বাণী ইয়াসমিন হাসি: এপ্রিল-মে দেশের কৃষির জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুই মাস। বোরো’র পাকা ধান এখন মাঠে। হাওরের ধান পেকে মাটিতে পড়ে যাচ্ছে। কারণ কাটার জন্য দক্ষিণাঞ্চলের কৃষি শ্রমিকরা সেখানে যেতে পারছেন না। বোরো কাটা হলে বোনা হবে আউশ, আমন ও পাট। সেগুলোর বীজ বুনবেইবা কে, সেচইবা কোথা থেকে দেবেন কৃষক। করোনা সংক্রমের এই সঙ্কটে নগদ টাকা, কাঁচামাল ও শ্রমিক- সবইতো ঘরবন্দী।
করোনাভাইরাসে যখন সারাদেশ আতঙ্কিত, ঠিক তখনই হাওরাঞ্চলে বছরের একমাত্র ফসল বোরো ধান কাটা শুরু হয়েছে। হাওরজুড়ে অর্ধেকেরও বেশি বোরো জমির ধান পেকে গেছে। দেশে এমন পরিস্থিতিতে জেলার বাইরে থেকেও এ বছর কোনও ধানকাটার শ্রমিক আসছে না এখানে।
ফলে জমির পাকা ধান নিয়ে শ্রমিক সঙ্কটে পড়েছে এ অঞ্চলের হাজারও কৃষক। এদিকে, আবার শিলাবৃষ্টি আর আগাম বন্যায় জমি তলিয়ে যাবার আশঙ্কাও রয়েছে। সব মিলিয়ে হাওরের কৃষক এখন দিশেহারা হয়ে পড়েছেন।
কৃষি খাতে এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা বোরো মৌসুমে ধান কাটা নিয়ে। বোরো ধান কাটতে বর্তমানে পর্যাপ্ত কৃষি শ্রমিক বা দাওয়াল নেই। সেই তীব্র সঙ্কটই চলছে হাওরে। ধুঁকছে হাওর। মাঠে মাঠে দুলছে সোনালি ফসল। একদিকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, আরেকদিকে করোনা দুর্যোগ। পাকা ধান লুটিয়ে পড়ছে জমিনে। কৃষকের হৃদকম্পনে বোরো হাওরে স্বপ্ন ভাসছে।
জাতিসংঘসহ অনেকেই দিয়েছে দুর্ভিক্ষের ইঙ্গিত। অনিবার্যভাবে প্রাধান্য পাচ্ছে খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টিও। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাড়ির আঙ্গিনা ও টবসহ দেশের এক ইঞ্চি খালি জায়গাও আবাদের বাইরে না রেখে উৎপাদন বাড়ানোর জোরালো তাগিদ দিয়েছেন।
কৃষিমন্ত্রী বলেছেন, বোরো ধান ঘরে তোলা না গেলে বড় বিপদ আছে। এতো বোঝাবুঝির মাঝেও প্রায় সাড়ে ৯ লাখ হেক্টর জমির পাকা ধান ক্ষেতেই ঝরে পড়ার বিপদ হাওরবাসীর সামনে।
হাওর দুর্যোগপ্রবণ এলাকা। বিশেষ করে বোরো ওঠার প্রাক্কালে পাহাড়ি ঢলে অকাল বন্যা, শিলাবৃষ্টি, কালবৈশাখীর ঝড়-তুফান, অতিবৃষ্টিতে হাওররক্ষা বাঁধ ভাঙা অন্যতম। এর একটিই পারে নিমিষে কৃষকের বোনা স্বপ্ন ভাসিয়ে নিতে। শুধু আগাম বন্যায় প্রায় প্রতিবছরই ক্ষতি হয় সাড়ে ৩ লাখ হেক্টরের মতো জমির ফসল। ইতোমধ্যেই নদীসমূহের পানি বৃদ্ধিতে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরকে তাড়াতাড়ি ধান কাটার তাগিদ দিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। এ সময় দরকার একসাথে বেশি কৃষি শ্রমিক। কিন্তু নতুন মাত্রা নিয়ে যুক্ত হওয়া প্রাণঘাতী করোনা দুর্যোগে কৃষি শ্রমিকের তীব্র সঙ্কট কৃষকের সেই আতঙ্ক আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
কৃষি শ্রমিক নিয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী ও কৃষিমন্ত্রীর আশ্বাস ও বিশ্বাসের দ্বন্দ্বে কৃষক। ধানকাটা শুরু হয়েছে চৈত্রের তৃতীয় সপ্তাহেই। এখনও পর্যন্ত কৃষি শ্রমিকের সঙ্কট কাটেনি। এছাড়া ‘দাওয়াল’ ছাড়াও গোমস্তা বা মুনি, রোজিন্দায় রাখা ও ফসল তোলার প্রাক্কালে রাখা কামলা এমনকি কৃষক নিজেও সামাজিক দূরত্ব নিয়ে করোনায় গৃহবন্দি। অথচ এখনই ধান কাটার উপযুক্ত সময়।
হাওরাঞ্চল ছাড়া উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বোরো আবাদ হলেও মৌসুমের প্রথমেই ধান পাকে হাওরে। এসময় বেকার বসে থাকা কৃষিশ্রমিকরা ওই এলাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ধান কাটতে হাওরে আসে। কিন্তু করোনাভাইরাস সংক্রমণের আশঙ্কায় ও লকডাউন থাকায় কিছু কিছু জায়গায় পৌঁছালেও অধিকাংশ জায়গায় এখনও এসে পৌঁছায়নি। মজুরিও চড়া। দেড়-দুই মণ ধানের মূল্য চলে যাচ্ছে জনে।
স্বাস্থ্যবিধির বাঁধনে স্থানীয় কৃষিশ্রমিকরাও বাঁধা। করোনা ভীতিতে শ্রমিক পাওয়া দুষ্কর হচ্ছে। ফলে অধিকাংশ হাওরের ক্ষেতের পাকাধান ক্ষেতেই মজছে। চৌদ্দ আনা পাকতেই অর্থাৎ দুআনা কাষ্টি থাকতেই ধান কেটে ফেলতে হয়। নতুবা ক্ষেতেই বিনষ্ট হয়। এ দুশ্চিন্তায় কৃষকের চোখে ঘুম নেই। করোনার সাথে বোরো মিশে স্নায়ু চাপে ভুগছে প্রশাসনও।
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে কৃষকরা তাদের ধান ঘরে তুলতে পারছেন না। এমতাবস্থায় আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্দেশ দিয়েছেন কৃষকের পাশে দাঁড়াতে। সরকারদলীয় বিভিন্ন সংগঠন, বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন দেশব্যাপী কৃষকের ধান কেটে দিচ্ছেন।
করোনাভাইরাস মহামারী ঠেকাতে চলমান লকডাউনের মধ্যে শ্রমিক সঙ্কটে পড়া কৃষকের সহযোগিতায় মাঠে নেমে ধান কাটছেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে কৃষকের পাশে দাঁড়ানোর জন্য তারা এই কর্মসূচি নিয়েছেন বলে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় জানিয়েছেন। আর সারা দেশের ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের উৎসাহ দিতে নিজেরাও ধান কাটায় হাত লাগিয়েছেন বলে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য জানিয়েছেন।
যে কোনও ভালো কাজকেই শেষ পর্যন্ত বিতর্কিত করে ছাড়ে কিছু অতিউৎসাহী মানুষ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যেই না ছাত্রলীগের প্রশংসা করলেন ওমনিই কিছু মানুষের গায়ে ফোস্কা পড়ে গেল। তারা জুতো মোজা টাই পড়ে ধান কাটতে নেমে গেলেন। চললো লাগামহীন ফটোসেশন! মুহূর্তেই ভাইরাল হলেন তারা। এবং শেষপর্যন্ত ছাত্রলীগের ছেলেদের এত ভালো কাজটাকে বিতর্কিত করে ছাড়লো।
মূল সমস্যা হলো অতি উৎসাহ আর কমিটমেন্টের অভাব। দলের প্রতি, মানুষের প্রতি।
সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি ভিডিও ভাইরাল হয়। যেখানে দেখা যায়, টাঙ্গাইলের এক সংসদ সদস্য জনৈক ব্যক্তির জমির কাঁচা ধান কাটছেন। এ সময় তার সঙ্গে স্থানীয় কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতাও অংশ নেন। মূলত ধান কাটার চেয়ে ছবি তোলায় ব্যস্ত ছিলেন তারা।
আর এতটাই ব্যস্ত ছিলেন যে, ধান কাঁচা না পাকা সেটাই হয়তো খেয়াল ছিলো না তাদের- এমনটাই মন্তব্য করছেন নেটিজেনরা। ইতোমধ্যে সেই ভিডিওটি ফেসবুকে ভাইরাল হয়ে পড়েছে। আর নেটিজেনদের নানা আলোচনা-সমালোচনার খোরাক জোগাচ্ছে ভিডিওটি।
ধান কাটার নামে চলছে ফটোসেশন; কৃষকের সাথে নির্লজ্জ প্রতারণা এটা। ফেসবুক খুললেই ছবিতে দেখা যায় বিভিন্ন স্থানে রাজনৈতিক দলের নেতা এমপি মন্ত্রীরা বোরো ও ইরি ধান কেটে দিচ্ছেন কৃষকের। তাদের অনেকের পরনে দামি প্যান্ট, ঘড়ি, জুতা ,শার্ট কিংবা টি-শার্ট। একাজে নেমেছেন মহিলা সংরক্ষিত আসনের এমপিরাও।
এক জন নেতা ধান কাটতে গেলে সাথে ১০ জন যাচ্ছেন ছবি তুলতে। কৃষকের ক্ষেতে বসেই মোবাইলে লাইভ দিতে ও ছবি তুলতে গিয়ে নষ্ট করছেন কৃষকের কষ্টার্জিত ফসল। আবার অনেকে কাটছেন কাঁচা ধান। সস্তা বাহবা নেওয়ার জন্য কেউ কেউ সংবাদ মাধ্যমেও এসব ছবি ও নিউজ পাঠাচ্ছেন। সংবাদকর্মীরাও তা প্রচার করছেন। প্রশ্ন হলো তারা কৃষকের জমির কতটুকু ধান কেটেছেন কিংবা মাড়াই করেছেন? এতে কৃষকের আদৌ কোন লাভ হয়েছে কি ?
আধুনিক কৃষির প্রয়োজনীয় প্রায় সব যন্ত্রই দেশের ছোট কৃষক ও বর্গাচাষিদের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। পারলে কৃষকের এই দুরবস্থায় সেচ পাম্প ছাড়াও থ্রেসার, কম্বাইন্ড হারভেস্টারের মতো আধুনিক কৃষি যন্ত্রগুলো যেন বর্গাচাষিসহ প্রকৃত কৃষকের হাতে পৌঁছায় সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। কৃষকের ক্ষেতে শুধু ফটোসেশন না করে তাদের এসব প্রয়োজনীয় জিনিসের ব্যবস্থা করেন।
উদাহরণ হিসেবে মাশরাফি বিন মর্তুজার এমপির কথা বলা যায়। মাশরাফিতো ক্ষেতে যান নি। কিন্তু না গিয়েও কৃষকদের জন্য ধান কাটার মেশিনের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। যাতে কৃষকের সত্যিকারের উপকার হয়েছে। মাশরাফির চেয়েও সামর্থ্যবান এমপি মন্ত্রী আমাদের আছে। তাদের সামর্থ্য আছে কিন্তু মন নেই। সঙ্কটে মানবিক নেতার প্রয়োজনটা বেশি, কাগুজে নেতার চেয়ে।
আচ্ছা বলেনতো, কতজন এমপি মন্ত্রী এলাকায় আছে? করোনা শুরু হওয়ার সাথে সাথেই কোয়ারেন্টাইনে চলে গেছে অধিকাংশ জনপ্রতিনিধি। আর যারা উপস্থিত তারা চুরি চামারিতে অথবা চোরের দালালিতে ব্যস্ত সময় পার করছে। যতদূর জানি দলের হাইকমান্ড থেকে বারবার তাগাদা দিয়েও অনেক এমপিকে এলাকায় পাঠানো সম্ভব হয়নি।
করোনার শুরু থেকেই ছাত্রলীগের ছেলেরা বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে প্রান্তিক মানুষের পাশে ছিল। না তারা কোন প্রচারের ডামাডোল চায়নি। মানুষকে ভালোবেসেই সামর্থ্যের সবটুকু দিয়ে মানুষের পাশে আছে তারা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তার এক ভিডিও কনফারেন্সে ছাত্রলীগের ছেলেদের প্রশংসা করলেন। আর ওমনি পঙ্গপালের মত কিছু ফেইমশিকারী নেতা এমপি মন্ত্রী ঝাপিয়ে পড়লো কৃষকের ধান ক্ষেতে। কাঁচা ধান, পাকা ধান কিছুই রেহাই পেল না তাদের ফটোসেশনের বাহারে!
লেখক: সম্পাদক, বিবার্তা২৪ডটনেট