তীব্র সঙ্কটে পোশাকশিল্প

Slider অর্থ ও বাণিজ্য জাতীয় সারাদেশ


ঢাকা: করোনার প্রাদুর্ভাবের আগেই রফতানি ধারাবাহিকভাবে কমছিল। বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস দেখা দেয়ার পর বাতিল হয়ে যায় কোটি কোটি ডলারের রফতানি আদেশ। ক্রয়াদেশ না থাকার পাশাপাশি সরকারি নির্দেশে বর্তমানে বেশির ভাগ কারখানাতেই উৎপাদন বন্ধ। স্বাভাবিক অবস্থায়ই যারা শ্রমিকদের বেতন নিয়মিত দিতে পারছিলেন না তাদের অবস্থা এখন আরো বিপর্যস্ত। স্বাভাবিক কারণেই চাকরি হারাচ্ছেন অনেক শ্রমিক। ফলে বাড়ছে শ্রমিক অসন্তোষ। লকডাউন ভেঙে শ্রমিক অধ্যুষিত এলাকাগুলোয় ছড়িয়ে পড়ছে বিক্ষোভ। এসব কারণে চতুর্মুখী সঙ্কটে পড়েছে দেশের রফতানি আয়ের ৮৪ শতাংশ অবদান রাখা তৈরী পোশাকশিল্প।

রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, সদ্যবিদায়ী মার্চ মাসে দেশ থেকে সর্বমোট ১৯৭ কোটি ২২ লাখ ডলারের তৈরী পোশাক রফতানি হয়েছে, যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে ২৬ দশমিক ৭০ শতাংশ কম। ২০১৯ সালের মার্চে ২৬৯ কোটি ডলারের পোশাক রফতানি হয়েছিল। আর বিজিএমইএ সূত্রে জানা যায়, চলতি মাসের প্রথম ১৫ দিনে ১৯ কোটি ৪০ লাখ ডলারের পোশাক রফতানি করেছে বাংলাদেশ। গত বছরের একই সময়ের তুলনায় তা ৮৩ দশমিক ৭৪ শতাংশ কম। ২০১৯ সালের এপ্রিলের প্রথম ১৫ দিনে রফতানি হয়েছিল ১১৯ কোটি ২৯ লাখ ৯০ হাজার ডলারের পোশাক।

বিজিএমইএর কেন্দ্রীয় করোনা পর্যবেক্ষণ সূত্রে জানা যায়, করোনার কারণে এক হাজার ১৪০টি কারখানার ৯৭ কোটি ৯০ লাখ পোশাক পণ্যের রফতানি আদেশ বাতিল ও স্থগিত হয়েছে। যার আর্থিক পরিমাণ ৩ দশমিক ১৬ বিলিয়ন বা ৩১৬ কোটি মার্কিন ডলার। বাংলাদেশী মুদ্রায় এটি দাঁড়ায় ২৬ হাজার ৮৬০ কোটি টাকায়। এখনো আদেশ বাতিলপ্রক্রিয়া চলমান আছে। শুধু তা-ই নয়, আগের পণ্য ক্রেতারাও নিচ্ছেন না। যা-ও কিছু নিচ্ছেন তার বিল ঠিকমতো পরিশোধ করছেন না বলে জানায় বিজিএমইএ। সরকারি ঘোষণার পাশাপাশি অর্ডার না থাকার কারণেও অধিকাংশ কারখানার উৎপাদন বন্ধ।

রফতানি আদেশ বাতিল ও শিপমেন্ট না হওয়ায় নানামুখী সঙ্কটের কারণে দেশের সবচেয়ে বড় শ্রমঘন এ শিল্প খাতে শ্রমিকদের বেতন প্রদানে জটিলতায় পড়েছেন কারখানার মালিকরা। বিষয়টি বিবেচনায় করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে রফতানিমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠানের জন্য ৫ হাজার কোটি টাকার বিশেষ প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে সরকার। এ প্যাকেজ থেকে বিনা সুদে সর্বোচ্চ ২ শতাংশ হারে সার্ভিস চার্জ দিয়ে ঋণ নিতে পারবে উৎপাদনের ন্যূনতম ৮০ শতাংশ পণ্য রফতানি করছে এমন সচল প্রতিষ্ঠান। শর্ত হলো ঋণের অর্থ দিয়ে কেবল শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করা যাবে। কিন্তু তাতেও সঙ্কট কাটেনি। আর্থিক সমস্যার কারণে অনেক পোশাক মালিক এখন পর্যন্ত শ্রমিকদের মার্চ মাসের বেতনই পরিশোধ করতে পারেননি।

বিজিএমইএ জানায়, গতকাল পর্যন্ত তাদের সদস্যভুক্ত ১৮১টি কারখানার এক লাখ ১২ হাজার ৪১৭ শ্রমিকের বেতন এখনো বাকি আছে। সংগঠনটির সদস্যভুক্ত ২ হাজার ২৭৪টি কারখানায় কর্মরত ২৪ লাখ ৭২ হাজার ৪১৭ শ্রমিকের মধ্যে ২ হাজার ৯৩ কারখানার মালিক তাদের শ্রমিকদের মার্চ মাসের বেতন-ভাতা পরিশোধ করেছেন। তাদের হিসাবে ৯৫.৪৫ শতাংশ শ্রমিক বেতন-ভাতা পেয়েছেন। যদিও শ্রমিক নেতাদের দাবি এখনো ৩০ শতাংশ শ্রমিক মার্চ মাসের বেতন-ভাতা পাননি।
বাংলাদেশ শ্রম অধিকার ফোরামের আহ্বায়ক আবুল হোসাইন অভিযোগ করে বলেন, করোনা পরিস্থিতিতে পোশাক কারখানায় বিদেশী অর্ডার বন্ধ হওয়ার অজুহাতে শ্রমিকদের বেতন পরিশোধ করা হচ্ছে না, কারখানা লে-অফ ঘোষণা করা হচ্ছে, শ্রমিক ছাঁটাই করা হচ্ছে, এমনকি কোনো ধরনের ঘোষণা ছাড়াই শ্রমিকদের বেতন পরিশোধ না করে কারখানা গেটে তালা লাগিয়ে দেয়া হচ্ছে। এটা শ্রমিকদের প্রতি অমানবিক আচরণ। শ্রমিকরা এটা কোনোভাবেই মেনে নেবেন না।

এ দিকে বকেয়া বেতন-ভাতা এবং চাকরির নিশ্চয়তার দাবিতে পোশাকশ্রমিকরা প্রায় প্রতিদিনই লকডাউন ভঙ্গ করে বিক্ষোভ প্রদর্শন করছেন। একই দাবিতে গতকালও গাজীপুরে ইস্ট-ওয়েস্ট গ্রুপের নিউওয়ে ফ্যাশনস লিমিটেড পোশাক কারখানার শ্রমিকরা লকডাউনের নিয়ম ভেঙে কারখানার সামনের সড়কে বিক্ষোভ করেছেন। শ্রমিকরা জানিয়েছেন, তাদের তিন মাসের বেতন বকেয়া রয়েছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম দুই ঘণ্টার জন্য মহাসড়ক অবরোধ করে আন্দোলন করেছেন সোনারগাঁয়ের টিপরদী এলাকার ইউসান নিট কম্পোজিট লিমিটেডের শ্রমিকরা।

যদিও এ প্রসঙ্গে বিজিএমইএ সভাপতি ড. রুবানা হক বলেন, বেশির ভাগ বড় বড় প্রতিষ্ঠান মার্চের বেতন পরিশোধ করেছে। যারা বেতন দেননি তাদের অধিকাংশ ছোট ছোট প্রতিষ্ঠান। আমরা তাদের সাথে আলোচনা করছি। আর্থিক সমস্যা, ব্যাংকিং জটিলতা ও চলমান পরিস্থিতিতে যাতায়াতের কারণে বেতন পরিশোধ করতে কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। তবে আগামী ২০ থেকে ২২ এপ্রিলের মধ্যে শতভাগ শ্রমিক মার্চের বেতন পাবেন।

বিজিএমইএ নেতারা জানান, গত কিছু দিন ধরেই এ খাতের অবস্থা খুব খারাপ। বাংলাদেশে শ্রমিকদের বেতন কাঠামো বৃদ্ধি পাওয়ায় মালিকরা ক্রেতার কাছ থেকে এই বাড়তি মূল্য আদায় করছেন। এতে ক্রেতারা আরো কম দামে অন্য বাজারের দিকে ঝুঁকছেন। ভিয়েতনামে কম দামে পোশাক পাওয়ায় তাদের রফতানি আয়ও বৃদ্ধি পাচ্ছে। আবার পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে মুদ্রা অবমূল্যায়ন করায় পোশাক রফতানি কিছুটা কমেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন আগের থেকে কম অর্ডার দিচ্ছে। আবার দেশে জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় এর নেতিবাচক প্রভাব এই খাতের ওপর পড়েছে। রফতানি আয় হ্রাস পাওয়ার পাশাপাশি বিগত কয়েক মাসে নতুন করে আরো বহু কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এই খাতের ব্যবসায়ীদের উদ্বেগ বৃদ্ধি পেয়েছে।

বিশ্লেষকদের মতে, আগামী দিনগুলোতে অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে লিপ্ত হতে চলেছে দেশের তৈরী পোশাকশিল্প খাত। তাদের আশঙ্কা, আগামী তিন মাসে ছয় হাজার কোটি ডলারের বাজার হারাতে পারে বাংলাদেশের তৈরী পোশাকশিল্প খাত। করোনার কারণে কারখানা বন্ধ রাখতে হলে শ্রমিকের বেতন এবং অন্যান্য খরচ বাবদ এ সময়ে যে ক্ষতির মুখে তারা পড়বেন সেটা কাটিয়ে ওঠার ক্ষমতা নেই অর্ধেক উদ্যোক্তারও। এ নিয়ে চরম উদ্বেগের মাঝে দিন কাটছে শিল্পমালিকদের।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *