আবু আলম: গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে ৪ হাজার ৯৬৮ জনের করোনা পরীক্ষা করা হয়। গত ২৪ ঘণ্টায় করোনাভাইরাসে সংক্রমিত রোগী এবং মৃত মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে ৮ জন মারা গেছেন। দেশে মোট মারা গেছেন ১৬৩ জন। দেশে নতুন করে করোনাভাইরাসে সংক্রমিত ব্যক্তি শনাক্ত হয়েছেন ৬৪১ জন। এর মধ্য দিয়ে দেশে করোনা শনাক্তের সংখ্যা ৭ হাজার ছাড়াল। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ব্রিফিংয়ের তথ্য অনুযায়ী, মোট শনাক্তের সংখ্যা ৭ হাজার ১০৩।
বাংলাদেশে করোনাভাইরাস নামের বৈশ্বিক মহামারিটির প্রথম সংক্রমণ আমরা টের পেয়েছি ৫৩ দিন আগে গেল ৮ মার্চ, ২০২০। বৈশ্বিক মহামারি হিসেবে ঘোষণার আগে থেকেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা রোগ শনাক্তকরণ পরীক্ষা, পরীক্ষা আর পরীক্ষার উপর জোর দিয়ে আসছে। সংস্থাটি বার বার বলেছে, চিকিৎসা ও সংক্রমণ প্রতিরোধে রোগ শনাক্ত হওয়া দরকার।
২৯ এপ্রিল দুপুর পর্যন্ত বাংলাদেশে সব মিলিয়ে পরীক্ষা করা হয়েছে ৫৯ হাজার ৭০১ জনকে। পাকিস্তানে করা হয়েছে ১ লাখ ৬৫ হাজার ৯১১ জনের। ভারতে ২৮৮টি সরকারি পরীক্ষগার এবং ৯৭টি বেসরকারি পরীক্ষাগারে প্রতিদিন প্রায় ৬০,০০০ পরীক্ষা করা হচ্ছে। ভারতের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ২৯ এপ্রিল বলেছেন, আগামী কয়েকদিনের মধ্যে সেটা এক লাখে নেওয়া হবে। ভারতে ৬ লাখ ৬৫ হাজার পরীক্ষা করা হয়েছে।
জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে রোগ শনাক্তকরণ পরীক্ষা শুরু করেছিল আইইডিসিআর। ২৯ মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশ করে ১ হাজার ১৮৫টি টেস্ট আর পাকিস্তান করে ১৪ হাজার ৩৩৬টি টেস্ট, ভারত করে ২৭ হাজার ৬৮৮টি।
তখন স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক বলেন, সুরক্ষার ব্যবস্থা না থাকলে ল্যাবরেটরির মাধ্যমে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকায় যন্ত্র থাকলেও সবাইকে পরীক্ষার অনুমতি দেওয়া হবে না। সেই সময়েও আইইডিসিআর ছাড়াও আরও অন্তত দুটি প্রতিষ্ঠানের মানসম্পন্ন ল্যাব ছিল। অবশ্য এখন ২৫টি ল্যাবে পরীক্ষা হচ্ছে। আরও ৫টি ল্যাব পরীক্ষা শুরু করবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনটি বিভাগ যুক্ত হলে পরীক্ষার আওতা বেড়ে যাবে। স্বাস্থ্য বিভাগের লক্ষ্যমাত্রা দিনে পাঁচ হাজার নমুনা পরীক্ষা করা। কিন্তু বড় বেশি দেরি হয়ে গেল। আমরা বেশ পিছিয়ে করোনা শনাক্তকরণ পরীক্ষায়। তাই হয়তো আমাদের রোগীর সংখ্যা কম। মানুষের সন্দেহ বাড়ছে, চিন্তিত হয়ে পড়ছে মানুষ।
পত্র-পত্রিকা, টেলিভিশন আর সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য-উপাত্ত থেকে জানা যাচ্ছে- অনেকেই নানা ভাবে চেষ্টা করেও করোনা শনাক্তকরণ পরীক্ষা করাতে পারছেন না। পরীক্ষা করাতে পারার পরেও কেউ কেউ ফলাফল জানতে পারছেন না। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) দেওয়া ফোনে যোগাযোগ করার পর নমুনা সংগ্রহের জন্য যাওয়ার কথা বললেও আইইডিসিআরের পক্ষে কেউ ৩/৪ দিনেও যাচ্ছেন না। গেল সপ্তাহে মিরপুর ১১-এর একটি পরিবারের একজন নারী সদস্য করোনার উপসর্গ নিয়ে মারা যান। ওই পরিবারের একাধিক সদস্য এখনো জ্বরে ভুগছেন। আইইডিসিআরের সঙ্গে তাঁরা যোগাযোগ করেও কোনো পরীক্ষা করাতে পারেননি। এমন ধারণা মানুষের মনে ঠাই নিয়েছ- তদ্বির না করলে IEDCR থেকে সহজে নমুনা সংগ্রহ করতে আসে না কেউ। ১০ দিনের মধ্যে নেই আছে নেই- তিন রকম ফলাফল আসছে। ডাক্তার আত্মীয়ের সহযোগিতায় অসুস্থ অবস্থায় দু’দুবার করোনা টেস্ট করা হয় সিটি ব্যাংক কর্মকর্তা মুজতবা শাহরিয়ারের। আসে নেগেটিভ রিপোর্ট। বাসায় ছিলেন। অবস্থার অবনতি হলে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে এক দিনের মাথায় মারা যান। মৃত্যু পরবর্তী টেস্টে তার রিপোর্ট এসেছে করোনা পজিটিভ।
তিন দিন ধরে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) কাছে ঘুরেও করোনা টেস্ট করাতে পারেননি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিষয়ক উপদেষ্টা খন্দকার মিল্লাতুল ইসলাম। মৃত্যুর পরও এই কর্মকর্তার নমুনা নিতে আসেনি করোনা নিয়ন্ত্রণে কাজ করা সরকারের গুরুত্বপূর্ণ এই প্রতিষ্ঠান। সর্বশেষ দাফনের ঠিক আগ মুহূর্তে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য পাঠায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। পরে তার করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি ধরা পড়ে। ডিএসসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. মো. শরীফ আহমেদ সাহেব পর্যন্ত আইইডিসিআর প্রধানের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা করেছেন। কিন্তু টেস্ট করাতে পারেননি খন্দকার মিল্লাতুল ইসলামের। প্রশ্ন উঠেছে সাধারণ নাগরিকদের ক্ষেত্রে তাহলে কী হচ্ছে? পরীক্ষার জন্য নমুনা দিতে না পারার এ রকম উদাহরণ আরও আছে।
অন্যদিকে নমুনা দিয়েছেন, কিন্তু ফলাফল জানতে পারছেন না, এমন উদাহরণ আছে অনেক। রাজধানীর হাতিরপুল ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের একটি বাসা থেকে ১৪ এপ্রিল এক ব্যক্তির নমুনা সংগ্রহ করেন আইইডিসিআরের টেকনোলজিস্টরা। নমুনা সংগ্রহের পর তাঁকে একটি পরিচিতি নম্বর (আইডি–৬০৯৯) দেওয়া হয় এবং বলা হয়, দু-এক দিনের মধ্যে ফলাফল জানানো হবে। ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত তাঁকে ফলাফল জানায়নি আইইডিসিআর।
কোভিড সংক্রমণ প্রতিরোধের কাজ এগিয়ে নেয়ার জন্য পরীক্ষা আর পরীক্ষার ফল জানা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মরার উপর খাড়ার ঘায়ের মত নমুনা সংগ্রহ, নমুনা পাত্রজাত করা এবং নমুনা পাঠানোর ক্ষেত্রে ত্রুটি থাকছে। মাঠপর্যায়ে পর্যাপ্তসংখ্যক টেকনোলজিস্ট নেই।
বাংলাদেশ মেডিকেল টেকনোলজিস্ট অ্যাসোসিয়েশন জানিয়েছে, ১০ বছর ধরে টেকনোলজিস্ট নিয়োগ বন্ধ রেখেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদফতর। আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক মীরজাদী সেব্রিনা গণমাধ্যমকে বলেছেন, কাজের চাপের কারণে কিছু সমস্যা হচ্ছে। কিছু ক্ষেত্রে নমুনা সংগ্রহের বা সনদ তৈরির সময় ব্যক্তির তথ্যে ভুল হয়ে যায় তখন যোগাযোগে সমস্যা হয়।
জানা গেছে, কয়েকটি ল্যাবরেটরিতে হাজারের বেশি নমুনার স্তূপ জমেছে। অথচ কোভিড-১৯ রোগী এবং কোভিড রোগী নন এমন মানুষের জন্য পরীক্ষা ও পরীক্ষার ফলাফল পাওয়া অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। কোভিড পরীক্ষার সনদ ছাড়া অন্য রোগীদেরও ভর্তি না করে হাসপাতাল থেকে ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
সাধারণ জ্বর, কাশি আর শ্বাসকষ্ট হলেই হাসপাতালের দরজায় ঘুরতে ঘুরতে মরে যাচ্ছে রোগী। কোভিড রোগীদের জন্য নির্ধারিত হাসপাতাল কোভিড পজিটিভ সনদ না পেলে ভর্তি করছে না। বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের একসাথে পাওয়া যাছে না। কেউ কেউ ছুটিতে, কেউ কেউ হাসপাতালে আসেন না, কেউবা ২/৩ দিনে একবার আসেন। জনমনে বিরূপ প্রভাব ফেলছে এসব খবর। ধারণা করা হচ্ছে, পরীক্ষা কম হওয়ায় ভেঙ্গে পড়ছে গোটা স্বাস্থ্য ব্যবস্থা।
সিদ্ধান্তহীনতা, সমন্বয়হীনতা, দূরদৃষ্টি আর সঠিক পরিকল্পনা না থাকায় করোনার পরীক্ষা নিয়ে এমন হ-য-ব-র-ল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদফতর, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সমস্যার বিশালতা অনুধাবন করতে পারেনি। দেরিতে পরীক্ষা সম্প্রসারণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তারা নমুনা সংগ্রহের পদ্ধতি এবং পরীক্ষার গাইডলাইন তৈরি করেনি সময়মত। আগামী পাঁচ দিন ৫ হাজার করে টেস্ট করা হলে যোগ হবে আরও ২৫ হাজার। পরীক্ষার আওতায় আসবে ৮৫ হাজার জন। সেটা কি যথেষ্ট? এরই মধ্যে খুলে গেছে পোশাক শিল্প, লকডাউনের লক নেই, খুলছে হোটেল রেস্তোরা। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকানোর জন্য পাঁচ দফায় সরকারি-বেসরকারি অফিসে সাধারণ ছুটির মেয়াদ সাপ্তাহিক ছুটি মিলিয়ে ৫ মে পর্যন্ত। তারপর কি!
(ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)