ঢাকা:আমাদের অর্থনীতিতে করোনার অভিঘাত খুবই গুরুতর হবে। সোয়া কোটি থেকে দেড় কোটি লোক ইতোমধ্যে বেকার হয়ে গেছে। ক্ষতির মুখে পড়েছেন তাদের পরিবারের সদস্যসহ পাঁচ কোটি মানুষ। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো মানুষকে খাওয়ানো। পাশাপাশি দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ করোনা পরিস্থিতিকে অর্থাৎ এই রোগকে সামাল দেয়া। এই দুটোই তাৎক্ষণিক চ্যালেঞ্জ, এর পর অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধারের পদক্ষেপ নিতে হবে।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর নয়া দিগন্তের সাথে একান্ত সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেন।
তিনি আরো বলেন, করোনার কারণে দেশের অর্থনীতিতে যে ধাক্কা এসেছে, তার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে বড় ধরনের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন হবে। বাজেটে সহায়তা লাগবে। এক বা দেড় মাস পরে অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধারের কাজ শুরু করা হবে বড় চ্যালেঞ্জ। প্রতিটি খাতকে ধীরে ধীরে খুলতে হবে। করোনা তো চলে যাবে না। তাই করোনাকে সাথে নিয়েই কিভাবে কাজ করতে পারব সে ধরনের হেলপ গাইডলাইন মেনে চলে, রোগকে নিয়ন্ত্রণে রেখে, আমাদের অর্থনীতির কাজ-কর্মকে চালিয়ে যেতে হবে- চীন যেভাবে শুরু করেছে।
নিচে তার সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হলো।
কোভিড-১৯ এর প্রাদুর্ভাবে সমগ্র বিশ্বে অচলাবস্থা চলছে। আমাদের অর্থনীতিতে এর অভিঘাত কতটা গুরুতর হবে বলে আপনি মনে করেন?
আহসান এইচ মনসুর : আমাদের অর্থনীতিতে করোনার অভিঘাত খুবই গুরুতর হবে। সোয়া কোটি থেকে দেড় কোটি লোক ইতোমধ্যে বেকার হয়ে গেছে। ক্ষতির মুখে পড়েছেন তাদের পরিবারের সদস্যসহ পাঁচ কোটি মানুষ। তাদের সহায়তার ব্যবস্থা সরকারকে করতে হবে। এটা একটা বিরাট ধরনের চ্যালেঞ্জ। এখানে আমাদের অভিঘাত দু’দিক থেকে এসেছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তৈরী পোশাক খাত (গার্মেন্ট) এবং রফতানি খাত থেকে এসেছে। রেমিট্যান্স থেকে এসেছে। আর অভ্যন্তরীণ খাত তো আছেই। আগে সরবরাহ সঙ্কট বাইরে বা ভেতর থেকে হতো। হয়তো সাইক্লোন হলো বা বন্যা হলো। তখন তা একটা খাতের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু এখন করোনার কারণে সবগুলো খাতই একসাথে আক্রান্ত হয়েছে। কাজেই এত বড় অভিঘাত আমরা আগে পাইনি। এমনকি পৃথিবীর অন্যান্য দেশও পায়নি। ফলে সবার জন্য এটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ।
এখন করোনা প্রতিরোধে ভালো ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কৃষি খাতকে সচল রাখতে হবে। সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে কৃষি উৎপাদন ও তার সরবরাহব্যবস্থা টিকিয়ে রাখা দরকার। সেবা খাতের মধ্যে প্রাইভেট চিকিৎসাব্যবস্থা করোনায় বরং আয় বাড়াতে পারত। কিন্তু সঠিক ব্যবস্থাপনা ও নীতির অভাবে এই খাতটিও প্রায় বসে গেছে। বাংলাদেশ হয়তো কম ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষতি অর্থনীতির ৪০ ভাগ হলে বাংলাদেশের কমপক্ষে ২০ ভাগ ক্ষতি হবে।
সঙ্কটের কারণে প্রবাসে কর্মরত বাংলাদেশীরা ফেরত আসছেন ও সামনে আরো আসবেন বলে মনে হচ্ছে। এতে আমাদের বেকারত্ব বাড়বে। এটা সামাল দিতে কী করতে হবে বলে আপনি মনে করেন?
আহসান এইচ মনসুর : বেকারত্ব বাড়ছে, আরো বাড়বে। করোনার মহামারীতে অনেক দেশে চাকরির চাহিদা কমে যাবে, যা বাংলাদেশের বিদেশী শ্রমবাজারে আরো বড় আঘাত হানবে। ফলে প্রবাসী আয়ে বড় ধাক্কা আসবেই। এটা সামাল দেয়া যাবে না। এর জন্য সরকারকে একটা রিকভারি কৌশল নিতে হবে। করোনা-পরবর্তী সময়ে রিকভারি যেন তাড়াতাড়ি হয় সে জন্য সরকার কিছু প্যাকেজ দিয়েছে। সেগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে হবে কার্যকারিতা কতখানি হলো। সেগুলো আরো বাড়াতে হবে কি না? সরকারকে ব্যাপক আকারে অর্থনীতি পুনর্গঠন করতে হবে, যাতে বিনিয়োগ আমাদের দেশে দ্রুত আসতে পারে। এ জন্য সরকারকে শক্তিশালী পদক্ষেপও নিতে হবে। আমাদের দেশের ইপিজেডগুলোকে খুব তাড়াতাড়ি গড়ে তুলতে হবে। কারণ এটা কর্মসংস্থানের জন্য বড় একটা সুযোগ সৃষ্টি করছে। আর কোম্পানিগুলো চীন থেকে সরে এসেছে। এ জন্য বাংলাদেশ যেন প্রস্তুত থাকে। ইপিজেডগুলোকে এখনো রেডি করা যায়নি। রিমোট এলাকাগুলোতে শ্রমিকদের দিয়ে এখনো কাজ করাতে পারে। তারা সেখানেই থাকবেন, সেখানেই খাবেন। বন্ধ রাখার কোনো দরকার নেই।
করোনা-পরবর্তী বাংলাদেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ কী কী হতে পারে?
আহসান এইচ মনসুর : সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো মানুষকে খাওয়ানো। পাশাপাশি দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ করোনা পরিস্থিতিকে অর্থাৎ এই রোগকে সামাল দেয়া। এই দুটো হলো তাৎক্ষণিক চ্যালেঞ্জ। তারপরে হলো অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার করা। এটা হয়তো এক বা দেড় মাস পরে। প্রতিটি খাতকে ধীরে ধীরে খুলতে হবে। করোনা তো চলে যাবে না। তাই করোনাকে সাথে নিয়েই কিভাবে কাজ করতে পারব সে ধরনের হেলপ গাইডলাইন মেনে চলে, রোগকে নিয়ন্ত্রণে রেখে, আমাদের অর্থনীতির কাজ-কর্মকে চালিয়ে যেতে হবে। চীন যেভাবে করছে। চীন থেকে তো করোনা চলে যায়নি। তারা তো কাজ শুরু করে দিয়েছে। তাদের থেকে আমাদেরকে শিক্ষা নিতে হবে। করোনার কারণে দেশের অর্থনীতিতে যে ধাক্কা এসেছে বা আসবে, তার জন্য সরকারের দিক থেকে বড় ধরনের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন হবে। বাজেটে সহায়তা লাগবে। এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ব্যাংককেও বড় ভূমিকা নিতে হবে।
নতুন অর্থবছরের বাজেট আসছে। এ ক্ষেত্রে বাজেট তৈরিতে সরকারকে কী কী পদক্ষেপ ও দৃষ্টিভঙ্গি রাখতে হবে বলে আপনি মনে করেন?
আহসান এইচ মনসুর : বাজেট নিয়ে চিন্তা-ভাবনা না করে করোনা পরিস্থিতিকে সামাল দেয়াতেই সরকারকে বেশি অগ্রাধিকার দিতে হবে। বাজেট আপাতত ছয় মাসের জন্য মুলতবি বা স্থগিত রাখা উচিত। তবে করোনাকে কেন্দ্র করে স্বল্প সময়ের জন্য একটা বাজেট করা যেতে পারে। যার মূল ফোকাস হবে করোনা পরিস্থিতিতে সহায়তা করা, যা আছে তাই থাকল। নতুন কোনো প্রকল্প দরকার,নেই। যা আছে বর্তমানে সেগুলোকে শেষ করা হোক। করোনা ও অর্থনীতি পুনরুদ্ধার সংশ্লিষ্ট একটা বাজেট করা যেতে পারে।
সরকারের ঘোষিত প্রণোদনা কতটা বাস্তবসম্মত? এর সঠিক ব্যবহার হবে কি না তা নিয়ে অনেকে সংশয় প্রকাশ করছেন। সামাজিক সুরক্ষায় সরকারের বরাদ্দ সঠিকভাবে মানুষ পাবে বলে কি আপনি মনে করেন?
আহসান এইচ মনসুর : চাহিদার তুলনায় এটি খুবই কম। এখানে দুর্নীতিও হচ্ছে। আমরা যা বলব সরকারের উচিত ছিল, সরাসরি নগদ সহায়তার দিকে চলে যাওয়া। মানে পাকিস্তান যেভাবে করেছে। বেশ কিছু প্রণোদনা সরকারের ভালো উদ্যোগ। তবে খেয়াল রাখতে হবে, প্রকৃত নিম্ন আয়ের লোকজন যেন এই ঋণসুবিধা পায়। অনেক সময় দেখা যায় ভালো ও অবস্থাসম্পন্ন মানুষ ঋণ নিয়ে নেয়। সরকারের উচিত হবে এনজিওগুলোর ওপর কঠোর নজরদারি রাখা।
ব্যাংকিং খাতের মাধ্যমেই এই প্রণোদনা বাস্তবায়ন করা হবে, এটা বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু ব্যাংকিং খাতের তারল্য পরিস্থিতি ভালো নেই। নিজস্ব তহবিল দিয়ে এই উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা ব্যাংকগুলোর পক্ষে কঠিন। আবার সতর্ক থাকতে হবে যে রাঘববোয়ালরা যেন প্রণোদনার এই টাকা খেয়ে না ফেলে। কারণ, সরকারের উদ্যোগটি ব্যবসায়ীদের জন্য সত্যিই লোভনীয়।
সঙ্কট থেকে উত্তরণে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা সহায়তার কথা বলেছে। বাংলাদেশ কিভাবে তা থেকে লাভবান হতে পারে?
আহসান এইচ মনসুর : বাংলাদেশকে তো টাকা নিতে হবেই। এই জরুরি পরিস্থিতিতে যেখানেই পাওয়া যায় সবই ব্যবহার করা উচিত বলে আমি মনে করি। আমাদের স্বাস্থ্য খাতে সংস্কার দরকার, রাজস্ব খাতে সংস্কার দরকার। তারা যদি এসব করতে বলে করুক। অসুবিধার কী আছে।
সময় দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন
আহসান এইচ মনসুর : আপনাকেও ধন্যবাদ। আপনিও ভালো থাকবেন।
দৈনিক নয়াদিগন্ত অবলম্বনে