ঢাকা: করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত অসহায় কর্মহীন মানুষের জন্য ২,৫০০ টাকা করে দেয়ার শুভ উদ্যোগে তালগোল লেগেছে শুরুতেই। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতি এবং তালিকা প্রণয়নে গাফিলতির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের হাতে প্রধানমন্ত্রীর এই ‘ঈদ উপহার’ পৌঁছাতে দেরি হচ্ছে। গত বৃহস্পতিবার প্রায় ১,২৫০ কোটি টাকার এই কর্মসূচির উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। উদ্বোধনের পর পর্যায়ক্রমে চিহ্নিত ক্ষতিগ্রস্তদের মোবাইল ফোনে এই অর্থ পৌঁছে যাওয়ার কথা। কিন্তু উদ্বোধনের পরই বিভিন্ন এলাকার তালিকায় অনিয়ম, একই মোবাইল নম্বর দিয়ে অনেক মানুষকে তালিকাভুক্তির মতো ঘটনা উঠে আসে। এছাড়া স্বচ্ছল ব্যক্তি, রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী এবং রাষ্ট্রীয় অন্যান্য সুবিধা পাওয়া মানুষের নামও এই তালিকায় উঠে আসার তথ্য আসে। তালিকায় অনিয়ম করায় জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে বিক্ষোভের ঘটনাও ঘটে। বিভিন্ন স্থানে অনিয়ম তদন্তে স্থানীয় প্রশাসন তদন্তও শুরু করেছে।
ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, অন্তত ১৬ ভাগ নামের পাশে একই নম্বর ব্যবহার করা হয়েছে। মন্ত্রণালয় এটি চিহ্নিত করার পর বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। যদিও বলা হচ্ছে কোন নম্বরে এক বারের বেশি টাকা জমা হবে না। তাই একাধিকবার নম্বর দেয়া থাকলেও টাকা যাবে একবারই। নানা স্থানে অনিয়মের তথ্য আসায় তালিকা সংশোধন করে নতুন করে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। গতকালের সংশোধিত এ তালিকা পাঠাতে জেলা প্রশাসকদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (ত্রাণ-১) আবুল খায়ের মো. মারুফ হাসান এ তথ্য জানিয়েছেন। তিনি বলেন, কিছু তালিকায় একই মোবাইল নম্বর একাধিকবার থাকায় তালিকা সংশোধনের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এরপর উপকারভোগীদের অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠানো হবে। তিনি জানান, প্রধানমন্ত্রী যে কয়েকজনের মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠিয়েছিলেন তার বাইরে এখনও অন্য সুবিধাভোগীদের অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠানো হয়নি।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, টাকা আত্মসাতের জন্য এটা করা হয়নি। কোনো কোনো তালিকায় একই মোবাইল নম্বর ২০০ বারও আছে। কারণ তালিকা করার সময় যাদের মোবাইল নম্বর পাওয়া যায়নি তাদের নামের পাশে যারা তালিকা করেছেন তাদের মোবাইল নম্বর বারবার বসিয়ে দিয়েছেন। আইসিটি বিভাগ যাচাই করে দেখেছে তালিকার ১৫-১৬ শতাংশ সুবিধাভোগীর নামের সঙ্গে একই মোবাইল নম্বর ব্যবহার করা হয়েছে। তিনি বলেন, এখন এভাবে টাকা পাঠানো সম্ভব হচ্ছে না। কারণ কোনো মোবাইল নম্বরে একবার টাকা পাঠানোর পরে সিস্টেমই ওই নম্বরে আর টাকা পাঠাতে দেবে না। যাদের মোবাইল নেই তাদের সরকারের পক্ষ থেকে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলে দিয়ে সেখানে টাকা পাঠানো হবে বলে জানান তিনি। মন্ত্রণালয় থেকে সংশোধিত তালিকা চেয়ে যে চিঠি দেয়া হয়েছে সেখানে বলা হয়েছে, ‘মুজিব বর্ষে করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত ৫০ লক্ষ পরিবারের মধ্যে নগদ অর্থ সহায়তা প্রদান কর্মসূচি সংক্রান্ত নির্দেশিকায় ভাসমান মানুষ, নির্মাণ শ্রমিক, গণপরিবহন শ্রমিক, রেস্টুরেন্ট শ্রমিক, ফেরিওয়ালা, রেলওয়ে কুলি, মজুর, ঘাটশ্রমিক, নরসুন্দর, দিনমজুর, রিকশা/ভ্যানগাড়িচালক এবং নিম্ন মধ্যবিত্ত আয়ের লোকসহ মানবিক সহায়তা পাওয়ার যোগ্য পরিবারবর্গ এবং যারা দৈনিক আয়ের ভিত্তিতে জীবিকা নির্বাহ করে এ রকম জনগোষ্ঠী অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে নির্দেশনা প্রদান করা হয়। এই পেশাভিত্তিক লোকজন যারা বাদ পড়েছেন তাদের অন্তর্ভুক্ত করে তালিকা চূড়ান্ত করতে হবে।
যেসব অভিযোগ: হবিগঞ্জ জেলার লাখাই উপজেলায় সাড়ে ছয় হাজার পরিবারের তালিকায় একই মোবাইল নম্বর ব্যবহৃত হয়েছে ২০০ বার। রয়েছে অনেক বিত্তশালী এবং জনপ্রতিনিধির আত্মীয়-স্বজনের নামও। অনিয়মের ফলে প্রকৃত গরীব, অসহায়রা প্রণোদনা থেকে বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। লাখাই উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নে ছয় হাজার ৭২০টি পরিবার পাচ্ছে নগদ আড়াই হাজার করে সরকারি অর্থ সহায়তা। এরমধ্যে লাখাই ইউনিয়নে এক হাজার ১৯৪, মোড়াকরি ইউনিয়নে এক হাজার ১১৩, মুড়িয়াউক ইউনিয়নে এক হাজার ১৭৬, বামৈ ইউনিয়নে এক হাজার ২৪৬, করাব ইউনিয়নে এক হাজার ছয় এবং বুল্লা ইউনিয়নের ৯৮৫ পরিবার রয়েছে। ইতোমধ্যে উপজেলা প্রশাসনের নিকট খসড়া তালিকা জমা দিয়েছেন জনপ্রতিনিধিরা। তালিকায় মুড়িয়াউক ইউনিয়নে চারটি মোবাইল নম্বর ব্যবহৃত হয়েছে ৩০৬ জনের নামের সঙ্গে। আর এই নম্বরগুলো ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম মলাইয়ের ঘনিষ্ঠজনের। এছাড়া, তালিকায় যুক্ত হয়েছে অনেক বিত্তশালী ও জনপ্রতিনিধিদের আত্মীয়-স্বজনের নাম। রয়েছেন স্বামী-স্ত্রীসহ এক পরিবারের একাধিক সদস্যও। একটি ওয়ার্ডে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বসবাস না থাকলেও লেখা হয়েছে তাদের নাম। আরও ৩০টি নম্বর ব্যবহার করা হয়েছে ১০ থেকে বারো জনের নামে। অনিয়ম প্রকাশের পর ওই ইউনিয়নের বঞ্চিত ক্ষতিগ্রস্তরা বিক্ষোভ করেছেন। স্থানীয় প্রশাসন অবশ্য ঘটনা তদন্তের আশ^াস দিয়েছে। এ ব্যাপারে হবিগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ কামরুল হাসান বলেন, যাচাই-বাছাইয়ে কতিপয় অসঙ্গতি মিলেছে। এসব বিষয়ে তদন্ত শুরু হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর মানবিক সহায়তার তালিকায় বাগেরহাটের শরণখোলায় একই কাণ্ড ঘটিয়েছেন এক ইউপি সদস্য। ৪০ জন মানুষের নামের পাশে নিজের মোবাইল নম্বর জুড়ে দিয়েছেন তিনি। শুধু তাই নয় শরণখোলা উপজেলার ওই তালিকায় চৌকিদার, সরকারি বিভিন্ন সুবিধাভোগকারী ও স্বচ্ছল ব্যক্তির নামও রয়েছে। ৪০ জন সুবিধাভোগীর নামের তালিকায় নিজের মোবাইল নম্বর জুড়ে দেয়া ইউপি সদস্য হচ্ছেন শরণখোলা উপজেলার খোন্তাকাটা ইউনিয়নের দুই নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য রাকিব হাসান। এ ঘটনায় অনিয়মকারী ইউপি সদস্যকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। একইভাবে কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার ১৪ ইউনিয়নে ১২ হাজার ৬০০ জন দরিদ্র ব্যক্তি নগদ অর্থ পাওয়ার কথা রয়েছে। এ বিষয়ে তালিকায় হতদরিদ্র, দিনমজুর, দুস্থ্য ও করোনার কারণে কর্মহীন হয়ে পড়া গরীব মানুষের নাম বাদ দিয়ে স্বচ্ছল ও বিত্তবানদের নাম তালিকাভূক্ত করা হয়েছে। এতে প্রবাসী থেকে সরকারি চাকরিজীবী পরিবারের সদস্যদের নামও রয়েছে।