ঢাকা: খাবারের প্রতি অন্যরকম ভালোলাগা ছিল জীবন ঘোষের (২৯)। আর এই ভালোলাগা থেকেই বাসার পাশে উত্তর মুগদায় গড়ে তুলে ‘জীবন ফুড ফ্যান্টাসি’ নামে একটি খাবারের দোকান। জীবনের এই ফুড ফ্যান্টাসি চালাতে সহযোগিতা করতেন তার বাবা নারায়ণ ঘোষ, মেজো ভাই মিঠুন ঘোষ ও ছোট ভাই রাজীব ঘোষ। যদিও দোকানের নিয়ন্ত্রণ ছিলো জীবনের কাছে। আর তাকে সার্বক্ষণিক সহযোগিতা করতো ছোট ভাই রাজীব। জীবনের ছোট ভাই রাজীব কিছুটা বাউণ্ডুলে স্বভাবের ছিল। বন্ধু বান্ধবের সঙ্গে আড্ডা, সিগারেট খাওয়া ছিল তার নেশা। তার আড্ডাবাজিতে নিয়মিতই টাকার প্রয়োজন হতো।
তাই বড় ভাই জীবনের কাছ থেকে প্রতিদিনই ৫০-১০০ টাকা চাইতো সে। জীবন অনেক সময় দোকানের হিসাব থেকে টাকা দিতে চাইতো না। বাজে খরচের জন্য রাজীবকে প্রায়ই বকাঝকা করতো। এসব কারণে বড় ভাইয়ের প্রতি ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেছিল রাজীব। একসময় ক্ষোভটা বড় হয়ে যায়। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় তুচ্ছ ঘটনায় থাপ্পড় দেয়াকে কেন্দ্র করে রাজীব তার বড় ভাই জীবনে হত্যা করে।
জীবন হত্যার ঘটনাটি পুরোপুরি ক্লুলেস ছিলো। ছোট ভাই বড় ভাইকে হত্যা করবে প্রাথমিকভাবে এমনটা ধারনা করা যায়নি। কারণ ঘাতক রাজীব তখনও পরিবারের সঙ্গে ছিল। আর করোনা পরিস্থিতিতে এই হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটন তদন্ত সংশ্লিষ্টদের কাছে ততটা সহজ ছিল না। কিন্তু ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সবুজবাগ জোনের সহকারি কমিশনার রাশেদ হাসানের নেতৃত্বে মুগদা থানা পুলিশ ঘাতক রাজীব ঘোষকে শুক্রবার গ্রেপ্তার করে। রাজীব বড় ভাইকে হত্যার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছে।
রাজীব জানিয়েছে, বড় ভাই জীবন তার চলাফেরা পছন্দ করতো না। সে প্রায়ই দোকানে জীবনের কাছে টাকা চাইতো। জীবন তাকে সবসময় টাকা না দিয়ে বকা দিত। রমজান শুরু হওয়ার পর থেকে তারা সকালে দোকানে গিয়ে ইফতার তৈরি করে বিক্রি করতো। ঘটনার দিন বৃহস্পতিবারও তারা দুই ভাই দোকানে গিয়ে ইফতার তৈরি ও বিক্রি করেছে। দুপুরে বড় ভাই জীবন বাসায় গিয়ে গোসল করে দুপুরের খাবার খেয়ে রাজীবের জন্য খাবার নিয়ে আসে। পুলিশের নির্দেশনা অনুযায়ী বিকাল চারটার মধ্য বিক্রি বন্ধ করে তারা দোকানের সাটার অর্ধেক নামিয়ে হিসাব মেলানো ও ধোয়ামোছার কাজ করছিলো। বাইরে তখন বৃষ্টি। কাজ শেষ করে সন্ধ্যার দিকে রাজীব তার বড় ভাই জীবনের কাছে ১০০ টাকা চায়। জীবন তাকে টাকা না দিয়ে বকা দেয়। তখন দুই ভাইয়ের মধ্যে কথা কাটাকাটি শুরু হয়। কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে রাজীব আচমকা বড় ভাইয়ের ওপর ক্ষেপে যায়। তখন সে দোকান থেকে একটি ইট নিয়ে জীবনের মাথার পেছনে জোরে কয়েকটা আঘাত করে। সঙ্গে সঙ্গে জীবন মাঠিতে লুটে পড়ে। এ অবস্থায় রাজীব আবার ইটের টুকরো নিয়ে জীবনের মাথায় আঘাত করে। তখন সে দেখতে পায় জীবনের মাথা থেকে অঝোর ধারায় রক্ত পড়ে সব রক্তাক্ত হয়ে যাচ্ছে। রাজীব একটি গামছা নিয়ে জীবনের মাথার রক্ত বন্ধ করার চেষ্টা করে। ততক্ষণে সে বুঝতে পারে তার ভাই আর নড়াচড়া করছে না। পরে তড়িঘড়ি করে জীবনের মরদেহ টেনে দোকানের পেছনে নিয়ে যায় রাজীব। বড় ভাইয়ের মরদেহ দোকানে রেখেই সে বাসায় চলে যায়।
এদিকে জীবনের বাবা নারায়ন ঘোষ মুগদা থানার মামলার এজাহারে বলেছেন, তার দুই ছেলে প্রতিদিন সন্ধ্যার পরপরই দোকানের কাজ শেষ করে বাসায় ফিরে। ঘটনার দিন সন্ধ্যার পর রাজীব বাসায় ফিরে গোসল করে। জীবনের কথা জিজ্ঞেস করলে জানায় দোকানের পেছনের দরজা দিয়ে বের হয়ে সে বাসায় এসেছে। আসার সময় সামনের সাটার বন্ধ পেয়েছে। রাত বাড়ার পরও জীবন বাসায় না আসাতে তাদের টেনশন বাড়তে থাকে। রাত পৌনে আটটার দিকে তিনি জীবনের মোবাইলে ফোন করলে বন্ধ পান। পরে তিনি ও ছোট ছেলে রাজীব বিকল্প চাবি নিয়ে দোকানের দিকে যান। রাজীব দোকান খোলে চিৎকার দিয়ে বলে বাবা দাদা আর নেই। তখন তিনি নিজেও গিয়ে দেখেন জীবনের মরদেহ পড়ে। তাদের চিৎকারে আশেপাশের লোকজন এগিয়ে আসে। পরে মুগদা থানার পুলিশ এসে মরদেহ উদ্ধার করে নিয়ে যায়।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সবুজবাগ জোনের সহকারি কমিশনার রাশেদ হাসান বলেন, ঘটনার পরপরই মুগদা থানার পুলিশসহ আমি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। আমরা জীবনের রক্তাক্ত নিথর দেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য মরদেহ মর্গে পাঠাই। ঘটনাস্থলের আশেপাশের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ ও প্রযুক্তির সহায়তায় তদন্ত শুরু করি। জীবনের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে রাজীবকে সন্দেহ করি। পরে রাজীবকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করলে নিশ্চিত হই, সে নিজেই তার ভাইয়ের ঘাতক। মাত্র ১০০ টাকার জন্য মাথায় ইট দিয়ে আঘাত করে জীবনকে হত্যা করেছে। রাজীব ইতিমধ্যে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে।
তিনি বলেন, রাজীব কিছুটা বখাটে স্বভাবের ছিল। কিছুদিন আগেও সে কিডনাপের একটা নাটক সাজিয়েছিল। বৌদ্ধ মন্দির এলাকা থেকে নাকি তাকে কয়েকজন তুলে নিয়ে মিরপুর এলাকার কোথাও আটকে রেখেছিল। পরে তার মোবাইল থেকে ফোন দিয়ে পরিবারের কাছে ৪-৫ লাখ টাকা চেয়েছিলো। টাকা না পেয়ে কয়েকদিন পর নিজেই বাসায় ফেরত আসে।