ঢাকা: পরিচয় বলতে টকশোতে। স্পষ্ট কথা বলতেন। ডাকসাইটে আমলা ছিলেন। এই অভিধাটিও মানুষটির জন্য অল্প। তিনি ভয় পেতেন না। তোয়াক্কা করতেন না নেপথ্যের। বিবেক দিয়ে বুঝতে চাইতেন। যুঝতেন যুক্তি আর নীতির সঙ্গে।
বিতর্ক করতেন। প্রশাসনিক বিধিমালার অসাধারণ ব্যাখ্যা করতেন। ২০০২-২০০৫ এ সময়কালে মন্ত্রিপরিষদ সচিব ছিলেন। ২০০৭ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত ছিলেন পিএসসির চেয়ারম্যান। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে অনেকেই আমলা ছিলেন, আছেন, হবেন। এটাই রীতি। কিন্তু একজন সা’দত হুসাইন কেন ব্যতিক্রম? সচিবালয়ের অন্দরমহলে রন্ধ্রে রন্ধ্রে যাতায়াত আছে এমন ক’জনের সঙ্গে কথা বলে জানার চেষ্টা করেছি নেপথ্যের সা’দত হুসাইনকে।
১. যে কজন আমলা স্বাধীনতার চেতনাকে সরকারি চাকরি ক্ষেত্রে প্রতিষ্টা করেছেন তাদের মধ্যে সা’দত হুসাইন অন্যতম। চাকরির শেষ সময় পর্যন্ত এ বিষয়ে তিনি কোনও আপোষ করেননি।
২. খালেদা জিয়ার দ্বিতীয় জমানায় তিনি কেবিনেট সেক্রেটারি ছিলেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় পিএসসি’র চেয়ারম্যান হন। কিন্তু সরকার বদল হলে আওয়ামী লীগ জমানায় পিএসসি থেকে তিনি পদত্যাগ করতে চেয়েছিলেন বিতর্ক হতে পারে এমন চিন্তায়। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে তার দায়িত্ব পালন করে যেতে বলেছিলেন।
৩. পিএসসি’র চেয়ারম্যান থাকাকালীন প্রতিষ্ঠানটিকে আমুল বদলে দিয়েছিলেন। তার সময়ে কোনরকম দলীয়করণের অভিযোগ নেই। সকল পরীক্ষা সময়ানুযায়ী অনুষ্টিত হয়েছিল। বিতর্কিত ২৭তম বিসিএস পরীক্ষা তিনি নতুন করে নিয়ে বিতর্কের অবসান করেছিলেন। বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার এনেছিলেন সরকারি নিয়োগের ক্ষেত্রে।
৪. সা’দত হুসাইন ছিলেন অসম্ভব সময়ানুবর্তি। কখনও তিনি সময়ের এদিক ওদিক হননি। প্রয়োজনে গভীর রাত পর্যন্ত অফিস করেছেন। কিন্তু নয়টা, পাঁচটার হেরফের হয়নি। অফিস কলিগরা যোগদানের অল্পদিনের মধ্যেই জেনে গিয়েছিলেন, স্যার, নয়টা মানে নয়টাতেই আসবেন। নয়টা একমিনিটেও নয়।
৫. নিয়ম নীতির প্রতি ছিলেন অসম্ভব শ্রদ্ধাশীল। প্রশাসনিক বিধিমালার অুনসরণ করতেন। নিয়মের মধ্য থেকে প্রতিষ্ঠানকে একটি সুনির্দিষ্ট ‘সিস্টেমে’ এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অনন্য।
৬. যে কোন মিটিং-এ অংশ নেয়ার আগে তিনি তার আদ্যপান্ত জেনে এবং পড়াশোনা করে বসতেন। তা সহকর্মীদের সঙ্গে হোক বা মন্ত্রীসভার বৈঠক হোক। পর্যাপ্ত পড়াশোনা ছাড়া তিনি কোনও মিটিং-এ অংশ নিয়েছেন এমনটি কখনও হয়নি। তিনি তার জুনিয়র সহকারীদের প্রায়ই ভৎর্সনা করতেন পর্যাপ্ত পড়াশোনা না করে মিটিং-এ অংশ নিলে। একসময় কর্মকর্তারাও টের পেয়ে যান সা’দত হুসাইন থাকলে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের বিস্তারিত জেনে কথা বলতে হবে।
৭. তিনি কতটা দক্ষ আমলা ছিলেন তার একটি দৃষ্টান্ত দিলে স্পষ্ট হবে। ২০০৫ সালে চাকরি থেকে অবসরে যাওয়ার আগে তিনি সরকারি বেহাত হওয়া জমি বাঁচাতে সকল সচিবদের নিয়ে একটি কমিটি করেন। এই কমিটি প্রতি মাসে কতগুলো জমি উদ্ধার হয়েছে আর কতগুলো দখল বা লিজের নামে বিক্রি হয়ে গেছে তার হিসাব প্রকাশ করত। তার ভিত্তিতে পরের অ্যাকশন কার্যক্রম নির্ধারণ করা হতো। এভাবেই সরকারি সম্পত্তি রক্ষায় তিনি কার্যকর ভূমিকা রেখেছিলেন।
৮. চাকরি জীবনের শেষ পর্যন্ত তিনি সরকারি বল্গাহীন খরচ নিয়ন্ত্রণ করেছেন। যে প্রতিষ্টানের দরকার নেই তা গুটাতে চেয়েছিলেন আর যে প্রতিষ্টানের দরকার আছে দেশের স্বার্থে সেখানে জনবল বাড়িয়েছেন।
উপরে বর্ণিত কথাগুলোর মিল পাওয়া যায় অপর সাবেক আমলা আবু আলম শহীদ খানের ফেসবুক স্ট্যাটাসেও। তিনি লিখেছেন, চাকরিতে যোগ দেবার প্রথম দিকেই তাঁর সাথে পরিচয় হয় বিসিএস প্রশাসন এসোসিয়েশনের সভায়। তিনি একটি সাব-কমিটির সদস্য ছিলেন। আমি সেই সাব-কমিটির কনিষ্ঠতম সদস্য। তারপরেও তিনি আমাকেই মাঝেমাঝে ডেকে নিতেন কাগজপত্তর তৈরি করার জন্য। ঘড়ি ধরে হাজিরা দিতে হতো। এক মিনিটের বিলম্ব তাঁর কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল না। পরে আরো বহুবার তার সাথে নানা কাজে সংশ্লিষ্ট থেকেছি। তিনি যে কোনও কাজের সেরাটা চাইতেন। নিজেও অংশগ্রহণ করতেন সব কাজে।
ড. সা’দত হুসাইন যা করতেন পুরোটা উপলব্ধি দিয়ে করতেন। সমস্যার সমাধানে সর্বোচ্চ আন্তরিকতা নিয়ে কাজ করতেন। এমন দক্ষ আমলা সত্যিই বিরল।
কিছু মৃত্যু সত্যিই থমকে দেয়। ভাবায়। একজন সা’দত হুসাইনের চলে যাওয়া তেমনি। শেষ করতে চাই সা’দত হুসাইনের একটি কথা দিয়েই, ‘কিছু করতে হলে আগে নিজেকে বদলাতে হবে। যতোক্ষণ তুমি নিজে বদলাবে না ততোক্ষণ তুমি অন্যকেও বদলে যেতে সাহায্য করতে পারো না।’