই সম্পর্কের মধ্যেই হিরোফা বিভিন্ন প্রয়োজনে মানিক মিয়ার কাছে ব্যাংক চেক আমানত রেখে বেশ কিছু অংকের টাকা সুদ বাবদ ধার নেন। এক সময় মানিক মিয়া এই চেককে অবলম্বন করে হিরোফাকে জিম্মি করে তার সাথে অবৈধ মেলামেশার সম্পর্ক গড়ে তুলেন। মানিক মিয়া এক পর্যায়ে হিরোফাকে স্বামী-সন্তান ছেড়ে তাকে বিয়ের জন্য চাপ প্রয়োগ করেন। মানিকের প্রস্তাবটি হিরোফা তার পরিবারের লোকজনদের অবহিত করেন। এ নিয়ে সম্পর্কের অবনতি হয় উভয় পরিবারের মধ্যে।
পরে ধার নেয়ার সময় আমানত হিসেবে ব্যাংক চেকে ৫০লাখ টাকা বসিয়ে মানিক মিয়া ধার নেয়া টাকা উদ্ধারে হিরোফার বিরুদ্ধে আদালতে মামলা দায়ের করেন। আর এবিষয়টি নিয়ে মানিক মিয়ার সাথে হিরোফার পরিবার গত কয়েকমাস ধরেই এসব নিয়েই তৈরী হয়েছিল নানামুখী দ্বন্ধ। আর দ্বন্ধের রেশ ধরেই হিরোফা-লিটন দম্পতি ভিন্ন পথে হাঁটতে থাকেন। এক পর্যায়ে উপায় না পেয়ে মানিক মিয়াকে খুন করে লাশ গুম করার সিদ্ধান্ত নেন।
গত ১১ই ফেব্রুয়ারী সন্ধ্যায় মানিক মিয়াকে ডেকে গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার গাজীপুর ইউনিয়নের গাজীপুর উত্তরপাড়া গ্রামে হিরোফার বাবার বাড়ীতে ডেকে স্বামী-বাবা-ভাই ও ভাড়াটে খুনির সহায়তা মানিক মিয়াকে শ্বাসরোধ হত্যা করা হয়। মানিক মিয়া (৫২) শ্রীপুর পৌর এলাকার কেওয়া পশ্চিম খন্ড গ্রামের মৃত শাহাজ উদ্দিনের ছেলে। হিরোফা আক্তার (৪০) উপজেলার তেলিহাটি ইউনিয়নের মুলাইদ গ্রামের লিটন মিয়া স্ত্রী, সে ওই এলাকায় টেইলারিং কাজ করতেন। হত্যার মিশনে হিরোফার বাবা আনোয়ার, ভাই সোহেল ও ভাড়াটে খুনি রেজাউল করিম অংশ নেয়। রেজাউলকে ৩০হাজার টাকায় খুনের চুক্তি করেন হিরোফার বাবা।
শ্রীপুর থানার উপ-পরিদর্শক রাজীব কুমার দাস ও মো: আশরাফুল্লাহ্ জানান, গত ১১ ফেব্রয়ারী সন্ধ্যায় বাড়ী থেকে বাবার আনোয়ার হোসেনের অসুস্থতার কথা বলে কৌশলে মানিক মিয়াকে স্থানীয় সলিং মোড় ডেকে নেন হিরোফা। সেখান থেকে একটি অটোরিক্সায় করে মানিক মিয়াকে কয়েক কিলোমিটার দূরের গাজীপুর ইউনিয়নের গাজীপুর উত্তরপাড়া গ্রামের হিরোফার বাবা আনোয়ার হোসেনের বাড়ীতে নিয়ে যান। সেখানে পূর্ব থেকেই অবস্থান করছিলেন ভাড়াটে খুনি রেজাউল করিম, হিরোফার স্বামী লিটন ও তার বাবা আনোয়ার হোসেন ও তার ভাই সোহেল মিয়া। তাদের মধ্যে বেশ আলাপচারিতার পর রাতে রেজাউল ও সোহেল মিলে প্রথমে মানিকের গলায় গামছা পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেন। পরে হিরোফা-লিটন মিলে ধারালো চাকু ও দা দিয়ে প্রথমে গলা পরে দুই হাত- দুই পা কেটে বিচ্ছিন্ন করে বাড়ীর পাশের শৌচাগারের গর্তে ভেতরে মানিক মিয়ার মরদেহ ফেলে দেন। ২/৩ দিন পর মরদেহ পচেগলে সেখান থেকে প্রচুর গন্ধ বের হতে থাকে। গন্ধ ছড়ালে ধরা পরে যাওয়ার ভয়ে আনোয়ার হোসেন খবর দেন ভাড়াটে খুনি রেজাউলকে। রাতের আঁধারে সেই লাশটি শৌচাগারের গর্ত থেকে তুলে কিছুদুরের একটি ধানের জমির কাদাযুক্ত মাটিতে পুঁতে রেখে দেয়। ১৪/১৫দিন পর শিয়ালে সেই লাশটির আংশিক অংশ তুলে ফেললে আবারও খুনিরা লাশটি সেখান থেকে তুলে নিয়ে পলিথিনে মুড়িয়ে পাশের পুকুরে কাদা চাপা দিয়ে রাখেন। পরদিন পাশের বাড়ির এক মহিলা গরুকে গোসল করাতে গিয়ে মরদেহটি ভেসে থাকতে দেখে স্থানীয়দের খবর দেয়। পরে ২এপ্রিল দুপুরে শ্রীপুর থানা পুলিশ মরদেহটি উদ্ধার করে। দেহটি পচে গলে বিকৃত হয়ে যাওয়ায় ও আংশিক দেহটি মানুষ না পশুর এমন ধরনের প্রশ্নে পড়েন পুলিশ। বিভিন্ন পরীক্ষার পর মানুষের লাশ নিশ্চিত হওয়ার পর তারা অজ্ঞাত হিসেবে লাশটি উদ্ধার করে ময়না তদন্তের জন্য গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দিন আহমেদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রেরণ করেন।
এদিকে হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যাওয়া মানিক মিয়া বাড়ী ফিরে না আসায় তার ছেলে অ্যাডভোকেট মোস্তাফিজুর রহমান মিলন নিখোঁজের পর দিনই ১২ ফেব্রæয়ারী শ্রীপুর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরী করেন। এ ডায়েরীর সূত্র ধরেই তদন্ত শুরু করে শ্রীপুর থানা পুলিশের একটি টিম। নিখোঁজের কয়েকদিন পর ২২ই ফেব্রæয়ারী মানিক মিয়ার ছেলের মুঠোফোনে মুক্তিপণের টাকা দাবী করে একটি ক্ষুদেবার্তা আসে। সে বার্তায় খুলে দেয় মানিক মিয়া হত্যার মূল রহস্য।
প্রথমে তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় ক্ষুদেবার্তা প্রেরণকারী হিরোফার ভাই সোহেলকে শ্রীপুর থেকে আটক করে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। পরে তার দেয়া তথ্য মতে, গত ১৬ মে রাতে প গড়ের দেবীগঞ্জ ও ঠাকুরগাঁওয়ের সদর থানার বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালান শ্রীপুর থানার উপ-পরিদর্শক রাজিব কুমার সাহা ও আশরাফুল্লাহ। পরে সেখান থেকেই হিরোফা-লিটন দম্পতিকে আটক করা হয়। এছাড়াও গাজীপুর উত্তরপাড়া গ্রাম থেকে হিরোফার বাবা আনোয়ার হোসেন ও একই গ্রামের ভাড়াটে খুনি রেজাউল করিমকে আটক করা হয়। আটকের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের খুনিরা হত্যাকান্ডে জড়িত থাকার কথা পুলিশের কাছে স্বীকার করেছে।
শ্রীপুর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মনিরুজ্জামান জানান, মানিক মিয়ার সাথে নানামুখী দ্বন্ধের কারণে অভিযুক্তরা মানিক মিয়াকে হত্যা করে লাশ গুম করার চেষ্টা করেন। তারা সকলেই পুলিশের কাছে হত্যার বর্ণনা দিয়ে দোষ স্বীকার করেছেন। তাদের জবানবন্দির আলোকে অনেকটা নিশ্চিত হওয়া গেছে উদ্ধারকৃত মরদেহের অংশবিশেষ মানিক মিয়ার। আর মানিক মিয়ার ছেলে মোস্তাফিজুর রহমান মিলনের সাথে ওই দেহের ডিএনএ টেষ্টের জন্য পাঠানো হবে। ডিএনএ টেষ্টের ফল হাতে পেলে ওই দেহের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যাবে।
কালিয়াকৈর সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার আল-মামুন জানান, মানিকের সাথে টাকা পয়সা লেনদেন নিয়েই তাদের পরিচয় হয়। উচ্চ সুদে মানিকের দেয়া ঋণ পরিশোধ করে হিরোফা। হিরোফার পরিচয়ের সুবাদে ওই এলাকার বিভিন্ন মহিলাদেরও ঋণ দিতো মানিক। বিভিন্ন ব্যাংক ও এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে হিরোফা ও মানিক উচ্চ সুদে ওই এলাকায় বিভিন্ন জনের কাছে বিনিয়োগ করতো। কোন গ্রহীতা ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে হিরোফাকে চাপ দিতো মানিক। এসময় হিরোফার কাছ থেকে মানিক ব্যাংকের কয়েকটি ব্যাংকের চেক নেয়।