গার্মেন্ট কারখানা বন্ধের সামর্থ রাখে না বাংলাদেশ। আবার খোলা রাখাও এক ভয়াবহ ধারণা বলে মনে হয়। বিশ্বখ্যাত ম্যাগাজিন ইকোনমিস্টে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ কথা বলা হয়েছে। এতে আরো বলা হয়, গার্মেন্টকর্মী রুমি বাংলাদেশের লকডাউনকে দেখছেন একেবারে নিষ্ঠুরতা হিসেবে। তিনি বলেন ‘যেকোনো মানুষ, রিক্সাচালক, হকার- যেকেউ রাস্তায় গেলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদেরকে প্রহার করে।’ কিন্তু যখন গার্মেন্ট কারখানা ও মসজিদের প্রসঙ্গ আসে তখন কর্তৃপক্ষ ভিন্ন কথা বলে।
বাংলাদেশে গার্মেন্ট কারখানায় কাজ করেন প্রায় ৪১ লাখ শ্রমিক। তারা গাদাগাদি, ঠাসাঠাসি করে যেমন বসবাস করেন, কারখানায়ও তাদের সেই একই পরিস্থিতি। এ অবস্থা কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হওয়ার জন্য বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ।
গত বছর তৈরি পোশাক রপ্তানি করে বাংলাদেশের গার্মেন্ট শিল্প দেশে এনেছে ৩৪০০ কোটি ডলার, যা জাতীয় প্রবৃদ্ধির ১৩ শতাংশ। কয়েক দশকে দেশের চিত্তাকর্ষক প্রবৃদ্ধিতে এই খাতটি অবদান রেখে চলেছে বা এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
প্রথমে দীর্ঘ ছুটি ঘোষণার মধ্য দিয়ে করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের চেষ্টা করে সরকার। যখন তারা স্পষ্ট এটা দেখেছে যে, এই ছুটি যথেষ্ট হবে না, তখন ৩১ শে মার্চ পর্যন্ত ব্যবসাবাণিজ্য বন্ধ করে দেয়ার নির্দেশ দেয়। লক্ষণীয় বিষয় হলো, লকডাউন থেকে বাইরে রাখা হয়েছে গার্মেন্ট কারখানা, যা রাজধানী ঢাকার ভিতরে ও এর চারপাশে কেন্দ্রীভূত। চারদিন পরে এগুলো বন্ধ করে দেয়ার একটি নির্দেশ দেয়া হয়। ওদিকে ছুটি ঘোষণার ফলে শ্রমিকদের অনেকে গ্রামের বাড়ি ফিরে গিয়েছিলেন। কারখানা মালিকদের আহ্বানে তারা ফিরে আসেন। কিন্তু তাদের এই ফিরে আসার আগে ওই বন্ধের ঘোষণা দেয়া হয়নি। শ্রমিক নেত্রী কল্পনা আকতার বলেন, মালিকদের নির্দেশনা পেয়ে হাজার হাজার গার্মেন্ট শ্রমিক হন্তদন্ত হয়ে পায়ে হেঁটে ফেরেন কর্মস্থলে।
গার্মেন্ট কারখানার মালিকদের কারণে এসব শ্রমিক এখন বস্তিগুলোতে অসহায় দিন কাটাচ্ছেন। এই গার্মেন্ট কারখানা হলো বর্তমানে বাংলাদেশে করোনা ভাইরাস প্রাদুর্ভাবের কেন্দ্রস্থল। এখন কাজ না থাকায় এবং ক্ষুধায় ভোগা হাজার হাজার শ্রমিক পুলিশ ও সেনাদের লাঠিচার্জকে উপেক্ষা করে তাদের বকেয়ার দাবিতে বিক্ষোভ করছেন। কারখানাগুলো যাতে শ্রমিকদের মজুরি দিতে পারে এ জন্য সরকার সস্তা সুদে প্রায় ৫৯ কোটি ডলার দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ওই অর্থ পাওয়ার জন্য এখনও অপেক্ষায় মালিকরা। সরকার বলেছে, মার্চের বেতন পাননি দেড় লাখ শ্রমিক। কিন্তু কল্পনা আকতার বলেন, বেতন না পাওয়া এমন শ্রমিকের সংখ্যা দুই লাখের বেশি।
বাংলাদেশ গার্মেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স এসোসিয়েশনের বিজিএমইএ প্রেসিডেন্ট রুবানা হক যখন একে জীবন ও জীবিকার মধ্যে নিষ্ঠুর এক উভয় সঙ্কট বলছেন, তখন কর্তৃপক্ষ কারখানাগুলোকে কাজ শুরুর নির্দেশনা দিয়েছে। এ সপ্তাহে প্রায় ২০০০ কারখানা খুলে দেয়া হয়েছে। কয়েকদিনের মধ্যে আরো কয়েক শত খুলে দেয়া হবে।
করোনা ভাইরাস মহামারির কারণে বিশ্বে পোশাকের চাহিদা কমে গেছে। তবু অনেক কারখানা মালিক মনে করছেন, তাদের পক্ষে কারখানা আর বন্ধ রাখা সম্ভব নয়। এরই মধ্যে প্রায় ৩৫০ কোটি ডলারের অর্ডার বাতিল হয়ে গেছে। এর ফলে যা কিছু কাজ এখনও বাকি আছে তার শর্ত পূরণে তারা অধিক তৎপর হয়েছেন। এখনও কিছু অনলাইন খুচরা ক্রেতা পোশাক কিনছে। ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন অংশে লকডাউন শিথিল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেখানে আবার চাহিদা বৃদ্ধি পেতে পারে।
বেক্সিমকো টেক্সটাইলসের সৈয়দ নাভেদ হোসেন বলেছেন, প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ কম্বোডিয়া, চীন, শ্রীলঙ্কা ও ভিয়েতনামের গার্মেন্ট কারখানাগুলো এরই মধ্যে আবার খুলে দেয়া হয়েছে। বেক্সিমকো টেক্সটাইলসে কাজ করেন ৪০,০০০ শ্রমিক। এ প্রতিষ্ঠানটি ওয়ালমার্ট ও জারা’র মতো পশ্চিমা বড় ক্রেতাদের কাছে পোশাক বিক্রি করে। সৈয়দ নাভেদ হোসেনের আশঙ্কা, যদি বাংলাদেশি সরবরাহ লকডাউনের অধীনেই রাখা হয় তাহলে ক্রেতারা অন্যকোথাও থেকে তাদের কেনাকাটা শুরু করতে পারে।
শ্রমিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে গাইডলাইন্স ইস্যু করেছে বিজিএমইএ। একদিকে মুখে মাস্ক পরা, হাত ধোয়া এবং শ্রমিকদের মধ্যে দূরত্ব রাখার মতো সুরক্ষামুলক ব্যবস্থা নেয়ার পরামর্শ দেয়া হয়েছে, অন্যদিকে মিসেস রুবানা হক হাসপাতালের সঙ্গে চুক্তি করার চেষ্টা করছেন, যাতে কোনো গার্মেন্টকর্মী কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হলে তাকে চিকিৎসা নিশ্চিত করা হয়।
কিন্তু সুস্থ স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় সঙ্কট রয়েছে। বাংলাদেশের জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি। এই বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠীর জন্য ২০০০ টির চেয়েও কম ভেন্টিলেটর আছে। আর আছে প্রায় ১০০০ টি আইসিইউ বেড। এ পর্যন্ত ৭১০০ জনের দেহে করোনা ভাইরাস ধরা পড়েছে। কিন্তু সীমিত পরীক্ষা সত্ত্বেও দ্রুতগতিতে বাড়ছে এই সংখ্যা। এই রোগ দৃশ্যত সবচেয়ে দ্রুতগতিতে ওইসব জেলায় ছড়িয়ে পড়ছে বলে মনে হচ্ছে, যেখানে গার্মেন্ট কারখানাগুলো গাদাগাদি অবস্থায় রয়েছে। এমন একটি এলাকা হলো নারায়ণগঞ্জ। এখানে এ সপ্তাহে একদিনে পরীক্ষা করা হয়েছে ১৬০ জনের। তার মধ্যে করোনা পজেটিভ এসেছে ১৫০ জনের।
এরই মধ্যে অনেক কারখানা অর্ডার বাতিল হওয়ার কারণে আর্থিক সঙ্কটে পড়েছে। তারা এই রোগ নিয়ন্ত্রণের নিয়ম ভঙ্গ করে হলেও ব্যয় হ্রাসের চেষ্টা করছে। গাজীপুর হলো করোনা ভাইরাসের আরেকটি হটস্পট। সেখানে যে কারখানায় রুমি কাজ করেন, সরকারের পরিবর্তিত নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও তা লকডাউনের পুরো সময়ই খোলা ছিল।
রুমির আটজন সহকর্মী মারা গেছেন। তিনি বলেছেন, বিজিএমইএ তার বসদের বলেছে, তাদেরকে হ্যান্ডগ্লোভস দিতে। কিন্তু এসব গ্লোভস দৃশ্যত বসেরাই রেখেছেন নিজেদের কাছে। রুমির প্রশ্ন- কেন আমাদেরকেও গ্লোভস দেয়া হচ্ছে না? মনে হচ্ছে আমাদের জীবনের কোনো মূল্য নেই।