সাইফুল ইসলাম, টাঙ্গাইল প্রতিনিধি: টাঙ্গাইল জেলার সদর উপজেলার কাকুয়া ইউনিয়নের সহস্রাধিক তাঁত শ্রমিক পেটের দায়ে লকডাউন ভেঙে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন। আর গ্রামটির প্রায় ৬০০ জন নারী আর ৯০০ জন পুরুষ তাঁত শ্রমিক এখনও পাননি কোনো সহায়তা। আর এ কারণে বাধ্য হয়ে ভোর থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত তাঁতে কাপড় বুনছেন শ্রমিকরা। তবে, এরপর সারাদিন তারা লকডাউন পালন করছেন।
করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে গত ২৬ মার্চ সাধারণ ছুটি ঘোষণার পাশাপাশি সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে সরকারি নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। আর ওই নির্দেশনায় সকল শিল্প-কারখানা বন্ধ ঘোষণাও করা হয়েছে। আর এতে সদর উপজেলার কাকুয়া ইউনিয়নের প্রায় দেড় হাজার তাঁত শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছেন। এতে তাদের যৎসামান্য জমানো টাকা ঘরে ১০-১৫ দিনের ছিল খাবার। আর তাই দিয়ে কিছুদিন চলার পর তারা তাঁত মালিকদের হাতে-পায়ে ধরে মজুরির আশায় কাপড় বুনছেন। কিন্তু তারা এ পর্যন্ত সরকারি-বেসরকারি কোনো অনুদান, ত্রাণ বা খাদ্য সহায়তা পাননি। এছাড়াও এই চরপৌলী গ্রামে প্রায় দেড় হাজার তাঁত শ্রমিক রয়েছে।
এদিকে প্রতক্ষভাবে দেখা যায় যে, “কাকুয়া ইউনিয়নের মধ্যে শুধুমাত্র চরপৌলী গ্রামেই তাঁত শিল্প রয়েছে। আর ইউনিয়নের একমাত্র প্রাথমিক তাঁতী সমিতিও চরপৌলী গ্রামে অবস্থিত। এছাড়াও কিছু তাঁত মালিক রয়েছেন যারা সমিতির সদস্য নন। কিন্তু তাদের অধিকাংশই পাওয়ার লুমের মালিক।”
আর এ সময় স্থানীয় ইউপি সদস্য, তাঁত শ্রমিক, মালিক ও প্রাথমিক তাঁতী সমিতির সভাপতি জানিয়েছেন, “চরপৌলী গ্রামে প্রায় দেড় হাজার তাঁত শ্রমিক রয়েছে। এদের মধ্যে প্রায় ৯০০ পুরুষ ও ৬০০ নারী। করোনা ভাইরাসের কারণে এলাকা লকডাউন ঘোষণা করা হলেও এখন পর্যন্ত ওই এলাকায় সরকারি-বেসরকারি কোনো খাদ্য সহায়তা আসেনি। আর খাদ্য সহায়তা না পেয়ে এলাকার প্রায় সাড়ে ৬০০ পুরুষ ও সাড়ে চারশ নারী তাঁত শ্রমিক কাজের সন্ধানে লকডাউন ভাঙতে বাধ্য হচ্ছেন। এতে তাঁত মালিকরাও বেঁচে থাকার তাগিদে তাদেরকে কাজ দিচ্ছেন। ফলে সরকার নির্দেশিত সামাজিক দূরত্ব এক প্রকার ভুলুণ্ঠিত হচ্ছে।”
কাকুয়া ইউনিয়নের চরপৌলী গ্রামের তাঁত শ্রমিক আনোয়ার, মনির, ওমরসানী, আব্দুর রশিদসহ অনেকেই জানিয়েছেন,”তাদের ঘরে যে খাবার ও জমানো টাকা ছিল লকডাউনের ফলে তা শেষ হয়েছে। এতে তারা কোনো প্রকার ত্রাণ বা খাদ্য সহায়তা পাননি। বাড়িতে স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে ও মা-বাবা রয়েছেন। আর তাই কারখানা মালিকের হাতে-পায়ে ধরে তাঁতে কাপড় বুনতে এসেছেন। এতে মজুরি পেলে তারা বাড়ির জন্য খাবার কিনবেন।”
স্থানীয় তাঁত মালিক শাহজামাল, সোলেমান, রওশন আলী, আইয়ুব আলীসহ অনেকেই জানিয়েছেন, “সরকারি নির্দেশনা মেনে তারাও লকডাউনে আছেন। তবে তাদের ঘরে কিছু ভেজা সুতা ও কাঁচামাল রয়েছে। আর সেগুলো ব্যবহার না করলে নষ্ট হয়ে যাবে। অন্যদিকে শ্রমিকদের খাবার ফুরিয়ে যাওয়ায় তারা কাজ করতে আসছে। এতে শ্রমিকদের জীবন-জীবিকার কথা ভেবে ও কাঁচামালগুলো যাতে নষ্ট না হয় সেজন্য প্রতিদিন ভোর থেকে সকাল ১১টা পর্যন্ত কাজ করার সুযোগ করে দিয়েছেন। এছাড়াও অন্য সময়ে তারা সামাজিক দূরত্ব মেনে ঘরে থাকছেন।”
কাকুয়া ইউনিয়ন প্রাথমিক তাঁতী সমিতির সভাপতি মো. শামসুল আলম বলেছেন, “তাদের এলাকার প্রায় দেড় হাজার তাঁত শ্রমিকের ঘরে খাবার নেই। আর অপেক্ষাকৃত দরিদ্রদের তালিকা করে তিনি তাঁত বোর্ডের বেসিক সেন্টারে জমা দিয়েছেন। তবে এখনও কোনো সহায়তা পাননি তারা।খাবার না পাওয়ায় লকডাউন বা সামাজিক দূরত্বের বিষয়টি শ্রমিকরা মানতে পারছে না। এতে শ্রমিকরা মূলত পেটের দায়ে তাঁতে কাপড় বুনছেন।”
কাকুয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ জানিয়েছেন, ” তার ইউনিয়নের চরপৌলী গ্রামটি সবচেয়ে বড় ও তাঁত অধ্যুষিত এলাকা। কিন্তু নদীভাঙা এলাকা হওয়ায় রাষ্ট্রীয় অধিকাংশ সুবিধা থেকে বঞ্চিত তারা। আর এ পর্যন্ত তিনি উপজেলা পরিষদ থেকে ১০০ প্যাকেট খাদ্য সহায়তা পেয়ে কর্মহীন মানুষের মাঝে বিতরণের জন্য ইউপি সদস্যদের দিয়েছেন।তাঁত শ্রমিকরা খাদ্য সহায়তা না পেয়েই মূলত টুকটাক কাজ করছেন।”
আর এ প্রসঙ্গে তাঁত বোর্ডের টাঙ্গাইল বেসিক সেন্টারের লিয়াজোঁ অফিসার মো. রবিউল ইসলাম জানিয়েছেন, “চরপৌলী এলাকার কর্মহীন তাঁত শ্রমিকদের তালিকা করে তিনি সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কাছে জমা দিয়েছেন। আর অচিরেই ওই এলাকার তাঁত শ্রমিকরা খাদ্য সহায়তা পাবেন।”