ঢাকা: দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা ছয়শ’ ছাড়িয়েছে। গতকাল রোববার নতুন করে আরও ১৩৯ জনের শরীরে এই ভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। এখন পর্যন্ত এক দিনে এটিই আক্রান্তের সর্বোচ্চ সংখ্যা। এদিন মৃত্যু হয়েছে আরও ৪ জনের। এ নিয়ে আক্রান্তের সংখ্যা ৬২১ এবং মৃতের সংখ্যা ৩৪-এ পৌঁছাল। নতুন করে দেশের আরও চার জেলায় এই ভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়েছে। এর মধ্য দিয়ে দেশের ৩৫ জেলায় করোনার সংক্রমণ ছড়াল। দেশে মোট আক্রান্তের অর্ধেকেরও বেশি রোগী রাজধানী ঢাকায় শনাক্ত হয়েছে। রাজধানীর ৭৫টি এলাকায় করোনার সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে। এর পরই নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রামে সংক্রমণের হার বেশি। ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ থেকে যাওয়া সংক্রমিত ব্যক্তিদের মাধ্যমে দেশের অন্যান্য জেলায় করোনার সংক্রমণ ঘটেছে বলে জানিয়েছে আইইডিসিআর।
আক্রান্ত ব্যক্তিদের তথ্য-উপাত্ত বিশ্নেষণ করে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা বলেছেন, সংক্রমণের তথ্য পর্যালোচনায় তারা দেখেছেন যে গত এক সপ্তাহে দেশের যেসব জেলায় সংক্রমণ ঘটেছে সেগুলোর বেশিরভাগই ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ থেকে যাওয়া ব্যক্তিদের মাধ্যমে। এর আগে নারায়ণগঞ্জকে ‘ক্লাস্টার’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
গত ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনার সংক্রমণ শনাক্ত হয়। ওইদিন ৩ জনের শরীরে করোনার সংক্রমণ পাওয়া যায়। প্রথম মৃত্যু ঘটে ১৮ মার্চ। এর পর গত ৬ এপ্রিল আক্রান্তের সংখ্যা ১০০ অতিক্রম করে। ওইদিন পর্যন্ত আক্রান্ত হন ১২৩ জন এবং মৃত্যু হয় ১২ জনের। এর পর থেকেই হু হু করে বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা।
চীনের উহান থেকে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। সব দেশেই প্রথমে দুই-একজনের মাধ্যমে সংক্রমণ শুরু হয়েছে। এর পর তা ধাপে ধাপে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। ইতালি, স্পেন, ফ্রান্সের পাশাপাশি যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র এই ভাইরাসের সংক্রমণে কাঁপছে। প্রতিদিনই আক্রান্ত ও মৃত্যুর রেকর্ড হচ্ছে। বাংলাদেশের সংক্রমণ পরিস্থিতিও সেদিকে যেতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, শুরুতে রাজধানীর দুই-একটি এলাকায় সংক্রমণ শনাক্ত হয়। এর পর নারায়ণগঞ্জে। বর্তমানে রাজধানীর সর্বত্র এ ভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে। আবার ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ থেকে যাওয়া ব্যক্তিদের মাধ্যমে দেশের অন্যান্য জেলায় সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ছে। ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশের দিকে তাকালে দেখা যায়, ওইসব দেশেও শুরুতে এভাবেই সংক্রমণ ঘটেছিল। পরে তা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। আমরাও সেদিকে যাচ্ছি।
ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, গত ২৬ মার্চ সরকারি ছুটি ঘোষণার পর হাজার হাজার মানুষ ঢাকা থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। পরে আবার পোশাক কারখানার হাজার হাজার শ্রমিক ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে কর্মস্থলে ফিরে আসে। আবার কারখানা বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত হলে হাজার হাজার শ্রমিক ফিরে গেছে। এ ধরনের সিদ্ধান্তহীনতা, সেই সঙ্গে সমন্বয়ের অভাবে ঝুঁকি আরও বাড়ানো হয়েছে। এর দায় আসলে কার? এটি একবারও কাউকে স্বীকার করতে দেখলাম না। এটি দুঃখজনক। এর পর লকডাউন করার পরও তা কার্যকর হচ্ছে না। শত শত মানুষ রাস্তাঘাটে ঘুরছে। কিন্তু তাদের থামানোর কেউ নেই। এ অবস্থা চলতে থাকলে পরিস্থতি আরও খারাপ হবে।
করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর পরিসংখ্যান
প্রথম শনাক্ত, আক্রান্ত ৩ : দেশে গত ৮ মার্চ প্রথম করোনার সংক্রমণ শুরু হয়। ওইদিন তিনজনের শরীরে করোনার সংক্রমণ শনাক্ত হয়।
প্রথম মৃত্যু : ১৮ মার্চ দেশে করোনা সংক্রমিত প্রথম এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়। ৭০ বছরের বেশি বয়সী ওই ব্যক্তি বিদেশফেরত একজনের মাধ্যমে সংক্রমিত হয়েছিলেন। একই দিন নতুন করে আরও ৪ জনের শরীরে করোনার সংক্রমণ শনাক্ত হয়।
আক্রান্ত ৫০ ছাড়ায় : ৩১ মার্চ আক্রান্তের সংখ্যা অর্ধশত ছাড়িয়ে যায়।
আক্রান্ত ১০০ ছাড়ায় : ৬ এপ্রিল আরও ৩৫ জনের শরীরে করোনার সংক্রমণ পাওয়া যায়। একই সঙ্গে ৩ জনের মৃত্যু হয়। এ নিয়ে আক্রান্ত বেড়ে ১২৩ জন এবং মৃত্যু বেড়ে ১২ জনে পৌঁছায়।
আক্রান্ত ১৫০ ছাড়ায় : ৭ এপ্রিল আরও ৪১ জনের শরীরে করোনার সংক্রমণ পাওয়া যায়। আরও ৫ জনের মৃত্যু হয়। এ নিয়ে আক্রান্ত বেড়ে ১৬৪ এবং মৃত্যু বেড়ে ১৭ জনে পৌঁছায়।
আক্রান্ত ২০০ ছাড়ায় : ৮ এপ্রিল আরও ৫৪ জনের শরীরে করোনার সংক্রমণ শনাক্ত হয়। এদিন আরও ৩ জনের মৃত্যু হয়। এ নিয়ে আক্রান্ত বেড়ে ২১৮ এবং মৃত্যু বেড়ে ২০ জনে পৌঁছায়।
আক্রান্ত ৩০০ ছাড়ায় : ৯ এপ্রিল আরও ১১২ জনের শরীরে এই ভাইরাসের সংক্রমণ পাওয়া যায়। আরও একজনের মৃত্যু হয়। এদিন আক্রান্ত বেড়ে ৩৩০ এবং মৃত্যু বেড়ে ২১ জনে পৌঁছায়।
আক্রান্ত ৪০০ ছাড়ায় : ১০ এপ্রিল আরও ৯৪ জনের শরীরে এই ভাইরাসের সংক্রমণ পাওয়া যায়। একই সঙ্গে মৃত্যু হয় ৬ জনের। এ নিয়ে আক্রান্ত বেড়ে ৪২৪ জন এবং মৃত্যু বেড়ে ২৭ জনে পৌঁছায়।
আক্রান্ত ৪৫০ ছাড়ায় : ১১ এপ্রিল নতুন আরও ৫৮ জনের শরীরে এই ভাইরাস শনাক্ত হয়। এদিন তিনজনের মৃত্যু হয়। এ নিয়ে আক্রান্ত বেড়ে ৪৮২ এবং মৃত্যু বেড়ে ৩০ জনে পৌঁছায়।
৬০০ ছাড়াল : গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে আরও ১৩৯ জনের শরীরে করোনার সংক্রমণ পাওয়া যায়। মৃত্যু হয়েছে ৪ জনের। এ নিয়ে আক্রান্ত বেড়ে ৬২১ এবং মৃত্যু বেড়ে ৩৪ জনে পৌঁছাল।
৩৫ জেলায় সংক্রমণ : নতুন করে দেশের আরও চার জেলায় করোনার সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। জেলাগুলো হলো- লক্ষ্মীপুর, লালমনিরহাট, ঠাকুরগাঁও ও ঝালকাঠি। গত ২৪ ঘণ্টায় এই চার জেলায় করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হয়েছেন। এর মধ্য দিয়ে দেশের ৩৫ জেলায় করোনার বিস্তার ঘটল।
গতকাল পর্যন্ত রাজধানী ঢাকায় ৩১৩ জন, ঢাকা জেলায় ২২, গাজীপুরে ২৩, কিশোরগঞ্জে ১০, মাদারীপুরে ১৯, মানিকগঞ্জে ৫, নারায়ণগঞ্জে ১০৭, মুন্সীগঞ্জে ১৪, নরসিংদীতে ৪, রাজবাড়ীতে ৬, টাঙ্গাইলে ২, শরীয়তপুরে ১, গোপালগঞ্জে ৩, চট্টগ্রামে ১২, কক্সবাজারে ১, কুমিল্লায় ৯, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৬, লক্ষ্মীপুরে ১, চাঁদপুরে ৬, মৌলভীবাজারে ১, হবিগঞ্জে ১, সিলেটে ১, রংপুরে ২, গাইবান্ধায় ৬, নীলফামারীতে ৩, লালমনিরহাটে ১, ঠাকুরগাঁওয়ে ৩, চুয়াডাঙ্গায় ১, ময়মনসিংহে ৫, জামালপুরে ৬, নেত্রকোনায় ১, শেরপুরে ২, বরগুনায় ৩, পটুয়াখালীতে ১ এবং ঝালকাঠি জেলায় ৩ জন শনাক্ত হয়েছেন।
২৪ ঘণ্টার হালনাগাদ তথ্য : গতকাল রোববার অনলাইন বুলেটিনে আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, মোট আক্রান্ত ব্যক্তি অর্ধেকেরও বেশি রাজধানী ঢাকার বাসিন্দা। বাকি আক্রান্তদের মধ্যে ঢাকা বিভাগের অন্যান্য জেলায় ৩৫ শতাংশ এবং চট্টগ্রাম বিভাগে ৬ শতাংশ।
গত ২৪ ঘণ্টায় ১ হাজার ২৫১টি নমুনা পরীক্ষা করে ১৩৯ জনের শরীরে করোনার সংক্রমণ শনাক্ত হয়। তাদের মধ্যে ৯৬ জন পুরুষ ও ৪৩ জন নারী। আক্রান্তদের মধ্যে ৬২ জন ঢাকার এবং অন্যরা ঢাকার বাইরে বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দা। গতকাল মৃতদের মধ্যে ৩ জন পুরুষ, ১ জন নারী। ২ জন ঢাকার এবং ২ জন ঢাকার বাইরের বাসিন্দা। এ ছাড়া আক্রান্তদের মধ্যে আরও ৩ জন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। এর মধ্য দিয়ে আক্রান্ত ৩৯ জন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলেন। সুস্থ হওয়া তিনজনের মধ্যে একজন চিকিৎসক। তিনি আক্রান্ত ব্যক্তিকে চিকিৎসা দিতে গিয়ে সংক্রমিত হয়েছিলেন।
ডা. ফ্লোরা জানান, বর্তমানে সারাদেশে মোট ২০ হাজার ৫২৫ জন কোয়ারেন্টাইনে আছেন। তাদের মধ্যে হোম কোয়ারেন্টাইনে আছেন ১৯ হাজার ১১১ জন এবং প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে এক হাজার ৪১৪ জন।
দেশের আরও চার জেলায় করোনায় সংক্রমণের তথ্য জানিয়ে পরিচালক বলেন, দেশে নতুন করে আরও চার জেলায় করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঘটেছে। এই জেলাগুলো হলো- লক্ষ্মীপুর, লালমনিরহাট, ঠাকুরগাঁও ও ঝালকাঠি। তথ্য-উপাত্ত বিশ্নেষণ করে দেখা গেছে, এ চারটি জেলায় নতুন করে আক্রান্ত ব্যক্তিরা গত এক সপ্তাহের মধ্যে রাজধানী ঢাকা কিংবা নারায়ণগঞ্জ থেকে সেখানে গিয়েছেন। এ কারণেই সবাইকে বারবার ভ্রমণ না করার জন্য সতর্ক করা হচ্ছে। করোনার বিস্তার রোধে তিনি সবাইকে বাড়িতে থাকার পরামর্শ দেন। একই সঙ্গে স্বাস্থ্য বিভাগের পরামর্শ মেনে চলার আহ্বান জানান।
বুলেটিনে জানানো হয়, গত ২৪ ঘণ্টায় ঢাকায় ৭৬১ জন এবং ঢাকার বাইরে ৪০৯ জন মিলিয়ে মোট ১ হাজার ২৫১ জনের নমুনা সংগ্রহ করা হয়। আগের দিনের ৮৯টির সঙ্গে যুক্ত করে গত ২৪ ঘণ্টায় ১ হাজার ৩৪০টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়। নমুনা সংগ্রহের হার গত শনিবারের তুলনায় ১০ শতাংশ বেড়েছে।
আরও চার বিশ্ববিদ্যালয়ে করোনা পরীক্ষা : দেশের চারটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে করোনাভাইরাস শনাক্তকরণ পরীক্ষা করা হবে। এগুলো হলো- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিম্যাল সায়েন্স বিশ্ববিদ্যালয়, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। এই চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবে করোনাভাইরাস শনাক্তকরণের বিদ্যমান অবকাঠামো যাচাই করে সেখানে পরীক্ষা চালুর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। দেশের ১১টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে রিয়েল টাইম পিসিআর মেশিন রয়েছে বলে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে অবগত করার পর আপাতত চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য এ উদ্যোগ নেওয়া হলো। বর্তমানে ঢাকায় ৯টি এবং ঢাকার বাইরে ৮টি কেন্দ্রে নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ জানান, এই চারটি বিশ্ববিদ্যালয় করোনা শনাক্তকরণ কাজে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। চাহিদার প্রেক্ষিতে রিয়েল টাইম পিসিআর মেশিন থাকা আরও সাতটি বিশ্ববিদ্যালয়ে করোনাভাইরাসের রোগী শনাক্তকরণের উদ্যোগ নেওয়া হবে।