ডেস্ক: বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত যে কয়জন করোনাভাইরাস আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হয়েছে তার অর্ধেকের বেশিই ঢাকায়।
বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত মোট করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে ৪৮২ জনের মধ্যে, যার মধ্যে অন্তত ২৫৭ জনই ঢাকা জেলায় রয়েছেন।
কয়েকদিন আগে বাংলাদেশের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা বিভাগ জানায় যে নারায়ণগঞ্জকে এই মুহুর্তে বাংলাদেশে ভাইরাস সংক্রমণের ‘এপিসেন্টার’ মনে করা হচ্ছে। তবে ঢাকার ভেতরে কোভিড-১৯ রোগে আক্রান্তের সংখ্যা নারায়ণগঞ্জে শনাক্ত হওয়ার সংখ্যার চেয়ে অনেক বেশি।
ঢাকায় কয়েকটি ক্লাস্টারে সংক্রমণ শুরু হয়েছে বলে কয়েকদিন আগেই জানানো হয় আইইডিসিআরের পক্ষ থেকে।
ঢাকার মিরপুরের টোলারবাগ, বাসাবো এবং পুরনো ঢাকায় ছোট আকারের ক্লাস্টারে কমিউনিটি সংক্রমণ বা সামাজিক সংক্রমণ হচ্ছে বলে জানিয়েছিল আইইডিসিআর।
ঢাকায় কীভাবে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়লো করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগী?
করোনাভাইরাস যেহেতু বিদেশ থেকে দেশে প্রবেশ করা মানুষের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে, তাই ঢাকাতে ভাইরাসের প্রকোপ বেশি থাকার মধ্যে অস্বাভাবিকতা নেই বলে মন্তব্য করেন আইইডিসিআরের উপ পরিচালক নাসিমা সুলতানা।
“বিদেশ থেকে আসা অনেকে ঢাকার বিভিন্ন এলাকাতেই থাকেন। তাছাড়া ঢাকার বাইরেও যেসব প্রবাসী থাকেন, তাদের অনেকেই বিমানবন্দরে নেমে প্রথমে কিছুদিন ঢাকাতেই অবস্থান করেছেন। সেখান থেকেই সংস্পর্শের মাধ্যমে সংক্রমণ ঘটেছে বলে মনে করছি আমরা।”
তবে আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এএসএম আলমগীর মনে করেন আরো অনেক কারণেই ঢাকার ভেতরে সংক্রমণের হার বেশি হয়ে থাকতে পারে।
“ঢাকার মত জনবহুল ও ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় মানুষ থেকে মানুষের মধ্যে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়াটা খুবই স্বাভাবিক।”এএসএম আলমগীর বলেন এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যাতায়াতের হিসেবে দেশের অন্য যে কোনো এলাকার চেয়ে বেশি সুবিধা রয়েছে ঢাকায়, যেটি করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণ হতে পারে।
“করোনাভাইরাস কোনো একটি সমতলে বেশ কিছুক্ষণ বেঁচে থাকে। অর্থাৎ কোনো একটি রিকশা, গাড়ি বা গণপরিবহনে একজন ভাইরাস আক্রান্ত ব্যক্তি ভ্রমণ করলে সেখানে তা লেগে থাকতে পারে এবং পরে আরেকজন ঐ পরিবহণ ব্যবহার করলে তাকে সংক্রমিত করতে পারে”, বলেন মি. আলমগীর।
এছাড়া আক্রান্ত ব্যক্তির মাধ্যমে সিঁড়ির রেলিং, লিফট, এসকেলেটরেও ভাইরাস ছড়াতে পারে, যা পরে অন্যকে সংক্রমিত করতে পারে।এএসএম আলমগীর বলেন, “দেশের অন্য যে কোনো এলাকার চেয়ে ঢাকা শহরে এইভাবে সংক্রমণ ছড়ানোর সুযোগ বেশি।”
পাশাপাশি ঢাকায় হাসপাতালগুলোর মাধ্যমেও ভাইরাস ছড়াতে পারে বলে ধারণা প্রকাশ করেন আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা।
“শুরুর দিকে যেহেতু ঢাকার কয়েকটি হাসপাতালেই ভাইরাসের উপস্থিতি পরীক্ষা কর হয়েছে, সেসময়ও ভাইরাস ছড়িয়ে থাকতে পারে। একটি হাসপাতালে পরীক্ষা করাতে আসা ব্যক্তিদের মধ্যে হয়তো কয়কেজনের মধ্যে ভাইরাস ছিল, কিন্তু তাদের মাধ্যমে হাসপাতালে যাওয়া অসতর্ক ব্যক্তিদের মধ্যে ভাইরাস ছড়িয়ে থাকতে পারে। কারণ পরীক্ষা করানোর জন্য হাসপাতালগুলোতে অনেকসময় দীর্ঘ লাইন হতো।”
আর কারো দেহে করোনাভাইরাস শনাক্ত হলে আক্রান্ত ব্যক্তি এবং তার পরিবারকে সামাজিকভাবে অপদস্থ করার মত ঘটনা ঘটার কারণে ঢাকার ভেতরে ভাইরাস সংক্রমণের বিষয়টি আগে থেকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি বলে ধারণা প্রকাশ করেন মি. আলমগীর।
“অনেকক্ষেত্রেই আমরা দেখেছি ভাইরাস আক্রান্ত হওয়ার উপসর্গ দেখা দিলে বা শনাক্ত হলে ঐ ব্যক্তি ও তার পরিবারের সাথে বিরুপ আচরণ করেছেন আত্মীয় স্বজন, এলাকাবাসী বা প্রতিবেশীরা।”
“এরকম পরিস্থিতি তৈরি হওয়ায় অনেকেই হয়তো উপসর্গ দেখা দেয়ার পরও চিকিৎসা নিতে আসেননি, বা দেরিতে এসেছেন – কিন্তু ততদিনে হয়তো তার মাধ্যমে কয়েকজনের মধ্যে সংক্রমণ ঘটেছে”, বলেন এএসএম আলমগীর।’পালিয়ে যাওয়ার প্রবণতা বাড়ছে’
এই ধরণের ঘটনা ঘটার ফলে রোগী শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়ছে বলে মনে করছেন আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ডাক্তার মোশতাক হোসেনও।
“কারো বাসায় স্বাস্থ্যকর্মীরা নমুনা সংগ্রহ করতে গেলে তার বাসা একরকম লকডাউন হয়ে যাচ্ছে। যারা ফ্ল্যাটবাড়ি বা একটি মহল্লায় থাকেন, অনেকসময় আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এসে পুরো এলাকাটিই লকডাউন করে দিচ্ছেন।
তারা অপেক্ষাও করছেন না নমুনা পরীক্ষার ফলাফলের জন্য।”
এসব ঘটনার কারণে মানুষ মধ্যে রোগ লুকিয়ে রাখা ও শনাক্ত হলে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পালিয়ে যাওয়ার প্রবণতা বাড়ছে বলে মনে করেন মোশতাক হোসেন।
ঢাকার মধ্যে ভাইরাস প্রাদুর্ভাব ছড়িয়ে পড়ার এটিও একটি কারণ বলে ধারণা করছেন আইইডিসিআরের সাবেক এই মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা।”সতর্কতামূলক পদক্ষেপ হিসেবেই বিদেশ থেকে আসা ব্যক্তিদের হোম কোয়ারেন্টিন করার অনুরোধ করা হয়েছিল। কিন্তু অনেক গ্রামাঞ্চলে তারা এক ধরণের সামাজিক বৈষম্যের শিকার হয়েছেন।”
“আবার বিদেশফেরত অনেকেই হোম কোয়ারেন্টিনের অনুরোধ মানেন নি। তখন অনেক এলাকার জনগণই তাদেরকে সহযোগিতা করার পরিবর্তে তাদের বিরুদ্ধে বিরুপ হয়েছেন। ফলে তারা সেখান থেকে ঢাকা চলে এসেছেন”, বলেন মোশতাক হোসেন।
“দীর্ঘস্থায়ী লকডাউনের ভয়ে অন্য এলাকা থেকে ঢাকায় এসেছেন এমন প্রবাসী ব্যক্তি আছেন” মন্তব্য করে মোশতাক হোসেন জানান ঢাকায় আসলে কেউ সেভাবে খবরদারি করবে না বিধায় প্রবাসীদের অনেকেই ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় এসে অনেকটা গোপনে বসবাস করছে।
মোশতাক হোসেন জানান ঢাকার যেসব এলাকায় ক্লাস্টার পাওয়া গেছে সেসব জায়গায় এরকম বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা ব্যক্তি শনাক্ত করেছেন তারা।
তবে আইইডিসিআরের উপদেষ্টা বলেন, ঢাকায় সবচেয়ে বেশি হারে মানুষ করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হচ্ছে শনাক্ত করা ক্লাস্টারগুলো থেকেই।
সূত্রঃ বিবিসি বাংলা