বিবিসি: বিয়ে না করা এবং সন্তান না নেবার প্রতি দক্ষিণ কোরিয়ার নারীরা ইদানীং বেশি ঝুঁকছেন। এমনকি পুরুষদের সাথে সম্পর্কে জড়ানোর ক্ষেত্রেও সেখানকার নারীদের অনীহা রয়েছে। পৃথিবীতে সবচেয়ে কম জন্মহার যেসব দেশে তার মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়া অন্যতম। বর্তমান অবস্থার কোনো পরিবর্তন না হলে দেশটিতে জনসংখ্যা কমার দিকে যাবে।
” আমি কখনোই সন্তান নেব না। আমার সে পরিকল্পনা নেই,” বলছিলেন ২৪ বছর বয়সী জ্যাং ইয়ান-ওয়া। সন্তান নেবার জন্য যে শারীরিক ধকল সইতে হয় সেজন্য প্রস্তুত নন তিনি। সন্তান জন্ম দিলে পেশাগত ক্ষতি হতে পারে বলেও তিনি মনে করেন।
ইয়ান-ওয়া একজন ওয়েব কমিক আর্টিস্ট। পেশাগতভাবে তিনি এখন যে অবস্থানে আছেন সেখানে আসতে তাকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে।
তিনি চান না তার এ কষ্টার্জিত পেশাগত অর্জন নষ্ট হয়ে যাক। “একটি পরিবারের অংশ হওয়ার চেয়ে আমি একা এবং স্বাধীন থাকতেই পছন্দ করি,” বলেন ইয়ান-ওয়া।
ইয়ান-ওয়া’র মতো দক্ষিণ কোরিয়ার অনেক নারী মনে করেন পেশাগত উৎকর্ষতা এবং পরিবার- দুটো একসাথে হয় না। একটি রাখতে হলে আরেকটি ছাড়তে হবে। এটি তাদের ধারণা।
চাকরি অবস্থায় কোন নারী গর্ভবতী হলে সে যাতে বৈষম্যের শিকার না হয়, সেজন্য দক্ষিণ কোরিয়ায় আইন রয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন।
চোই মুন-জেয়ং-এর গল্পটা সে রকম। তিনি যখন গর্ভবতী হবার বিষয়টি তার অফিসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে জানালেন, তখন খুব বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়েছিল।
ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার আচরণে তিনি রীতিমতো বিস্মিত হন।
“আমার বস বললেন, আপনার সন্তান হলে সেটিই হবে আপনার মনোযোগের জায়গা। তখন কর্মস্থলকে আপনি কম গুরুত্ব দেবেন। তখন আপনি কাজ করতে পারবেন?” বলছিলেন চোই মুন-জেয়ং।
সে সময় তিনি একজন ট্যাক্স অ্যাকাউন্টেন্ট হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
অফিসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা তাঁর উপর কাজের বোঝা চাপাতে থাকেন এবং অভিযোগ করেন যে কাজের প্রতি মুন-জেয়ং-এর কোনো মনোযোগ নেই।
মানসিক চাপ সইতে না পেরে একদিন অফিসেই অজ্ঞান হয়ে যান তিনি। মুন-জেয়ং যাতে চাকরি ছেড়ে যেতে বাধ্য হয় সে পরিস্থিতি তৈরি করেন তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।
” আমার আশপাশে অনেকেই আছেন যাদের কোন সন্তান নেই এবং সন্তান নেবার কোন পরিকল্পনাও তাদের নেই,” বলছিলেন মুন-জেয়ং।
দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থনৈতিক অগ্রগতির পেছনে যেসব কারণ রয়েছে সেগুলো হচ্ছে – মানুষের কঠোর পরিশ্রম, দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করা, কাজের প্রতি একাগ্রতা। এসব কারণে দেশটি গত ৫০ বছরে উন্নয়নশীল দেশ থেকে পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।
কিন্তু এক্ষেত্রে নারীদের অবদানের বিষয়টি উপেক্ষিত রয়ে গেছে। কিন্তু দেশটিতে ব্যাপক অর্থনৈতিক অগ্রগতি হলেও নারীর প্রতি সামাজিক মনোভাব বদলায়নি। ইয়ান-ওয়া বলেন, পুরুষদের মনোরঞ্জনের বিষয় হিসেবে দেখা হয় নারীদের।
কোন মেয়ে চাকরিজীবী হলেও সন্তান জন্মদানের পর তা লালন-পালনের ভার নারীর উপরেই বর্তায়।
ইয়ান-ওয়া বলেন, শুধু বিয়ে নয়, তিনি ছেলে বন্ধুও চান না। এর একটি কারণ হচ্ছে ছেলে বন্ধুর মাধ্যমে পর্নোগ্রাফির ভিকটিম হবার সম্ভাবনা থাকে।
সম্পর্ক ভেঙ্গে যাবার পরে দক্ষিণ কোরিয়ায় অনেক ছেলে তাদের মেয়ে সঙ্গীর অন্তরঙ্গ ছবি ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেয়। দক্ষিণ কোরিয়ায় এখন এটি বড় একটি ইস্যু। তাছাড়া ছেলে বন্ধু কিংবা স্বামীদের দ্বারা শারীরিকভাবে নির্যাতনের আশংকাও রয়েছে।
এতে থেকে বোঝা যাচ্ছে যে দক্ষিণ কোরিয়ায় কেন জন্মহার কম। দেশটিতে বিবাহের হার এখন সর্বনিম্ন পর্যায়ে আছে। প্রতি হাজারে ৫.৫ শতাংশ। ১৯৭০ সালে এ হার ছিল ৯.২ শতাংশ।
বিয়ে কিংবা সন্তান নিতে অনাগ্রহের আরেকটি বড় কারণ হচ্ছে জীবনযাত্রার ব্যয়। এসব নানা কারণে দক্ষিণ কোরিয়ার সমাজ ব্যবস্থায় একটি বড় ধরণের পরিবর্তন ঘটছে।
এর ফলে দেশটিতে তৈরি হয়েছে ‘সাম্পা প্রজন্ম’ । ‘সাম্পা’ শব্দের অর্থ হচ্ছে তিনটি জিনিস বাদ দাও – সম্পর্ক, বিয়ে ও সন্তান।